ছোটগল্প || ভাত ঘুম || চন্দন চক্রবর্তী
ভাত ঘুম
চন্দন চক্রবর্তী
রমেনবাবু রিটায়ার করেছেন প্রায় ছ'মাস হয়ে গেল । মোটামুটি ভদ্রগোছের একটা চাকরি করতেন । মনটা ভেতরে নরম হলেও বাইরে একটু রাশভারী হওয়ার চেষ্টা করে থাকেন । তা অফিসে একটু প্রয়োজন ছিল বৈকি ! নইলে সিনিয়ারকে মানবে কেন !
এহেন রমেনবাবু দুপুরে ঘুম একদম বরদাস্ত করতে পারেন না । তা অফিস যত দিন ছিল, ছুটির দিনে খবরের কাগজ উল্টে সময় কাটিয়েছেন। ছেলেরা,মানে দুই ছেলে যখন ছোট ছিল,তাদেরও দুপুরে ছুটির দিন ঘুমতে দিতেন না । এখন দুই ছেলে লায়েক হয়েছে,বিয়ে করেছে। তাদের আর ছুটির দুপুরে পাচ্ছেন কোথায় ! তাদের যার যার বিয়ের পর বউ নিয়ে আলাদা ঘর।
রমেনবাবু যদিও মুখে পরিচিত সবাইকে দুপুরে ভাত ঘুমের অপকারিতা সম্পর্কে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তব্য শুনিয়ে থাকেন,কিন্তু ইদানিং নিজেই কেন কে জানে ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়ছেন ! খেয়ে উঠে কাগজটা নিয়ে বিছানায় বসতে না বসতে আজকাল চোখটা লেগে যাচ্ছে । কখন যে চোখটা বন্ধ হচ্ছে বুঝতেই পারছেন না । খারাপ যে লাগছে তাতো নয় ! বরং ভালোই লাগছে । কিন্তু মুশকিল হল স্ত্রীকে নিয়ে । বিকেলের চা টা ঘরে দিতে এসে ঘুমন্ত রমেনবাবুকে দেখে একটু আধটু টিপ্পনি ছুড়বেন । তাওতো এক জনের চোখ । সেও যাহোক এড়ানো যায় । কিন্তু ছুটির দিনে মাঝে মধ্যে বৌমারা চা দিতে এসে শশুরকে ঘুমাতে দেখলে সেও কি কম লজ্জার ! রাতে খাবার টেবিলে কথাটা উঠবেই আর স্ত্রী,ছেলেরা,মায় বৌমারাও মুচকি মুচকি হাসবে !
সেদিন ছিল রবিবার । রমেনবাবু খেয়ে দেয়ে দুপুরে আগেই বিছানায় । ছেলেরা,বৌমারা সবাই চাকুরে,এই ছুটির দিন ছাড়া কেউতো একসাথে হতে পারে না । তাই ওরা একটু বেলা করেই গল্প করতে করতে খায় ।
কখন বুঝি চোখটা লেগে গিয়েছিল,খবরের কাগজটা একপাশে রেখে একটু চোখটা বুঝেছেন,একটা মাছি খালি কপালে এসে বার বার বসছে । কি যে অস্বস্তি,তা আর বলার নয় । হাতটা দিয়ে যতবার মারতে গেলেন,নাগালের বাইরে । রাগে রমেনবাবু তখন ফুসছেন । অফিসের কেউ হলে তাকে তিনি এতক্ষনে বরখাস্ত করতেন । কিন্তু এখানে একটা খুদে প্রাণীর এত সাহস !
রমেনবাবু ছেলেবেলায় একটা গল্প পড়েছিলেন " এক রাজা দুপুরের ঘুমে মাছির উপদ্রবে একটা বাদরকে পাহারায় রাখলেন । দিন দুই ওটা পাহারাটা ভালোই দিল । রাজামশাই এই দুদিন নিশ্চিন্তে ঘুমলেন । তিন দিনের দিন একটা মাছি এমন উপদ্রব শুরু করলো যে বাদরটা রেগে গেলে । এইভাবে চলতে থাকলে রাজা মশাই জেগে যাবেন যে,আর ওর চাকরিটা যাবে ! শোয়ার সময় তরোয়ালটা পাশে রেখে রাজমশাইয়ের ঘুমানোর অভ্যাস । বাদরটা বারবার চেষ্টা করে শেষে এতই রেগে গিয়েছিল যে ও বাহ্যিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলল । তরোয়ালটা নিয়ে মাছিটাকে তাক করা শুরু করল । এক সময় মাছিটা রাজামশাইয়ের গলায় বসেছে আর বাদরটা তখন মেরেছে এক কোপ । রাজামশাই চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লেন । না এটা তো নীতিশিক্ষার গল্প !
খেলাটা চলতে চলতে বোধহয় মাছিটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল । তাই এক সময় খেলা ভঙ্গ হল । আর রামেনবাবুও চোখটা বুজলেন ।
রমেনবাবু শুয়ে পাশ ফিরলেন। আরে গায়ে কি যেন বিঁধছে ! সারা গায়ে এত গয়না,কানে পেল্লায় দুল,গলায় হার ! রমেনবাবু গোঁফ রাখেন না । কিন্তু এখন পেল্লায় গোঁফজোড়া গাল পর্যন্ত এসে খণ্ডত্তর আকার ধারণ করেছে । ঐতো মুকুটটা পাশে রাখা । এতক্ষণ ভালোই লাগছিল । হঠাৎ তারোয়ালটার কথা মনে পরায় রমেনবাবু আতঁকে উঠলেন । তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন ।
ঘাড় ঘুরিয়ে এবার যা ভাবছিলেন ঠিক তাই । ওইতো বাদরটা বসে আছে । হাতে তরোয়ালটা নিয়ে । এই সেরেছে যদি একটা কোপ গলায় বসায় ! ভাবতে ভাবতেই রমেনবাবু গলায় হাতটা বুলাতে যাবেন, আর বাদরটাও কোপটা বসিয়ে দিল । একটা জোরালো আর্তনাদ গলা থেকে বেরিয়েই মুন্ডুটা ছিটকে পরলো !
রমেনবাবু চোখ খুললেন । ঘরে সবাই উপস্থিত । ভাত ফেলে সব উঠে এসেছে ।
তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সহজ করতে রমেনবাবু একটু গলা চড়িয়ে দিলেন, "বিকেলের চা দেবার নাম নেই ? কি এত দেরি বুঝি না" ! ।
বড়ছেলে একটু হেসে বললো," সেকি কথা ! এইতো খেয়ে উঠলে । সবে তিনটে বাজে" ! ছোটছেলে, দুই বউ মা, তখন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে,আর ফিক ফিক হাসছে ।
ইশ ! কি লজ্জা কি লজ্জা ! খালি স্ত্রী বল্লেন,"কাল থেকে খেয়ে উঠে বাইরের ড্রইং রুমে খবরের কাগজ নিয়ে বসবে । এই ঘরে আমি তালা লাগিয়ে দেব"।
------------