অন্য মন (তৃতীয় পর্ব)
সুপ্তা আঢ্য
আচম্বিতে সৌমাল্য কেবিনে এসে ফুলগুলো দেখে উৎফুল্লের সাথে বলল "এই হলদে ঝাড়বাতিগুলো কোথায় পেলে নন্দিনীদি? অসাধারণ - - - - ।"
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নন্দিনী বলল "হ্যাঁ, ফুলগুলো সত্যিই সুন্দর। এর নাম - - -"
"অমলতাস" নন্দিনী কিছু বলার আগেই রৌনক আধখোলা দরজার ওপাশ থেকে বলে উঠল।
" তুমি জানলে কি করে?"
"ভুলে যাও কেন - - - আমার ডালপালাগুলো প্রসারিত হতে হতে এখানে এলেও শিকড়টা এখনও গ্রামেই রয়ে গেছে। তাই অমলতাস চিনতে একটুও সময় লাগে নি আমার।"
অমলতাস নিয়ে আলোচনা অফিস টেবিলে ঝড় তোলার আগেই বড়সাহেব মিঃ মুখার্জি এসে বললেন "নন্দিনী - - - - - আরে সৌমাল্য, তোমরাও আছ? ভালোই হল। ওকে, রৌনক - - তুমি বাকীদের এখানেই ডেকে নাও---কিছু ডিসকাসন আছে তোমাদের সাথে। "
মিঃ মুখার্জির ছোট্ট আলোচনা শেষ হতে দুটো বাজলোই। ফোনটা হাতে নিয়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়া আশাটাকে নতুন করে খুঁজতে গিয়ে দেখল" নাকছাবিটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে। "
তিতাসকে ফোন করলেও ওর রিনরিনে মিষ্টি গলার কিচিরমিচির নন্দিনীকে আজ স্পর্শই করল না। অভির জীবনে নিজের অস্তিত্বের ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে আবার নতুন করে ঠিকানাবিহীন হলো ও। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস অশ্রুধারা হয়ে কাজলকালো চোখ বেয়ে ওর কপোল, চিবুক, কণ্ঠদেশ ভিজিয়ে বক্ষস্হিত হৃদয় সাগরে দুঃখ হয়ে মিশে গেল আবার।
কাল থেকে ইচ্ছে করেই নন্দিনীর সাথে একটা কথাও বলেনি অভি। তবে দুপুর গড়িয়ে যেতে ওর কোনো ফোন না আসায় একটু চিন্তিত হয়ে নন্দিনীর নাম্বারটা ডায়াল করতেই রেকর্ডিং-এ থাকা মহিলা কণ্ঠটি বিনীতভাবে ফোন বন্ধের খবর জানিয়ে নিশ্চিন্ত করতে চাইলেও অভির মনের অনিশ্চয়তাটা দ্বিগুণ হয়ে গেল।
তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে অচেনা বন্ধুর মেঘপরী নন্দিনী তার সহচরী বৃষ্টিদের হাত ধরে গন্তব্যহীন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।বৃষ্টিস্নাত হয়ে মনের সব বিষণ্ণতাকে ধুয়ে ফেলে আজ গ্লানিমুক্ত হতে চাইছিল ওর সমগ্র সত্ত্বা।
"বৌদি, আজ তো বৃষ্টিতে তিতাস আসেনি খেলতে। অনেকটা সন্ধ্যে হয়ে গেছে - - - বাড়ি যাবেন না?" চেনা কণ্ঠস্বরে চারিদিকে তাকাতেই দেখল ও বাড়ির পাশে পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। এত মনখারাপেও হেসে ফেলল নন্দিনী "মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে যেতে চাইলেও পোষ মানা মন তা পারে না - - - - - পায়ে পায়ে নিজের ছোট্ট নীড়েই ফিরে আসে অবচেতনের অবগুণ্ঠনে ঢাকা সচেতন মনটা"। ধীর পায়ে বাড়ি ফিরে এমন অসময়ে অভিকে বাড়িতে দেখে মনে মনে অবাক হলেও মুখে তা প্রকাশ না করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো ও।
" ফোনটা সারাদিন সুইচড্ অফ রেখেছিলে কেন? এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হও কী করে তুমি? "
" আমি তো বাড়িতে ফোন করেছিলাম।"ক্লান্তস্বরে নন্দিনী বলল।
"ও-----তাই! আজকাল আমাকে বোধহয় কেউ বলে ভাবোই না?"
ঠোঁটের কোলে অল্প হাসি এনে নন্দিনী বলল "না ভাবলে চলবে কী করে? তোমার বাড়ি - - - - তোমার সংসার - - - - তোমার সন্তান - - - -তোমার সব নিয়েই তো আমি আছি। যেখানে সবটাই তুমিময় - - - - সেখানে তুমিতো প্রবল ভাবে আছ। বরং আমার 'আমি' টাই আজ বড়ো অস্তিত্বহীন। "
" এত বছর পরে এত কিছু দেওয়ার পরও একথা বলছ?"
ঠাণ্ডা, নির্লিপ্ত কণ্ঠে নন্দিনী বলল-
"এই একটা জায়গায় - - - তোমাদের পুরুষ সত্ত্বা একসূত্রে গাঁথা জানো । ভাত-কাপড়ের খিদে মিটিয়েই 'সব দিয়েছির' দায়িত্ব পালন করে মহান হতে চাও। কিন্তু পেটের খিদে মিটলেও মনের খিদে যে মেটে না অভি। তাই তোমার সংসারে আজকাল নিজেকে বড়ো অবাঞ্ছিত মনে হয়।"
কথাগুলো বলে ক্লান্ত পায়ে নিজের ঘরে চলে যায় নন্দিনী।
আজ একমুহুর্তে পায়ের তলার মাটি সরে গেল অভির। এতগুলো বছর ধরে পলে পলে বানানো অহংকারের ইমারতটা একধাক্কায় বালির বাঁধের মতো ভেঙে পড়ল। নন্দিনীর বলা প্রত্যেকটা কথা শেল হয়ে বিঁধছিল ওর বুকে। আজ বুঝতে পারছে, সহজ প্রাপ্য পার্থিব সুখে সুখী হতে গিয়ে সবচেয়ে দুর্লভ, অমূল্য - - - জীবনের সব পাওয়ার শ্রেষ্ঠ পাওয়া 'শান্তি' কে কবেই যেন হেলায় হারিয়ে ফেলেছে ও। টলোমলো পায়ে নিজের ঘরে এসে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে অভি।
চোখ বন্ধ করতেই বৃষ্টিভেজা নন্দিনীর পাশাপাশি কলেজপড়ুয়া, নবযৌবনা আর একটা লাজুক মুখের ছবি ভেসে উঠল - - - - সে আর কেউ নয়..... ওর প্রেয়সী নন্দিনী। ওর মনের স্ক্রিনে জলছবির মতো সেই প্রথম দেখা, বন্ধুত্ব, প্রেম, খুনসুটি - - - একে একে ফুটে উঠতে লাগল। বড় অভিমানী ছিল মেয়েটা।অভিমান হলে যখন বন্ধুরা ওকে কোথাও খুঁজে পেত না, কলেজের মাঠের শেষ প্রান্তে নিঃসঙ্গ রাধাচূড়া গাছটার নীচে একা বসে থাকা অভিমানী মেয়েটার কাছে চুপিচুপি গিয়ে মান ভাঙাতো অভি। একমুহুর্তে লজ্জামাখা হাসিতে ওর চোখদুটো আরও মোহময়ী হয়ে উঠত। পরমুহুর্তেই খুব কষ্ট পেত ওই একা অপেক্ষারত গাছটার জন্য। নন্দিনী বলত "ভালোবাসার মানুষ নেই বলে আজও ও একা। চলো, আমরা একটা কৃষ্ণচূড়া খুঁজে নিয়ে আসি ওর জন্যে ।" শুধু দুঃখপ্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়নি পাগলীটা। সত্যি সত্যিই একদিন কৃষ্ণচূড়াকে রাধাচূড়ার পাশে এনে তবে শান্তিতে---আনন্দে---আত্মহারা হয়ে বলেছিল "আজ আমি ভীষণ খুশি। আর রাধাকে কৃষ্ণ প্রেমে বিরহীনী হয়ে দিন কাটাতে হবে না।"অভি ওর প্রিয়তমাকে সবটুকু দিয়ে আদরে, যত্নে, ভালোবাসায় সাজিয়ে রাখতে গিয়ে 'আরো চাই' - এর সর্বগ্রাসী নেশায় ডুবে গেছে। এসব পুরোনো কথার সহাবস্থানে থাকা অবচেতন মনের কথা শুনতে শুনতে ভোরের দিকে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল অভি।
রাগে, অভিমানে কথাগুলো বলে অনুতাপ হলেও কোথাও একটা শান্তির ছোঁয়া পাচ্ছিল নন্দিনী।দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে থাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন গোপন কুঠুরির দরজাটা কী খুলে গেল একটু? এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই নন্দিনীর। তবে নিজের মধ্যে কষ্ট জমানোর অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও অভিকে তার এতটুকুও আঁচ লাগতে দেয়নি বলেই হয়ত খুব কষ্ট হচ্ছিল অভির জন্য। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিল ওর। হঠাৎ কী মনে হতে ফোনটা অন্ করতেই দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষায় থাকা অভির মিসডকল্ আর গোটাকয়েক মেসেজ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে হাঁপাতে লাগল। অভির আসা মিসডকলটা বারবার দেখছিল নন্দিনী "ও আমাকে ফোন করেছিল কেন? কোনো প্রয়োজন ছিল নাকি ....?" আজ আর মেসেজগুলো পড়তে ইচ্ছে করছিল না ওর। ফোনটা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে মেয়েকে বুকের মধ্যে নিয়ে শুয়ে পড়ল নন্দিনী।
পরদিন সকালে অফিসের জরুরী ফোন আসতেই গতরাতের ভাবনাগুলো জলের বুদবুদের মতো করেই মিলিয়ে গেল অভির । প্রচণ্ড ব্যস্ততায় তিতাসকে স্কুলে পৌঁছনোর দায়িত্বও নন্দিনীর ওপর ন্যস্ত করে বেরিয়ে গেল ও। তিতাসকে নিয়ে স্কুলের রাস্তায় কিছুটা এগোতেই বার্তা পেল নন্দিনী "তিতাসের সাথে আজ স্কুলবেলার কিশোরী নন্দিনী হয়ে যেও। কিশোরীবেলাতেই যে যৌবনের পদধ্বনি শোনা যায় সখী - - - সেটা কিন্তু ভুলো না। তবে আজ আবার অভিমানের হাত ধরে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে যেও না। অবশ্য তোমার সাথে ওই দ্বীপের সঙ্গী হতে পারলে মন্দ হবে না।"
"এত ছোট ছোট অনুভূতিগুলো কীকরে পারেন বলুন তো ব্যক্ত করতে। তবে বোধহয় সত্যিই 'সৎসঙ্গে স্বর্গবাস হয়'! আপনার অনুভূতিগুলো অনুভব করতে করতে কখন যেন আমার হারিয়ে যাওয়া ছোট ছোট অনুভূতিগুলো এক নতুন আবেশে জড়িয়ে ধরছে আমাকে। "
ফোনটা রেখে নিজের স্কুলবেলার মতোই মজায়, আনন্দে মেতে উঠল দুজনে। তিতাসও মায়ের খুশিতে দ্বিগুণ খুশী হয়ে আব্দার করল" আজও আমরা ফুচকা খেতে যাব মামণি। নিয়ে যাবে তো? "
" ঠিক আছে, বাবা - - - - তাই হবে। এখন স্কুলে গিয়ে গুড গার্ল হয়ে থাকবে কিন্তু। আমি আসি - - - - বাই।"
অফিসে এসেই সকলে নিজেদের আলোচনায় সামিল করে নিল নন্দিনীকে।
"কিছু একটা ভাবো, নন্দিনীদি?! শুধু গান, কবিতায় ব্যাপারটা কিন্তু পানসে হয়ে যাবে। "
" হঠাৎ এসব নিয়ে পড়লে কেন তোমরা? "
" ওঃ নন্দিনীদি - - - - - তুমিও না! আর কটা দিন বাদে বাইশে শ্রাবণ - - - ভুলে গেছ! "
"সরি - - - - আমার একেবারেই মনে ছিল না।আর তাছাড়া তোমরা আমার থেকে অনেক স্মার্ট, অনেক বেশী মডার্ন - - - - অন্যরকমভাবে কবিগুরুর স্মরণ তোমরাই তো সবচেয়ে ভালো পারবে। "
" নাগো নন্দিনীদি, এব্যাপারে আমরা এখনো অনেকটাই পিছিয়ে। ট্র্যাডিশন বজায় রেখে মডার্নাইজড ওয়েতে কবিগুরু কে শ্রদ্ধা জানাতে তোমরাই বেস্ট। আমরা সৈনিক হতে রাজী - - - - কিন্তু সেনাপতি তোমাকেই হতে হবে। "
সৌমাল্যর কথায় আর সকলের জোরাজুরিতে দায়িত্বটা শেষ পর্যন্ত নিয়েই নিল নন্দিনী।হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ইউনিভার্সিটিতে অভি আর ও দুজনে অনেকগুলো অনুষ্ঠান একসাথে করেছে। তাই অভির সাথে আলোচনার কথাটা মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিলেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে করল না ওর।
প্রায় ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় একটা কিছু যখন তৈরী করল, দুপুর তখন বিদায় নেওয়ার তোড়জোড় করছে।তিতাসের সাথে কথা বলে অভিকে ফোন করতেই ব্যস্ত রিংটোন ওর ব্যস্ততার খবর জানিয়ে দিল। বাকী থাকল 'খোলা হাওয়া' য় ভেসে আসা মুক্ত বাতাসের আঘ্রাণ। বন্ধ খামের মতো ইনবক্স খুলেই দেখল "আজ কিশোরী নন্দিনীর সাথে কেমন সময় কাটালে ম্যাডাম? মাঝে মাঝে কিশোরীবেলায় ফিরে কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে ভোরের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রের দ্যুতি ছড়ানো সেই মেয়েটাকে খোঁজো - - - - হারিয়ে যাওয়া অমূল্য রত্নগুলোর খোঁজ অবশ্যই পাবে।"
ওর অজানা বন্ধুটি যে উত্তরের অপেক্ষা রাখে না তা বাকী মেসেজগুলোই বুঝিয়ে দিচ্ছে। আসলে অন্তর্ভেদী চিরসত্যের প্রত্যুত্তরের প্রয়োজনই হয় না। হঠাৎ কী মনে হতে অফিসের অনুষ্ঠান ও তার সূচীর কথা জানাতেই উত্তর এল" এটা সত্যিই ভীষণ ভালো খবর। তোমার নতুন পরিচয় নতুনভাবে উদ্ভাসিত হোক সকলের কাছে।পরিচালনা ছাড়া অনুষ্ঠানে তোমার অন্য রূপ জানার অধীর অপেক্ষায় - - - - ।"
ক্রমশঃ-----------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট