সোনালী দিনের উপাখ্যান
দেবব্রত ঘোষ মলয়
পূর্বকথন
রাজেন ঠাকুরের সর্পঘাতে আকস্মিক মৃত্যু ঝিনটি, রাজকুমার সহ সারা গ্রামকে শোকাহত করে। পারলৌকিক কাজ মিটে যায় যথানিয়মে। রাজকুমারকে বাঁকুড়া যেতে হবে। একা হয়ে যাওয়া ঝিনটিকে রাজলক্ষী দেবী তাঁদের বাড়িতে থাকার প্রস্তাব দেয়। এরপর ...
পর্ব ৯
ঝিনটির কান্না সবার মন খারাপ করে দেয়। রাজকুমার বলে ওঠে - আমি ফাইনাল পরীক্ষার পরই গ্রামে ফিরে আসব। দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে যাবে। এ কদিন ঝিনটি এ বাড়িতে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত থাকব।
ঝিনটি নীরব থাকে। রাজু বলে - বোনকে নিয়ে আমি একটু বাড়ি যাই। এই দুদিনে ঘরটা একটু গুছিয়ে নিই। তারপর না হয় রাত্রে বোন এ বাড়িতে শুতে আসবে।
সন্ধ্যে হবার আগেই ভাই-বোন পৌঁছে যায় নিজেদের বাড়ি। এ বাড়িতে তালা ঝোলানোর রেওয়াজ খুবই কম ছিল আগে, এখন দরজায় লাগানো ভারী তালা খুলে রাজকুমার। ঝিনটি ঝটপট পরিষ্কার করে ফেলে বাড়ির ভিতরটা, আলনায় এলোমেলো জামা কাপড়গুলো ভাঁজ করে, রান্নাঘরে অগোছালো বাসনপত্র গুছিয়ে রাখে। রাজকুমার বলে - বোন একটু চা করে নিয়ে আয় না, আমি ততক্ষণ বাবার বইযের তাকটা গুছিয়ে ফেলি।
রাজেন ঠাকুর বই পড়তে ভালোবাসতেন। পুরান ধর্মগ্রন্থ যেমন পড়তেন, তেমনই গল্প উপন্যাস। ভাইবোন ছোট থেকে বাবাকে বাড়িতে থাকাকালীন দেখেছে হয় বই পড়তে, না হলে লিখতে। রাজেন ঠাকুর বেশ কয়েকটা বড় মোটা খাতা ভর্তি করে ফেলেছিলেন। ভাই বোনের কোন আগ্রহ হয়নি জানতে, বাবা কি লেখে। আজ বই গুছাতে গিয়ে রাজুর হাতে পরে যায় সেরকমই একটি খাতা। খাতার উপরে সুন্দর হস্তাক্ষরে বড় করে লেখা "সূর্যাস্তের আগে"। নীচে লেখা একটি উপন্যাস। তারও নীচে বাবার নাম।
বাবা উপন্যাস লিখতেন। কোনদিন তো বলেন নি। রাজকুমারকে বইয়ের নেশা ধরিয়েছিলেন বাবাই। পাতা উল্টে পড়তে শুরু করে দেয় রাজকুমার। সুলিখিত কাহিনীর মধ্যে ডুবে যায় সে।
দাদা, চা - বোনের ডাকে সম্বিৎ ফেরে দাদার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এক ঘন্টা পার হয়ে গেছে। ঝিনটির হাত থেকে চা নিয়ে চুমুক দেয় সে। বলে - বোন, একবার কলকাতা যেতে হবে রে।
কেন দাদা?
তুই ভাবতেও পারবি না বোন, বাবার লেখা কোন পর্যায়ের। আমি সাহিত্যের ছাত্র নই, কিন্তু ভালবেসে বহু লেখকের লেখা উপন্যাস, গল্প পড়েছি। বাবার লেখা তাঁদের থেকে কোন অংশে কম নয়।
কলেজ স্ট্রিটে প্রথম সারির দু তিনজন পাবলিশার্স এর কাছে নিয়ে যাব বাবার লেখা। তুই দেখিস, বাবার লেখা ওঁরা লুফে নেবেন।
রাত্রি দশটার মধ্যেই রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ে ভাই বোন। দু একটা কথা বলতে বলতে তলিয়ে যায় অতল ঘুমে।
একটা হৈ চৈ মৃদু কোলাহলে ঘুম ভেঙে যায় রাজকুমারের। বিছানায় উঠে বসে সে। ঘরের ভিতর অন্ধকার। এখন রাত কটা। মাথার কাছে রাখা টর্চ জেলে ঘড়ি দেখে ভোর পাঁচটা। হেমন্তের কুয়াশা আর হিম হিম ভোরের হাওয়ায় ভেসে আসছে মিষ্টি শিউলির গন্ধ। গায়ে হালকা একটা চাদর জড়িয়ে সন্তর্পনে আওয়াজ না করে দরজা খোলে সে। বাইরে এসে দেখে ভোরের আলো ফুটে গেছে। তারই মধ্যে বাড়ির সামনের মোরামের পথ ধরে গ্রামের অনেক মানুষ চলেছে। মিত্তিরদের টুনুজেঠু ১৪ বছরের নাতি তোজোর হাত ধরে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালেন। রাজকুমারকে দেখে বললেন - কি হে, তুমি জানো না?
রাজকুমার বিষ্ময়ের সাথে বলে - না তো জ্যাঠাবাবু। কি হয়েছে?
আরে কি কাণ্ড। নিবারণদের ছোট বৌমা শেফালী তো অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়ে। ঘরদোর ঝাঁটপাট দিয়ে ঠাকুরের বাসন ধুতে চলে আসে শ্যামসায়রে। আজও তাই করছিল। হঠাৎ ভয় পেয়ে চিৎকার করে পাড়া মাথায় করে। ওই দীঘিতে নাকি সাগরের মত ঢেউ উঠেছে। ওর চিৎকারে ঘোষেদের পদা আর নেপালের ছোট ভাই গোপাল দৌড়ে যায় শ্যামসায়রে। দেখে কি ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ উঠেছে দীঘিতে আর বাসনপত্র সব ভেসে যাচ্ছে। পুকুরে এত বড় বড় ঢেউ দেখে ওরা তো ভুত ভুত করে চিৎকার শুরু করে দেয়। তাই তো গ্রাম ভেঙে লোক চলেছে।
এতক্ষনে ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে ঝিনটি। রাজু তাকে বলে - বোন তুই একটু ঘরে থাক, আমি জ্যাঠাবাবুর সঙ্গে একটু শ্যামসায়রের ধার থেকে ঘুরে আসি।
অবাক চোখে তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ঝিনটি।
ক্রমশঃ