ওয়াটার বটল
অনিন্দ্য পাল
এক~
চিঠি,চিঠি...কোথায় গেলি রে! কে এসছে দেখ। তোর ফুলবোন রে। তাড়াতাড়ি আয় মা।
মিনতি আর তার মেয়ে পিউ কে বসতে বলে গৌরী ভিতরে গেলেন।
আজ চিঠির জন্মদিন। ছয় হল। খুব জাঁকজমক না হলেও মোটামুটি আয়োজন করেছেন অশোক। সারাদিন, বিশেষত দুপুরে অতিথি সামলাতে হিমশিম খেয়ে এখন এই সন্ধ্যার দিকে সবে মাত্র একটু বিশ্রাম নিতে যাবেন তখনি ওরা দুজন এল। মিনতি এ বাড়িতে তোলা কাজ করে। পিউ ,চিঠির চেয়ে একটু ছোট। মায়ের সঙ্গে আসে। বাচ্চারা কাজের লোক আর মালিক বোঝে না । পিউ আর চিঠি বিকেলে ছোট্ট উঠোনে যখন খেলা করে, মিনতির চোখ দুটো জুড়িয়ে যায়। গতবার ভাই ফোঁটায় পিউ, চিঠির ফুলবোন হয়েছিল। বোনফোঁটা দিয়ে ছিল চিঠি।
এত মাখামাখিতে অশোকের আপত্তি থাকলেও মেয়ের আনন্দ, খুশির কাছে নিজের জেদ বজায় রাখতে পারেন নি। গৌরী ও পিউকে বেশ স্নেহ করেন।
একটা ললিপপ চুষতে চুষতে চিঠি মায়ের আঁচলটা ধরে ঘরে ঢুকতেই পিউ এর মুখটা খুশিতে ভরে উঠলো। মায়ের পাশ থেকে উঠে এক ছুটে চিঠির হাতে
গিফট প্যাকটা দিয়ে তবেই শান্তি। রোজকার মতো আজকে আর খেলা হল না দুজনের কিন্তু চিঠির পাওয়া গিফট গুলো দেখতে দেখতে শুরু হয়ে গেল খুনসুটি।
দুই ~
নাহ্।
পাওয়া গেল না।
গেল না তো গেলই না। অত সুন্দর ওয়াটার বটল টা পাওয়াই যাচ্ছে না। গতকালই চিঠির মামা জন্মদিনের একগাদা উপহারের সঙ্গে ওটাও দিয়েছিল। সব কিছুর মধ্যে ওটাই ভীষণ পছন্দ হয়েছিল চিঠির। সব উপহার গুলোই আছে শুধু সেটাই নেই।
ঘুম থেকে উঠেই চিঠির তাই মনটা একদম ভালো নেই। কান্নাকাটিও করলো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর থেকে চুপচাপ জানালার ধারে বসে আছে।
অশোক সকাল সকাল ব্যবসার কাজে বেরিয়ে গেছেন। ফিরতে রাত হবে। তাড়াহুড়োতে সেলফোনটা নিতে ভুলে গেছেন। অবশ্য তখন চিঠির ঘুম ভাঙেনি। তাহলে আর সেল ফোন ভুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। অশোকের বেরোবার সময় চিঠিই রোজ ফোনটা চার্জ থেকে খুলে ব্যাগে ভরে দেয়। এটা তার ডিউটি। না পালন করতে দিলেই ধুন্ধুমার, কান্নাকাটি ।অশোক থাকলে মেয়েকে ঠিক ভুলিয়েভালিয়ে মন খারাপ করতেই দিতেন না। গৌরীর অত ধৈর্য্য নেই। কিন্তু গৌরীও আজ মেয়েকে একদম বকাবকি করেন নি। সকাল থেকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও যখন পাওয়া গেল না কোথাও, অবাকই হলেন। যাবে কোথায় জিনিস টা? সন্ধ্যার পরে তো বাড়িতে অপরিচিত কেউ আসে নি। আর শুধু ওয়াটার বটল টা নিয়ে যেতে কি কেউ আসবে। না না -গৌরী নিজের ভাবনাটাকে গুরুত্ব দিতে পারেন না। হঠাৎ করে মনে অন্য একটা চিন্তা খেলা করে গেল। গৌরী যেন একটু চমকে উঠলেন। তবে কি...। হতেও পারে।
মিনতি কাজ করছিল। মাছটা কাটতে দিয়ে চিঠিকে ওর ঠাকুমার কাছে রেখে আটপৌরে শাড়ি পরেই বেরিয়ে পড়লেন। নাহ্ ,বটলটা উদ্ধার করতেই হবে। হাতে সময় মাত্র আধ ঘন্টা।
হন্তদন্ত হয়ে যখন পৌছলেন, অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করতে করতে বাড়িটা খুঁজে পাওয়া গেল অনেক কষ্টে। বাড়ি তো নয় -ভাঙাচোরা একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই। তিন দিক চাঁচ দিয়ে ঘেরা আর সামনের দিকে ছেঁড়াখোড়া কালো পলিথিন দিয়ে ঘেরা। মাথার উপর কোথাও পলিথিন কোথাও টালি। নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে গৌরী ভিতর থেকে। কি করে থাকে এখানে? একবার ভাবলেন ফিরে গিয়ে একটা ওই রকম ওয়াটার বটল কিনে নিয়ে যাবেন। আবার ভাবলেন -নাহ্ এসেছি যখন দেখা যাক কি হয়!
বাখারি জুড়ে বানানো দরজা টা একটা বাঁশের খুঁটিতে ছেঁড়া তার দিয়ে বাঁধা। থমকে গেলেন গৌরী। তাহলে উপায়? সবে পিছন দিকে তাকিয়ে ফিরে আসবেন ভাবছেন এমন সময় একজন বয়স্ক মহিলা বললেন "ও তো বাড়ি নি গো মা, মেয়েটারে ঘরের মদ্দি রেখে কোথায় বাবুর বাড়ি কাজে যায় ।"
"ওহ্ -আচ্ছা ঠিক আছে"। বয়স্ক মহিলা লাঠি ঠুকতে ঠুকতে চলে যেতেই গৌরী প্যাঁচানো তারটা খুলে ভিতরে ঢুকলেন।
এত গরীব ও মানুষ হতে পারে! গৌরীকে কে যেন হঠাৎ একটা বিরাট প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
একটা ভাঙা চৌকির উপর মাদুর পেতে তার উপর কয়েকটা পোড়া মাটির খেলনা নিয়ে একমনে বসে আছে -তার মেয়ের ফুলবোন, পিউ। একটা হাতল ভাঙা কড়াই হাতে নিয়ে চুপটি করে বসে চাঁচ কেটে বানানো জানালার মত চৌকো খোপ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বুঝতেও পারে নি কেউ ঘরে ঢুকেছে।
কিন্তু গৌরীর এখন এসব দেখলে হবে না। চারদিকে প্রখর দৃষ্টিতে দেখলেন। তেমন কিছু নজরে পড়ল না। তার মেয়ে পিউকে কয়েকটা পুরানো টেডি দিয়ে ছিল সেগুলো ছাড়া আর খেলনা কিছুই চোখে পড়লো না। কোন আসবাবপত্র ও নেই। এক কোনায় একটা বাক্স আর তার উপর বস্তায় বাঁধা কিছু আছে। হতে পারে এখানে আনেই নি। হতে পারে বিক্রি করে দিয়েছে।
--পিউ
আস্তে করে ডাকলেন গৌরী। অবাক হয়ে চেয়ে থাকা পিউকে বস করার জন্য তৈরী হয়েই এসে ছিলেন। গতকাল চিঠির উপহার পাওয়া চকোলেট আর টফি কয়েকটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো তার হাতে দিতে গেলেন।
--মা বকবে। মা বলেছে মা যখন বাড়ি থাকে না তখন কেউ কিছু দিলে খাবি না। তুমি আমার জন্য এনেছ এগুলো!!
চোখে মুখে আনন্দ থাকলেও সেগুলো নিল না পিউ। গৌরী বুঝতে পারছিলেন না কি ভাবে ওকে জিজ্ঞাসা করবেন । হাতে সময় ও বেশী নেই। মরিয়া হয়ে উঠলেন গৌরী।
তিন~
মিনতি চলে যাওয়ার আগেই পৌঁছাতে হবে। প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে এলেন গৌরী। আর একটা তোলা কাজের লোক যোগাড় করতে হবে। এ মাসের মাইনে দিয়ে আজকেই মিনতি কে বারন করে দেবেন। অনেক চেষ্টা করেও যখন কিছু পেলেন না বিরক্ত হয়ে
চলে আসতে যাবেন তখনি পিউ বলল "জানোতো -আমার মা না আজ আমার জন্য একটা অতলবতল আনবে বলেছে। ঐ যে দিদির যেমন আছে না। "
আর দাঁড়াননি গৌরী। তার আর দরকার ও ছিল না।পিউ কালকেও ওয়াটার বটল টাকে অতলবতল বলছিল। আর ওটা নিয়েই দুজন কাড়াকাড়ি করছিল। মিনতি নিশ্চয়ই কাল ওটা সরিয়ে কোথাও রেখে গেছে। সন্ধ্যার পর ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ আসে নি। আজ সুযোগ পেলেই নিয়ে পিউ কে দেবে। রাগে মাথা দপদপ করছিল গৌরীর।
ঘরে ঢুকতেই চিঠি এক ছুটে গৌরীর কোলে। হাতে ওয়াটার বটল টা। গৌরী কিছু বুঝতে পারছিল না। হতভম্ব হয়ে চিঠিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ।এমন সময় অশোক বাথরুম থেকে বার হল।
---আরে মোবাইল টা দাও নি। আর শরীরটাও একটু ক্লান্ত লাগছিল ।তাই ফিরে এলাম। আর তোমরা না কি ওয়াটার বটল টা খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে যাচ্ছ। আরে ওটা তো আমি নিয়ে গেছিলাম। ভাবলাম অনেকটা পথ যাব, জল নিয়ে যাই। তোমাকে আর বলা হয় নি।
বুকের মধ্যে একটা কষ্ট জমাট বেঁধে যাচ্ছে। গৌরীর চোখে তখন একটা ছোট্ট মেয়ে
একটা ভাঙা চৌকি
একটা হাতল ভাঙা কড়াই।
::::::::::::::::::::::::
অনিন্দ্য পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
Mob: 9163812351
ধন্যবাদ।