ছোটগল্প ।। বাতাসী ।। বিশ্বনাথ প্রামাণিক
বাতাসী
বিশ্বনাথ প্রামাণিক
গায়ের জোরে টেনে টুনে জোর করে যখন নামানো গেল তখনো সে ভাবেনি এ কি রকম গেরোয় সে পড়ল! মেলাই লোকজন চারদিক যেন একেবারে গিজগিজ করছে। সারা ইস্টিশান জুড়ে একেবারে মেলা বসেছে যেন। তবু কেউ তার দিকে চেয়েও দেখে না। সবাই কেমন যেন বোবা মানুষটির মত পাশকাটিয়ে চলে যাচ্ছে দেখো! মানুষ গুলো সব যেন কেমন!
মধ্য বয়সের রোগা
পাতলা চেহারার বাতাসী তার সরু সরু কালো দুটো হাত শক্ত করে বারকয়েক টানাটানি করে নাড়ানোর
চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ খুঁজে বেড়চ্ছে। ঠিক তার মতো মানুষ-
যাকে সে ভরসা করে বলতে পারবে-
''একটু ধর না বাবা, বোঝাটা একটু মাথায় তুলে নিই।''
না
কাউকে তার মনে ধরে না। সবাই তো আর তার মতো নয়। পচার মা তাকে সাবধান করে পই পই করে বলে
দিয়েছে-
'' শওরে যাচ্ছিস, বেবসা বানিজে, তা সে ভালো কতা। যা, কিন্তু দেখিস দুম করে অনোথ
বাদিয়ে বসিস নি আবার, নোকজন সামলে বুজে চলিস হারানের মা।''
কিসে যে অনোথ, আর কিসে যে তা নয়- বাতাসি এখনো তা বুঝে উঠতে পারল না। হ্যাঁ, তা পেরায় সাত সাতদিন সে রোজ ভোরের টেরেনে কলকেতায় আসচে যাছে, তেমন বিপতি হলে সে কি দেখতে পেত নে? পচার মায়ের শুধু ভয় দেখানো কতা বাতা। টেরেনের লোক গুলো কি ভাল! বলতে হয় না গো, কেমন ধারা নিজেরাই টেনে টুনে তুলে নেয়, নেইমে দেয়। তুমি শুধু মাত্তর মাথা থেকে নেইমে বগির মুখে ফেলো, আর কোন দায় নেই কো। সব ওরা ঠিক করে নেবে।
পেথম পেথম বাতাসীও
যে ভয় পেত না তা নয়, নিজের বোঝা নিজে আগলে আগলে রাখতে চাইত সে। কিন্তু বোঝা কি আর একটা আধটা! একা মেয়ে মানুষের
পক্ষে সে সব টানাহেঁচড়া করা কি সম্ভব!
তার টানা টানি
করা দেখে লোক গুলো হেসে বলবে,'' মাসি তুমি চুপটি করে ও ধারে গিয়ে বসো, হাওয়া খাও। তুমি
যদি হাত লাগাবে তবে আমরা আছি কি কত্তে?’’ অথচ
যত বেপত্তি এই শেয়ালদায়। টেরেন থেকে নেইমে দে ওরা তো খালাস। এতো যে করে, এই তো অনেক।
রোজ রোজ তার বোঝা তুলে দেবে, নেইমে দেবে, আবার তার ঘাড়েও তুলে দেবে, তা পরের নোকে এত
করবে কেন? ওদের ও তো বোঝাই মাল পত্তর আছে নাকি!
এত কি আর তার সামরথে কুলায়? তাও যদি ছেলেটা তার ভালো হত! ঐ তো একহারা রোগাপেনা ছেলে, তার আবার বাঁ পা টা টেনে টেনে হাঁটে। অরে আর কি বলবে সে? ওর বাপ বেঁচে থাকলে কি আর তার এই বয়সে এই কাজ করতে হত?
বাতাসী গেরাম থেকে বেলপাতা, কলাপাতা, আমপাতা, দুব্বোঘাস, এমন কি কলাগাছের ছোটো চারা নিয়ে পুজোর সময় কলকাতায় আসে। পচার মা তাকে নিয়ে কদিন এসেছিল, সেই তো পথ দেখিয়েছে। তার কাছে সে চির কিতগো। তা মিছে কথা বল্বুনি, বিকিরি হয় বেশ ভালো দামেই। তার পর ধরো এ সব কিনতে তো আর পয়সা লাগে না। রাস্থার ধারের গাছ থেকে আড়কুশি নিয়ে পেড়ে দেয় ছেলেটা। সকাল থেকে দুই মায়-পোয় বড় একটা বস্তা নিয়ে জোগাড় করে সব। শুধু কলা গাছের চারাটা নুইকে নুইকে কাটতে হয় তাদের, দেখে ফেললে কেউ কি আর নিতে দেবে?
তাও সে বলেছিল, ওসব কলাগাছ না হয় থাক বাপ, নোকের জিনিস, জানতে পারলে অনোথ বাঁধাবে। তা ছেলেটা বলে- এক একটা চারা কুড়ি- তিরিশ টাকা দামে বিকিরি হয়, তা একটা গাছে তো আর হয় না, চার-চারটে লাগে এক একটা পূজোয়। মুহুরতে বিকিরি হয়ে যায়। সেবারে দুগাপুজোর দিন শুধু এই চারা বিকিরি করে সে পাঁচশ টাকা আয় করেছিল। সে কি কম কতা! তার মতো ভিকিরি মানসের পক্ষে এ নোভ সামলানো কি চাডিখানেক কতা!
বোঝাটা সেই থেকে একটু বড় হয়ে গেল। তা এখন যখন গতর আছে করে নাও, বুড়ো হলে কি আর পারবে?
রোগা কালো চেহারার বাতাসি বড় বড় চোখ মেলে স্টেশনের লোকগুলোকে দেখতে থাকে। কেউ একজন একটু সদয় হয়ে বোঝাখানা মাথায় তুলে দিলে সে ইস্টিশনের বাইরে গিয়ে বাজারের মুখটাই বসতে পারে। এই একটা বোঝার জন্য তার মত গরিবের পক্ষে কি কুলি ডাকা মানায়? এই গাছ গাছালি,পাতার বোঝা নিয়ে যেতে যে দাম হাঁকবে তাতে তাদের দুই মায়পোর একদিনের খোরাকি হয়ে যাবে।
-‘এই
সরাও,
সরাও ...'
দু চাকার ঠেলা গাড়িটা সামনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে ভেন্ডারের মুখে লাগিয়ে মাঝবয়সী মাড়োয়ারি লোকটি চিৎকার করে ওঠে-'' হটিয়ে যাও, দরোজার মুখ সে সরিয়ে যাও''
হকচকিয়ে বাতাসি বলে ওঠে, ' কোথায় সরাবো? দেখতে পাচ্ছ না একা মেয়ে মানুষ।’
-‘একা মেয়ে মানুষ!’ -দাঁত বের করে হাসতে হাসতে লোকটা বলে– “একা মেয়ে মানুষ, তো কলকাতায় বেওসা করতে আসা কেন?’’
-''ব্যবসা না করলে তুই খাওয়াবি? হতছারা মিনসে? ”
না, মনের মধ্যে আসা কথাগুলো বলতে পারে না বাতাসী। নিজেকে সামলে নিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে সে। একে চটালে চলবে না বুঝে নিয়ে সে বলে,''কি করব বাবা? গরীব মানুষ, খেটে না খেলে চলবে কেন? তা বাবা বোঝাটা একটু ধরো না, মাথায় তুলে নিয়ে চলে যাই।''
-‘দশ
টাকা
লাগবে
কিন্তু-----
''-বাবা দশ টাকা!'' বাতাসি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। একটু হাত লাগিয়ে তুলে দেবে তার জন্য আবার টাকা? টাকা ছাড়া কি এখানে মানুষ কিছু বোঝে না?
বেলা বাড়তে থাকে। সে ভোর ভোর এসেছিল, যাতে তাড়াতাড়ি বিক্রিবাটা সেরে আবার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারে। এখন পূজা-পাব্বনের দিন। এ কটা নিয়ে বসতে পারলে তাড়াতাড়ি বিকিরি হয়ে যেত। তা নিয়ে যাওযাই এক সমস্যা হল দেখছি। তা আর বিকিরি করব কখন? মনে মনে কথা গুলো বলে যায় বাতাসি। সে আবারও চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে।
ঐ তো একটা লোক তার মতো বোঝা নিয়ে দেইড়ে আছে। বাতাসী মনে মনে ভাবে, ওর বোঝাটা তুলে দিলে ও আমারটাও তুলে দিতে পারতো! কিন্তু ও তো চলে যাবে, তারপর! তার জন্য কি আর ফিরবে? তাছাড়া এ সময় বোঝা ছেড়ে গেলে বেপদ আছে। কে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে! তুমি সরে যাও আর অমনি এসে বলবে, এই হাত দিচ্ছ কেন আমার বোঝায়? জোর করে টেনে নিয়ে যাবে। তারপর হয়ত বলবে- তোর জিনিস? দেখেছিস?
লোকের সঙ্গে মারামারি, গালাগালি করে ঝকড়া করতে পারবে না সে।
দেখি আর একটু। আস্তে আস্তে ইস্টিশান খানা পেরায় ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে। যারা মাল পত্তর নিয়ে এসেছিল তাদের বেশিরভাগই চলে যায়। ওর মত অসহায় দু' চার জন লোক জন দেইড়ে আছে এখনো, যেন মরা আগলে বসে থাকা। কিন্তু কেউ কারো জন্য এগিয়ে আসে না। বাতাসি পরনের কাপড়টা কোমরের উপর শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। যেমন করে পারে এবার তাকে ব্যবস্থা করতেই হবে। এরপর দেরি হলে আর যে দাম পাওয়া যাবে না, তা সে এ কদিনে বেশ বুঝে গিয়েছে। আর একটা টেরেন আসার আগেই তাকে বাজারে গিয়ে বসতে হবে। এখন যত টেরেন আসবে তত মেয়ে, বউ, শাউড়ি, ফুল, পাতা-নাতা নিয়ে একেবারে ইস্টিসান ভরে যাবে। তারপর বসার জায়গা নে না আবার মারামারি করতে হয়!
সে মরিয়া হয়ে এবার ডাক দেয়, ‘ বাবু, ও বাবু একটু ধরো না বাবু। একটু হাত নেইগে মাথায় তুলে দাও না গো।’
না কেউ তার কথায় কর্ণপাত করে না। সেও হাল ছাড়ে না। সমানে ডাক দিয়ে যেতে থাকে। নিচয় কেউ না কেউ তার কথায় কান দেবে। ঠিক এই সময় ঘটে গেল বিপত্তিটা।
বলা নেই কওয়া নেই কোথা থেকে এক পাগল এসে তার সামনে দাঁড়ায়ে দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে থাকে। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, এলোমেলো ছেঁড়া খোঁড়া পোশাক পরিহিত পাগল লোকটি এসে হাত পাতে-' একটা পয়সা দিবি?’
বাতাসি তাকে দেখে। আবারো লোকটা হাসে-'' কিরে একটা পয়সা দিবি?’’
বাতাসি ভয় পেয়ে যায়। সে বলে- যা যা। একে আমি মরতিচি আমার জ্বালায়। আমাকে আর জ্বালাস না বাপু।
আবার সেই কাতর আবেদন- ‘দে না, কত দিন খাইনি’
বাতাসির কি দয়া হয়?
কি
জানি,
কি
মনে
করে
আঁচল
খুলে একটা দশ
টাকার
নোট
ও কটা খুচরো পয়সা
বের
হয়।
খুচরো
পয়সা
গুলো সরিয়ে রেখে দশ টাকার নোটটা তার হাতে
দিয়ে
বলে, ''যাও
বাবা, এবার খেয়ে এস।''
নোটটা উল্টে পাল্টে দেখে পাগল অবাক হয়ে চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। তারপর হা হা করে হেসে পালিয়ে যায় একদৌড়ে। যাওয়ার পথে চিৎকার করে করে বলে, পাগল,পাগল, টেকা চেনে না, হি হি হি …
দূর থেকে কথা গুলো ভেসে আসতে থাকে তার কানে। সত্যিই সে বোকা। মানুষ চিনতে তার এখনো অনেক বাকি।
এর কিছু পরে ঘটে যায় সেই ঘটনা, যা তাকে একেবারে অবাক করে দেয়। লোকটির সঙ্গে আরো চার-পাঁচ জন ময়লা ছেঁড়া ন্যাকরা পরা, তার চারদিকে এসে ঘিরে দাঁড়ায়। ভয় পেয়ে বাতাসী চিৎকার করে উঠবার আগেই তারা দাঁত বের করে হাসতে থাকে।
বাতাসি বলে-'' এত টাকা তো আমার কাছে নেই বাবারা। আমি যে গরিব মানুষ, এই বোঝাটা বিকিরি করতে পারলে তাও না হয় দুটো পয়সা পেতুম। এখন দেখছি এটা নে যাওয়াই মুশকিল হল।''
কি মনে করে হাসতে হাসতে ময়লা ছেঁড়া ন্যাকরা পরা লোক গুলো তার বোঝাটা ধরে টানাটানি করে নিয়ে যেতে থাকে স্টেশনের বাইরে, ঠিক বাজারের মুখটায়।
হতচকিত বাতাসি ওদের পিছু পিছু যেতে থাকে। ভয়ে, বিস্ময়ে আর কৃতজ্ঞতায় তার দুচোখ জলে ভরে যায়।
আর ঠিক তখনি ফিরতি ট্রেনের আওয়াজে ওদের হাসি চাপা পড়ে যায়।
------------
১৬/১১/২০২০
সোনারপুর।