পথ চাওয়া
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
বুধিয়ার আজ ঘরে ফিরতে রাত গড়িয়ে যাচ্ছে! দাওয়ায় বসে সুমি হা করে পথ চেয়ে বসে আছে। বাচ্চাদু'টো দু'মুঠো খেয়ে শুুয়ে পড়েছে। এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে কাদা। বুধিয়া রোজই বাগান থেকে ফিরে আগে কত গল্প করত!
সুমির দিব্যি মনে আছে। বিয়ের পর, বাচ্চাদের জন্মের সময়েও বুধিয়া একদম অন্য রকম মানুষ ছিল! হ্যাঁ, অভাব তখনো ছিল সংসারে। কিন্তু তার মধ্যেও বেশ একটা শান্তি ছিল। মোটামুটি দিন চলে যেত! দু'বেলা দু'মুঠো জুটে যেত পেট ভরার জন্য! মাধ্যমিক পাশ করতে না পারলেও বুধিয়ার জ্ঞানগম্যি বেশ ভালোই ছিল। কি সুন্দর সুন্দর গল্প বলত! দেশ বিদেশের অনেক কাহিনী তার ঝুলিতে। জীবনে পূর্ব-পশ্চিম বিশেষ না দেখে থাকলেও গল্পের বই পড়ে বুধিয়া বেশ সমৃদ্ধ ছিল। বুধিয়ার মুখে সুমি আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনের গল্প ও লিংকনের গল্প শুনেছে। ফরাসী বিপ্লবের কাহিনী, রোমের ইলিয়াড ওডিসি, না জানি আরো কত কিছু! সেই মানুষটি কেমন যেন বদলে গেছে!
গত দু'বছর ধরেই ধুঁকছিল শিবরামপুর চা বাগান! মালিকেরা পাততাড়ি গোটাতে সচেষ্ট ছিল। দফায় দফায় বারবার লকআউট হল। শেষমেষ বন্ধ হয়ে গেল অনির্দিষ্টকালের জন্য। সেই শুরু সর্বনাশের। যে বুধিয়া কোনদিন একটা চুমুক পর্যন্ত দেয়নি সুরায়, যাকে নিয়ে অনেকে ব্যাঙ্গবিদ্রুপ করতে ছাড়ত না এটা নিয়ে, সেই বুধিয়া নিজেকে সঁপে দিল হাড়িয়ার কাছে! অভাব, অনটন তাকে ধীরে ধীরে ভেঙে দিতে থাকল। ওদিকে বাচ্চাদুটো গুটিগুটি পায়ে বেড়ে উঠছে! সুমির তখন দিন রাত দু'টোই এক! সমান অন্ধকার! চোখে সর্ষে ফুল। একদিকে সংসারের দৈন্য, অপরদিকে বুধিয়ার স্বভাবের এই অবান্ছিত পরিবর্তন। যেন পরিস্থিতির সাঁড়াশি আক্রমণ।
কিন্তু সুমি হাল ছাড়ার পাত্র নয়। ছাড়েও নি। লড়াই করে গেছে শেষ পর্যন্ত। ঈশ্বর শুনেছেন শেষ অবধি! তিন মাস আগেই সরকার অধিগ্রহণ করে বাগানটিকে। আর মালিকানা হস্তান্তর হয় ওয়েলবিং টি গ্রুপের হাতে। বিশ্ব খ্যাত চায়ের কোম্পানি। তারা আবার শুরু করেছে বাগান ও ফ্যাক্টরি। ক'মাস ধরে বেশ ছন্দ ফিরছে বাগানে। আর সেই সঙ্গে বাগানিয়া জীবনযাত্রায়। কিছুটা হলেও দারিদ্র্য ঘুচছে সবার। অন্ধকার জীবনে দেখা যাচ্ছে এক হাল্কা রুপোলি রেখা।
কিন্তু কু-অভ্যাসটা গেঁথে গেছে ভালোমতোই। বুধিয়া তাই আজো যায় হাড়িয়ার আসরে। তবে সুমির লড়াই জারি আছে। আগে তো রোজ যেত বুধিয়া। সেখান থেকে কমতে কমতে ব্যাপারটা সাপ্তাহিকে এসে দাঁড়িয়েছে এখন। সুমির বিশ্বাস একদিন না একদিন সেটা একেবারেই মুছে দিতে পারবে জীবন থেকে। আবার ফিরে পাবে আগের বুধিয়াকে। ফিরিয়ে দিতে পারবে বাচ্চাদের, ওদের বাবাকে। আগের মতো, আগের রূপে।
এ লড়াইয়ে সে কিছুতেই হারবে না বাগিচাজীবনে বড় হওয়া সুমি। শৈশব থেকে কৈশোরে যাওয়ার পথেই সে একে একে হারিয়েছে বাবা ও দাদাকে! অসহায়ের মতো। সে দিন আজো পরিষ্কার চোখে ভাসে তার।
চোখ মুছে আবার উতলা হয়ে রাস্তার দিকে উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকে সুমি।
..................