মেহগনি সন্ধ্যা
নাসির ওয়াদেন
ছোট এক পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বাবলা গাছের শজারু ডালে সূর্যের আলো পড়ছে লম্বাকিরণে, আকাশের বুকে শাদা শাদা মেঘের ছানা করছে দৌড়াদৌড়ি, বয়ে চলেছে শান্ত প্রকৃতির ঠোঁটে স্নিগ্ধ সমীরণ । অদূরে ছোট নদীটির হৃদয়ে কলকল স্বরে বহে যাচ্ছে স্রোতধারা মা তটিনীর সন্ধানে, তখনই এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেল ছোট্ট টিলার উপর দিয়ে ।
শরতের শিউলি ভেজা সকাল আর স্নেহ মাখা কাশফুলের হিল্লোল দোলা দেয় মেহগনি পাতার হৃদয়ে । চারদিকে মৌ মৌ সুগন্ধির মোহময়তা, আরতি আর ঘণ্টার গন্ধ-শব্দে দশদিগন্ত মুখরিত । পাহাড়ের গায়ে পাথর ভেদ করে বহে যাওয়া ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর আবেগময় বহমান ঢেউয়ে, সদ্য যৌবনা নন্দিনীর পাপড়িমেলা বুক জোয়ার, জলোচ্ছ্বাসে ভেসে ওঠে । এক শান্ত সমুদ্র বক্ষে এক উদ্দাম লহরী আঘাত হেনে চলে যাওয়া সুদূরে, জীবনের সন্ধানে ।
নন্দিনীর ছোট্ট মনে শান্তির আলোগুলো ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যারতির মতো নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে মাঝেমধ্যে । ষোল পেরিয়ে সতেরোতে পা রেখেছে নন্দিনী । বাবা একজন দিনমজুর, কায়িক শ্রম দিয়ে চলে তাদের সংসার । জমিজমা বলতে কিছুই নেই , একমাত্র বাড়িখানা, মাথা গোঁজার ঠাঁই । একদিন সবকিছুই ছিল তার দাদুর,কিন্তু নেশা আর স্ফূর্তিতে সর্বস্বান্ত হন অবিনাশ - অবিনাশবাবু -- কদর ছিল গাঁয়ে, ছিল গাঁয়ের মাথা, সরপঞ্চ । হাঁক ডাক ছিল, ছেলে বউয়েরা তাঁর ছায়া মারাত না । ইয়া লম্বা গড়ন, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, গাঁয়ের গরীব-গেরস্ত সকলেই মান্নি করত । আজ জমিও নেই, সেই রাজত্বও নেই, শেষ যাত্রার আগে ক্ষয়রোগ জেঁকে বসেছিল । সে এক মর্মান্তিক ঘটনা, চোখের সামনে কাতরাতে কাতরাতে মরতে হয়েছিল অবিনাশকে। নন্দিনী নিজের চোখে দেখেছে সেই সব । এই তো সেদিনের কথা ।
নদীর জলে পা ডুবিয়ে নুড়ি পাথর খোঁজে নন্দিনী ।মেহগনি গাছের সাথে তার মিতালি । দুধে-আলতা পা দুটো জলে ডুবলে মনে হয় যেন পরির ডানা ভাসছে , রঙিন ছায়াময় সারা শরীর, রূপে গুণে পরিপূর্ণ । কুলু কুলু স্বরে বহে যায় ঈষিকা নদীর জল। নন্দিনী সেই কাঁচজলের উপর দিয়ে ছুটে যায়, খিলখিলিয়ে হাসে । ছোট রঙ বেরঙের মাছগুলো খেলা করে, তরতর করে এগিয়ে যায় স্রোতের উল্টো দিকে । নন্দিনী হাত পেতে ধরতে যায়, মাছেরা পালিয়ে যায়, চলে লুকোচুরি খেলা । নদীর বাঁকে অদূরে একটা অগ্নিবলাকা এক পায়ে শিকারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, নদীর ভাঙা পাড়ে কাশফুল হাওয়ায় দোলা দেয়, বনবিড়াল আড়াল আবডাল থেকে উঁকি মারে, সেও তো এক লুডোখেলা।
সূর্যের আলো ম্লান হয়ে আসে । আকাশে শিষ দিতে দিতে উড়ে যায় একঝাঁক বনটিয়া তার মাথার উপর । আমলকী আর হরীতকী গাছের ছায়া পড়ে স্বচ্ছজলের ভেতর, পাতা খসে পড়ে জলে টুপটাপ শব্দে, আকাশ পরিষ্কার -- মা আসছে --
আঠারো বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায় নন্দিনীর সহপাঠীদের। পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দাদের রীতি, নিয়ম এরকমই । মেয়ে একটু বড় হলেই বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠিয়ে বাবা-মা নিশ্বাস ফেলে ।এলাকায় ভাল ইস্কুল নেই পড়াশুনা করার, ওই সরকারি ইস্কুলে যা শিক্ষা, চতুর্থ কেলাস । শহরে পাঠিয়ে পড়ানোর সামর্থ্য নেই তার বাবার । অথচ নন্দিনী চেয়েছিল লেখাপড়া শিখে রোজগার করবে, জনগণের সেবা করবে। কিছু করতে না পারলেও, কিছু হতে না পারলেও স্বাদ ছিল নার্স হওয়ার । নার্স হয়ে তার মতো শত শত অসহায় দরিদ্র কন্যার সেবা করবে, সুস্থ করে তুলবে, তাদের সুন্দর জীবন উপহার দেবে। না, হয়নি তার ইচ্ছাপূরণ । বাবা তো কথা শুনতেই চায়নি --- দু গেলাস গিলে এসে রাতের বেলা তার মায়ের চুলের ঝুঁটি ধরে মারতে দেখেছে ।নিত্যদিন বাবা মায়ের ঝগড়া, ভাল লাগত না তার ।তাই সময় সুযোগ পেলেই দৌড়ে যেত সহৃদয়া জননী আমলকী বনে ।মেহগনির সুমিষ্ট গন্ধ তাকে শান্ত করে, আশ্বাস দেয়, সুখের সংসারের কথা বলে । সেই তো তার একমাত্র বাঁচার সাথী।
-- কী বলছিস, হারামজাদি, হামি মদ খেয়েছি? বেশ করেছি, আরো খাব ---
-- মরতে লারছো, বুড়োকালে ভিম্মি ধরেছে, ঘরে জোয়ান বিটি আছে ।
-- জুয়ান বিটি আছে তো কী হয়েছে? ওর বিহা দিং দিব --
-- বিহাটো তো দিবা, তো টাকাকড়ি আছে? ভাল বর পেতে টাকা লাগবে ।
-- ওই যি বাবুর বাগানে যারা কাজ করে, ওদের একজনের সাথে লটরপটর লাগাং দে, ব্যস, কাজ হুয়ে যাবে ।
-- ছি, ছি ! বাবা হুং তুমি ইসব কুকথা বুলছ, নজ্জা করে না?
-- হাঁ , হাঁ, নজ্জা! গরীবদের নজ্জা থাকতে নাই, তু জানিস না। গরীবরা হলো কীনা বড় নোকদের নোকর, খাস গুলাম ।
ভাঙা চালাঘরের কোণের আড়াল থেকে শুনতে পায় ইসব কথা নন্দিনী । সে বড় হয়েছে, ঘৃণায়, রাগে, অভিমানে ফুঁসে ওঠে । বিদ্রোহিনী ভুজঙ্গের মতো ফোঁসফোঁস করে । গজরাতে গজরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে, ছুটে আসে সঙ্গিনী মেহগনি গাছের কাছে, তার শীতল ছায়ায় বসে নিজের অদৃষ্টের কথা ভেবে অস্থির হয়ে ওঠে ।
সুজন লেখাপড়া শিখেছে শহরের ইস্কুলে । গাঁয়ের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সে । বাবার কিছু জমি জায়গা আর একটা আমবাগান আছে, সেই আয়ে চলে তাদের সংসার । ছুটি পেয়ে ফিরে এসেছে গাঁয়ে সুজন। লম্বা ছুটি. চারিদিকে ভাইরাসের ছড়াছড়ি, তাই ছুটি পেয়ে ফিরে আসে গাঁয়ে।
-- কী গো সুন্দরী! একা একা বসে কী ভাবছ এখানে?
হঠাৎই পুরুষ কণ্ঠে চমকে ওঠে নন্দিনী । সন্ধ্যার কাল ঘুটঘুটে অন্ধকারের আলোয় মুখখানি ভাল করে দেখতে পায়না, অনুভব করে এক যৌবনপুষ্ঠ যুবক তার সামনে দাঁড়িয়ে । লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়ায়, কে তুমি ?
-- আমি সুজন, সুজন গো! চিনতে লারছো, শহরে থাকি, বুধুনের ব্যাটা, সুজন সর্দার ।
লজ্জা পেয়ে নন্দিনী মুখ ঢাকে অন্ধকারে।
-- তা, তুমি এখানে? নোকে দেখলে কী বলবে!
-- তা, বলুক যার যা ইচ্ছে । আজ তুমাকে একা পেয়েছি, হামার মুনের কথা খুলি বুলতে চাই ।
-- কী কথা গো, হামার লজ্জা করছে । তুমি চলি যাও।
-- যামু, যামু, নিচ্চয় যামু । তবু যখুন পেয়েছি, হামার অনেকদিনের লুকোনো, জমানো কথাখান বুলি হামি চলি যামু, বুঝলে ---
-- লোকে কুকথা কইবে, তুমি চলি যাও, বুলছি। যাও ,,,
-- হামি তুমাকে ভালবাসি নন্দিনী । হামি তুমাকে শাদি করতে চাই ।
লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে নন্দিনী । দৌড়ে পালিয়ে যায় বাড়ির দিকে ।
সুজন বিহ্বল হয়ে পড়ে, ভয় পায় তার। ভাবে, বুঝি সে মহাঅন্যায় করে ফেলেছে। এবার যদি গাঁয়ের মোড়লকে সেকথা বলে দেয় নন্দিনী , তার গায়ের ছাল ছাড়িয়ে দেবে ।
নন্দিনী ছুটে যায় তাদের বেড়া ভাঙা, ছেঁড়া চালের ঘরের দিকে । আকাশে চাঁদ উঠেছে, সেই চাঁদের আলো এসে পড়ছে তার চিকন উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের উপর । ভাবে বিহ্বল হয়ে পড়ে সে, মরদ বুঝি এরকম প্রস্তাব দেয় ।
আমলকী বনে জোনাকির আলো ফুটে ওঠে । মেহগনি সন্ধ্যা শঙ্খধ্বনিতে ভেসে যায় । সারা আকাশ জুড়ে এক অন্য জগতের প্রতিবিম্ব দেখতে পায় নন্দিনী ।