গল্প।। নীলকণ্ঠ গাছ ।। অঞ্জনা দেব রায়
নীলকণ্ঠ গাছ
অঞ্জনা দেব রায়
বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে বসে টিকুরানি । বিকেল সাড়ে চারটে বাজে । বারান্দায় টবে বেলফুলের গাছে প্রচুর বেলফুল ফুটেছে । বেলফুলের গন্ধে বারান্দা ভরে আছে । বড় ভাল লাগে টিকুরানির ।
স্বামীর ছোট্ট ফ্ল্যাট । সামনের রাস্তায় দিনরাত গাড়ি , রিক্স, মানুষের যাতায়াত। টিকুরানির বয়েস হয়েছে,
পায়ে ও কোমরের ব্যাথাটা বেড়েছে । ছেলে ডাক্তার বিদেশে থাকে ।মেয়ে স্কুলটিচার কাছেই থাকে ।
টিকুরানির বড্ড মায়া এবং সবাইকে খুব ভালবাসেন । বাবা মায়ের আদরে মানুষ সে ।বাবার কাছে পড়তে আসা অভিরুপদাকে খুব ভালো লাগত তার । কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তেই লিকলিকে চেহারার মানুষটিকেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল সেদিন ।
তবে টিকুরানি ঠকেন নি । বড় ভালমানুষ অলোক । মুখ ফুটে কিছু না বললেও অলোকের আসকারা আছে টিকুরানির সব বিষয়ে । বিয়ের পরপরই মেঘালয়ের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে । সাদা মেঘগুলো কেমন রাস্তায় ও বাড়িতে নেমে আসত । চেরাপুঞ্জির রাস্তার সৌন্দর্য ও শিলং এর সারা রাস্তায় নানা রঙের ফুল দিয়ে সাজানো অপূর্ব দৃশ্য। এই সব বসে বসে মনে করে । বাড়ির সবাই ব্যস্ত। কারোর কথা বলার সময় নেই টিকুরানির সাথে । ছেলে প্রতিদিন একবার করে ফোন করে কথা বলে আর বছরে একবার করে বাড়ি আসে । মেয়ে স্কুলে চাকরি করে ও টিউশন করে সময় পায় না । অলোক নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে । শুধু রাতে খাবার সময় কিছু কথা হয় ।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে । টিকুরানি সন্ধ্যে দিয়ে চা খেয়ে রাতের খাবার তৈরি করে নিলো । রাত সাড়ে দশটায়
খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরে সবাই । কিন্তু টিকুরানির মাঝরাতে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যায় । আর বসে বসে
মেঘালয়ের দিনগুলির কথা মনে করে । আলোক অফিস থেকে এসে কত গল্প করত। গল্প শুনতে আর গান করতে ভাল লাগত টিকুর । কলকাতায় এসে গল্প করা তো দূরে থাক কথা বলারও সময় কমে গেছে। কিন্তু কাজের ফাঁকে বাড়ির সব দায়িত্বই পালন করত অলোক। তাই অলোককে একটা বিরাট ছাতার মত বলে মনে হয় টিকুর, যার ছায়ায় নিশ্চিন্তে থাকা যায় ।
টিকুর ফুল গাছের প্রতি ভালবাসা ছিল , এ বছর রথের মেলা থেকে একটা নীলকণ্ঠ গাছ কিনে এনে ড্রয়িং
রুমের সামনের বারান্দায় টবের মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল । বন্ধুর কাছ থেকে টিকু শুনেছিল নীলকণ্ঠ ফুল
ঘরের জন্য শুভ । তারপর থেকে টিকু নীলকণ্ঠ গাছটিকে সন্তান সুলভ যত্ন করত । শার, চাপাতা দিয়ে,
জল দিয়ে যত্ন করত । প্রতিদিন সকালে গাছটিতে জল দিয়ে তাতে হাত বুলিয়ে দিত, তার সঙ্গে কথা বলত।
এক মাস বাদে যখন প্রথম নীলকণ্ঠ গাছে ফুল ফুটল তখন টিকুরানির খুব আনন্দ হল আর দিদি,দাদা ও
বন্ধুদে্র কে ফটো তুলে পাঠিয়ে দিল । নীলকণ্ঠ গাছটি আস্তে আস্তে টিকুর সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠল ।
কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসে গাছটিকে ।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে আসে , টিকু বারান্দা ছেড়ে ঘরে এসে হাত পা ধুয়ে ঠাকুরঘরে সন্ধেআরতি করে তারপর একটু টিভিতে খবর শোনে কখনও সিরিয়াল দেখে । সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে মেয়ে দিতিপ্রিয়া বাড়িএসে ফ্রেস হয়ে চা খেতে খেতে টিকুর সাথে কিছু কথা বলে নিজের কাজে চলে যায়। অলোক বাঙ্কে চাকরি করত , দু বছর হোল অবসর হয়েছে , তবে অলোক গান গাইতে খুব ভালোবাসে। , যখন অফিসে যেত তখনো অফিস থেকে ফিরে এসে গান নিয়ে বসত । রবীন্দ্রসঙ্গীত , নজরুলগীতি , আধুনিক সব রকমের গান ও চর্চা করত।
মাঝে মাঝে ছোট ঘরোয়া প্রোগ্রামও করত ।
ফলে অফিস থেকে অবসর হওয়ার পর বিকেল হলেই গানের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় ,আর রাত আটটায় ঘরে এসে এক কাপ চা খেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে গান করতে বসে যায় ।মাঝে মধ্যে খুব রাগ হয় টিকুর।
রাগ হলেই টিকু আলোকের উপর অভিমান করে নীলকণ্ঠ গাছ টার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে একা-একা কথা বলে ।
প্রতিদিন ভোর ছটায় উঠে পড়ে টিকু ।এটা টিকুর বহুদিনের অভ্যেস । সকালবেলাতে মিষ্টি সব ফুলের গন্ধ খুব ভাল লাগে তার । ছাদে চলে যায় , সেখানে তার অনেক ফুল গাছ যেমন নানা রঙের জবা , শিউলি, বেলফুল, গাঁদা ফুল গন্ধরাজ আছে । এসব গাছে অবশ্য আলোক জল ও সার দিয়ে যত্ন করে। ছাদে কাক, শালিক, চড়ুই , বুলবুলি , ঘুঘু প্রচুর পাখি আসে , তাদের প্রতিদিন টিকু বিস্কুট ও মুরি খেতে দেয় , আবার বাটি করে জল ও দেয় টিকু । ডাক্তার টিকুরানি কে হাটতে বলেছেন । হাঁটুর ব্যথার জন্য বাইরে যেতে পারে না , তাই টিকু ছাদেই কিছুক্ষণ হেটে ঘরে চলে আসে। তারপর কিছুক্ষণ বারান্দায় নীলকণ্ঠ গাছের কাছে দাড়ায়, বাতাসে নীলকণ্ঠের গাছটা মাথা নাড়িয়ে দুলতে থাকে । তাই দেখে টিকু খুব খুশি হয় ।
কাঞ্চন আসতে দশটা বেজে যায় । বাসন মাজে , কাপড় কাচে , ঘর মোছে এইরম কিছু কাজ করে কাঞ্চন টিকুরানিকে সাহায্য করে । কাঞ্চন কাজ করে আর নানা বাড়ির নানারকমের গল্প বলতে থাকে কিন্তু টিকু অনেক কথাই মন দিয়ে না শুনে নিজের ভাবনায় ডুবে যায় ।
কিছুক্ষণ ধরে ফোনটা বেজে চলেছে আস্তে আস্তে এসে টিকু ফোন টা ধরে । ছেলে অভিনন্দন ফোন করে বউমা অরিপ্রিয়ার কাছে দিল । অরিপ্রিয়া প্রতিদিন শাশুড়ির খবর নেয় ওষুধ ঠিকমত খেয়েছে কিনা জানতে চায় । টিকুর বড় ভাল লাগে বউমা অরিপ্রিয়া কে , বড় ভাল মেয়ে ।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল টিকুর সকাল থেকে নীলকণ্ঠ গাছটায় জল দেওয়া হয়নি । নতুন নতুন ডাল ও পাতা
বেরিয়েছে , টিকু নীলকণ্ঠ গাছটিকে লাঠির সাথে বেধে দিয়েছে, ফলে লতিয়ে লতিয়ে অনেক দূর উঠেছে ।তিনটি ফুল একসাথে ফুটেছে দেখে আনন্দে ভরে যায় টিকুর মন ।
কাঞ্চন কাজ সেরে কিসব বলতে বলতে চলে গেল । টিকুরানি আজকাল একটু কানে কম শোনে আলোক ডাক্তার দেখাতে বলেছে , কিন্তু টিকুরানী পাত্তা দেয়নি ।
টিকুরানি দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় একটু গড়িয়ে নেয় , কিন্তু ঘূম আসেনা যখন, তখনই নীলকণ্ঠ
গাছটার কাছে দাড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে পুরনো কথা ভাবতে থাকে । অলোকের হাত ধরে পার্কে বেড়ানো , সিনেমা দেখা , কত জায়গায় ঘুরতে যাওয়া , এইসব আর কি ।
এখন ছেলে মেয়েরা বড়ো হয়ে গেছে, নিজেদের ও বয়স হয়ে গেছে । অলোক আর আগের মতো কোথাও নিয়ে যেতে চায়না , নিজের মতো গানের মধ্যে ডুবে থাকে ।
পরদিন টিকুরানীর ঘুম ভাঙে অনেক দেরি করে , এত বেলা করে কোন দিন ওঠেনা । রাতে হাতের যন্ত্রনা
একটু বেশিই হয়ে ছিল , শরীরটাও ভাল লাগছিল না, সকালে উঠে চা খেয়ে প্রেসারের ওষুধটা খেয়ে নেয়।
এসময় অলোক এসে বলে টিকু চল বারান্দায় দেখবে এসো তোমার নীলকণ্ঠ গাছটাকে। টিকু গিয়ে দেখে
গাছটিতে কোন পাতা দেখা যাচ্ছেনা , সারা গাছটা নীল হয়ে আছে। টিকু আনন্দে হেসে উঠল। অলোক এসে টিকুর হাতটা ধরে জড়িয়ে ধরলো, টিকু অলোকের বুকের উপর মাথা রেখে কিছুক্ষণের জন্য পুরনো দিনে ফিরে গেল ।
-------------
লেখিকা – অঞ্জনা দেব রায়
ঠিকানা – ৫৫৩ পি মজুমদার রোড , কলকাতা – ৭৮ , তারিখ – ১৬/ ৯/ ২০২০