স্টেশনে ঢুকতেই সিঁড়ির মুখটাতে প্রত্যেকদিন তাঁর সঙ্গে দেখা। প্রতিদিন সেই চেনা ঘ্যানঘেনে আওয়াজ একটা- দুটো টাকা দিয়ে যাও বাবু, একটা- দুটো টাকা দিয়ে যাও। আমিও প্রায় প্রত্যেক দিনই কিছু না কিছু দিয়েই পাশ কাটিয়ে চলে যায়। মাথায় থাকে ট্রেন ধরার তাড়া,কটায় অফিসে পৌঁছাবো তার চিন্তা, আজ ট্রেন রাইট টাইমে পৌঁছাবে না, মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাবে- এমনই অসংখ্য চিন্তা। কোনও কোনও দিন যেদিন একটু আগে আসি মনে হয় একটু বেশি করেই দিই আবার পরক্ষনেই মনে হয় ভিক্ষা করাটা শালা এদের নেশা! মনে মনে হিসাব করতে থাকি, যদি প্রতিদিন গড়ে আমার মত 100 -200জনও একে এক টাকা, দু টাকা করে দেয় তাহলে প্রতিদিন প্রায় 200 থেকে 300 টাকা রোজগার করে এই মেয়েটা। একটা শ্রমিক সারাদিন পরিশ্রম করেও এই টাকা রোজগার করতে পারবে কিনা সন্দেহ! এইসব মনে করে ইচ্ছে করেই একেকদিন কিছু দিই না।
যে ভিখারিটির কথা এতক্ষণ বলছিলাম তিনি একজন মহিলা।আঁটোসাঁটো গড়ন, মনে হয় চোখে একটু কম দেখে, না হলে এমনিতেই জুতসই শারীরিক গঠন। প্রায় প্রতিদিনই দেখি তার পিছনে ঘুরঘুর করে জনাকতক লোক। লোকগুলো তাকে দেখে,আর খ্যাকখ্যাক করে হাসে। মাঝে মাঝে ভাব জমাতে চায়। ভিখারিনীর পাশে থাকা একটা গাল বসে যাওয়া ভিখারিও মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকে দেখে আর দাঁত বের করে হাসে। আমি মাঝে মাঝে এগুলো দেখি আর ভাবি কোনদিন না কোনও অঘটন ঘটে যায় । এখন যা অবস্থা তাতে একটা দৃষ্টিহীন নারীও সুরক্ষিত নয়। সমাজে যেভাবে নারীদের উপর অত্যাচার বাড়ছে তাতে একজন দৃষ্টিহীন নারীও ছাড় পাবে তার কোন নিশ্চয়তা মন থেকে পাচ্ছিলাম না।
এইরকম ভাবে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। অনেক দিন ট্রেনে যাতায়াত করা হচ্ছিল না। বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন ট্রেন ধরতে আসছি। হাতে বেশ কিছুটা সময়ও ছিল, সিড়িতে উঠতে যাচ্ছি, দেখি সেই ভিখারীর মেয়েটির সিঁথিভর্তি সিঁদুর ।দেখেই বুঝতে পারলাম পাশের গাল বসে যাওয়া ভিখারিটিকে সে বিয়ে করেছে। দুজনে পাশাপাশি বসে বেশ আনন্দের সঙ্গে ভিক্ষা করছে। আমার দেখে বেশ ভালো লাগলো, মনে মনে একটু শান্তিও পেলাম।
এখন ট্রেনে বসে আছি। অনেকদিন কোন সিনেমা দেখা হয়নি। একটা সিনেমা দেখবো ঠিক করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ইউটিউব সার্চ করলাম। সিনেমার একটা সিনে এসে মনটা স্থির হয়ে গেল- নায়িকা বলছে নায়ককে 'এক চুটকি সিঁদুর কা কিমত তুম ক্যয়া জানো রমেশবাবু!'
হঠাৎ করেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মনে পড়ল ভিখারিনীর সিঁথির সিদুরের কথা। সত্যিই তো এক চুটকি সিঁদুরই তাঁর জীবনটাকে এইভাবে বদলে দিতে পেরেছে। নইলে কি যে হত!
-----------