ছোটগল্প-মুখোশ।। রনেশ রায়
মুখোশ
রনেশ রায়
করোনা লেগেছে। সবাই আতঙ্কিত। বিশেষ কেউ ঘর থেকে বেরোয় না । বয়স্করা তো একেবারেই নয়। বাঘে ছুলে আঠারো ঘা। করোনা ছুলে আটান্ন ঘা। কে না জানে? জানেন না শুধু প্রতীক বাবু। তিনি কিছুতেই মানেন না । মুখোশ পড়বেন না। বাড়ির লোক আতঙ্কিত বিরক্ত। হাজার বলেও হেল দোল নেই। কাকস্য পরিবেদনা। বয়স তো কম হলো না। হাজার বলেও কি করা যায়! ছেলে গোটা চারেক বাহারি মুখোশ এনে দিয়েছে। ওগুলো অব্যবহৃত পড়েই থাকে। বাড়ির আসে পাশের কেউ কিছু বলেন না। মানে বলতে ভয় পান। প্রতীক বাবু একটা ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলের নেতা। ক্ষমতাবান লোক। তবে এলাকায় জনপ্রিয় সন্দেহ নেই। খুবই অমায়িক। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক। তাই কিছুটা শ্রদ্ধায় কিছুটা ভয়ে কেউ কিছু বলতে ভরসা পায় না। সবাই মুখোশধারি শুধু প্রতীকবাবু নন। উনি নাকি স্পষ্টবাদী, উনি যা সেভাবেই থাকতে চান। কোন মুখোশ নয়।
প্রতীক বাবু বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকতে অভ্যস্ত নন । রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার দৌলতে তিনি জনগণের লোক। অফিসের পর যতটুকু সময় পান তা তাঁর সংগঠনের কাজ আর জনসেবার কাজে লাগে । পরিবারের জন্য সময় কোথায়? স্ত্রী আর ছেলে আছে। কিন্তু তার দায় সামান্য। স্ত্রী ঘর সামলান।স্বামীর সমাজের পরিচয়ের ব্যাপারটা তাঁর কাছে গর্বের। সেটা তাকে একটা বাড়তি দম দেয় যার জন্য একা হাতে ঘর সামলানোর থেকে যাবতীয় ঝামেলা স্বেচ্ছায় তিনি মেনে নেন। তবে করোনার আবির্ভাব আর তার জন্য ঘর বন্দী তার জীবনে একটা উপরি পাওনার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রতীক বাবুকে বাড়িতে পান। আফিস বেশি যেতে হয় না। আর পাড়াও তো যেন শ্মশান হয়ে গেছে। ভয়ে সবাই বাড়িতে সিটকে।সেটা তাঁর কম পাওনা নয়। কিন্তু প্রতীক বাবুর কাছে এই ঘরবন্দী দশাটা একটা ভয়ানক বন্দী দশা। রাজনীতির কল্যাণে তিনি কিছুদিন জেলবন্দী ছিলেন। সেটাও যেন এত দমবন্ধ হওয়া বন্দী দশা নয়। এই অবস্থায় হাসিখুশি এই মানুষটা যেন কেমন খিট খিটে হয়ে যাচ্ছেন । ঘরে স্ত্রীকে বেশিক্ষণ পেযে যেন জীবনে যতটুকু রোমান্স ছিল তাও উবে যাওয়ার উপক্রম । কি আর করেন এটা আজ মেনে নিতেই হয়। তাও ফ্ল্যাটের অন্যান্যদের থেকে তিনি বেশি বের হন। কিন্তু কিছুতেই পরিবর্তিত এই অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। কবে যে করোনা বিদায় নেবে তাই ভাবেন। প্রতীক বাবুর স্ত্রীর কাছে এটা খুব বেদনাদায়ক। বিশেষ করে যখন দেখেন পাশের ফ্ল্যাটের পরিবারগুলো কি সুন্দর এই বিশেষ অবস্থায় বউ ছেলে মে নিয়ে আনন্দ ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছে। আর ওদের ছেলে তো সারাদিন মোবাইল কম্পিউটার নিয়ে অফিসের কাজ করছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম এর নামে কাজ বেড়ে গেছে । অথচ কোম্পানি ৭০ শতাংশ মাইনে দেবে বলেছে। চাকরি থাকবে কি না সেই ভয়ে ছেলের দিন কাটে।
করোনার আক্রমণ বেড়ে চলেছে। ধারে কাছে সে এসে গেছে। সরকারী নির্দেশে মুখোশ বাধ্যতা মূলক। তাও প্রতীকবাবু অচঞ্চল। উনি মুখোশহীন মানুষ। কারো ধার ধারেন না। এরই মধ্যে এক আধবার দোকানে যান। সেখানে উনাকে চেনে না এমন দুচারজন মুখোশ কই জানতে চাইলে উনি বলেন উনি মুখোশহীন মানুষ। আর এর উত্তর যাকে তাকে দিতে বাধ্য নন।
বাড়িতে ইদানিং সবার সঙ্গে ঝামেলা। এদিকে সরকারি কড়াকড়ি বেড়েছে। জারি হয়েছে আদেশ মুখোশ না পড়লে জরিমানা বা জেল। প্রতীকবাবুর ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁর দল থেকেও এটা সবাইকে মানতে বলছে। সবাই মানছেও l কিন্তু প্রতীক বাবু ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। কিসের জোরে তার এত বুকের পাটা? সবাই অবাক হয়। অনেকে ভাবে লোকটার সাহস আছে। না রোগ না পুলিশ কাউকে ভয় করে না।
প্রতীক বাবু রাস্তায় বেরিয়েছেন। লোকজন বেশি নেই। যা দুচারজন তাঁরা সংক্রমণের ভয়ে প্রতীকবাবুকে এড়িয়ে চলেন। প্রশস্ত রাস্তা ধরে নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে প্রতীকবাবু চলছেন।পেছনে কুত্তা করে ফুকার, তাতে প্রতীকবাবুর কোন দিন কিছু আসে যায় না। কিন্তু হঠাৎ এক জ্বালা। মোটরসাইকেলে দুজন এসে প্রতীকবাবুকে জেরা শুরু করে। প্রতীক বাবু বোঝেন এরা কারা। কেন মুখে মুখোশ নেই? প্রশ্ন ছুটে আসে। সাধারণত থানার বড় বাবুও প্রতীক বাবুকে এভাবে চ্যালেঞ্জ করে না। কিন্তু আজ যেখানে সরকারের ঢালাই আদেশ সেখানে এই চুনোপুটিদেরও যে কিছু সাহস দেখাবার লাইসেন্স জোটে সেটা প্রতীকবাবু বোঝেন। তারাও যে প্রতীকবাবুকে চেনে না তা নয়। তবে আজ ওপরওয়ালার কড়া নির্দেশ। প্রতীকবাবু বলেন, "আপনারা অন্ধ দেখেন না। মুখোশ আছে।" পুলিশ বলে, "তবে পড়েন নি কেন?" প্রতীকবাবু বলেন, " চলুন আপনাদের বসকে আমি এর উত্তর দেব।" পুলিশ ঘাবড়ে যায়। এ প্রভাবশালী লোক। কি দরকার। চলুক বড় বাবুর সঙ্গে বুঝে নেবেন। পুলিশ বাইকে করে প্রতীকবাবুকে থানায় নিয়ে যায়।
থানায় প্রতীকবাবুকে বড়বাবু আহবান জানান। জানতে চান কি হয়েছে। অর্ধস্তন পুলিশরা বলে উনি মুখোশ পরেন নি । আমরা পরতে বললে উনি বলেন উনি পরেই আছেন। এ ব্যাপারে আপনাকে যা বলার বলবেন। আমাদের সংগে তাই নিয়ে এসেছি। বড় বাবু বলেন: " প্রতীক বাবু কি ঠাট্টা ইয়ার্কি করছেন? জানেন না আপনাদের পার্টির এটা নির্দ্দেশ। তারাই তো ক্ষমতায়। আমাদের কি করার?" প্রতীক বাবু নিরুত্তাপ। বলেন: " ওরা না হয় দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু আমাকে চিনেও আপনি চিনছেন না। পার্টির আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে আমি মুখোশ পরেই আছি।" বড়বাবু বিচলিত হন। বলেন, " হেঁয়ালি ছাড়ুন। আসল কথা বলুন।" প্রতীকবাবুর আবার একদফা হাসি। বলেন, "আমি যে মুখোশ পরেই আছি। ভালোভাবে দেখুন।"
বড়বাবু বলেন "সেই মুখোশের কথা বলছি না। করোনা মুখোশ, মানুষের মুখোশ নয়"।
"ও তাই বলুন! চিনতে একটু দেরি হলো ! তবে তো আমার এ মুখোশটা খুলতে হয়। দুটো মুখোশের ভার সইতে পারব না। এটা খুলে যে শেয়ালের মুখের করোনা মুখোশ পড়তে হয়। সেটা পাব কোথায়? সেটা তো বাজারে নেই। মানুষের মুখের করোনা মুখোশ তো আমার ছেলে বেশ কয়েকটা এনে দিয়েছে। জানেন তো আমাদের করে খেতে হয়। এই মুখোশ খুললে খাব কি? আর আপনারাই বা কি খাবেন।" বলেন প্রতীক বাবু। সত্যিই তো বড়বাবু বড় চিন্তায় পড়েন।