অভিশপ্ত চুমু
মনোজকুমার রায়
রাতটা যেন কাটতে চাচ্ছে না অনীশের। সারাক্ষণ শুধু একটিই চিন্তা মাথায় ঘুরছে কখন সকাল হবে, কখন দেখা করবে? রাত ১টা অবধি মোবাইলে কথোপকথন করেও তার মন মানছে না। না মানারেই কথা কারণ তিন বছর ধরে ফেসবুকে, পরে ফোনে আলোচনা, ভাব আদান-প্রদান চলে। কাল তাদের মধ্যে দেখা হতে চলেছে। এপাশ ওপাশ করতে থাকে আর আনন্দে স্বর্গের আকাশে ভাসছে। এই ঘুম-জাগা খেলা খেলতে খেলতে সূর্য আপন মনে উঠে পরে পুব আকাশে।
সকাল সাড়ে ছয়টায় বিছানা ছাড়ে অনীশ। বাইরে কুয়াশার আভাস চিহ্ন দেখতে দেখতে ব্রাশ করা সেরে নেয়। বাড়ির সকলে সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। মা অনীশকে দেখে বলে–কিরে আজ এত তাড়াতাড়ি উঠলি, কোথাও বেড়বি নাকি?
-কেন তাড়াতাড়ি উড়তে নেই বুঝি?
-না তা নয়, আসলে তুই তো সাতটা না বাজলে উঠিস না।
-সাতটা বাজে তো।
পাশে ডুয়ার্স কোল্ড স্টোরেজে সাতটির বেল বাজল। হাত মুখ ধুঁয়ে ঘরে গামছা দিয়ে হাত মুখ মুছে মোবাইলটি নিয়ে এসএমএস পাঠিয়ে দিল–গুড মর্নিং। ঠিক দশটায় দেখা হচ্ছে।
ঘড়িতে ঠিক নয়টা। কলেজের ব্যাগটি পিঠে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল অনীশ। বীরপাড়া গামী বাস ধরে জলঢাকায়, সেখানে মিউজিক সাফারী চড়ে কুর্শামারী ত্রিপথা মোড়। এখানে নেমে ফোন করে গন্তব্যের দিক জেনে নেন। এখানে বছর পাঁচেক আগে সে তার বন্ধুর মাসির বাড়িতে একবার এসেছিল, তাই জায়গাটি তার একেবারে অচেনা নয়। উত্তরে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে কদম গাছটির ছায়ায় সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমা। আগেই ফেসবুকে ছবি দেখায় চিনতে পরস্পরের অসুবিধে হয়নি। অনীশ তার কাছে যাওয়া মাত্রই ঝুমা হাঁটা শুরু করে, দু'জনে একসাথে হেঁটে চলে। তারা এমন ভান করল যেন দু'জনে রোজ দেখা হয়। বাজারের লোকজনকে ফাঁকি দিল চোখের ইশারায়। প্রেম-ভালবাসায় অনেক ইঙ্গিত শিখে যায় ছেলে-মেয়েরা। বসতি ছেড়ে রেল লাইনের পাশ ধরে কথা বলতে বলতে পশ্চিমে এগতে থাকে অনীশ আর ঝুমা।
ঝুমা একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। পশ্চিম মল্লিকপাড়া বিদ্যানিকেতনের পড়ে। আর অনীশ ময়নাগুড়ি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
ঝুমার ঠাকুরদা মাস তিনেক আগে মারা যাওয়ায় বাড়িতে এবছর কালীপূজো বন্ধ থাকবে। তাই তার বড়ো মামা ফোনে তাদের বাড়িতে যেতে বলেছে। ঝুমা একেবারে রেডী হয়ে বেরিয়েছে। জলঢাকা নদীটি পেড়লেই মামার বাড়ি পানবাড়ি। তারা বাঁধের উপরে বট গাছটির ছায়ায় তার শীকড়ে পাশাপাশি বসে গল্প সাঁটাতে থাকে।
উত্তর দিক থেকে লোহা পেটানো হাম্বারের টুং টাং শব্দ কানে আসছে। কিছু মজুর নতুন রেল লাইন তৈরির কাজে ব্যস্ত। একটি লোক জলে জাল ফেলে মাছ ধরছে আর তার পিছু পিছু হাফপ্যান্ট পড়া খালি গা বছর এগারো একটি ছেলে বাজার করা ব্যাগে মাছ ভরাচ্ছে। অদূরে কয়েকজন ছেলে বালির চরে কুমীর ডাঙা খেলছে। পুবের হাওয়াটুকু তাদের কাছে এসে ঘূর্ণবাতের মতো ঘুরতে থাকে। ঝুমার শ্যাম্পু করা চুলগুলো অনীশের নাকে মুখে উড়ে আসছে, তার যেন অন্য এক নেশা লাগছে। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে সে পড়েছে মেয়েদের চুলের গন্ধ নাকি ছেলেদের পাগল করে দেয়। আজ সেটা সে প্র্যাক্টিক্যালে অনুভব করল।
-ওই দেখ লোকগুলো কিভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, অনীশকে শূন্য ডেসিবলে বলল ঝুমা।
-ওদের কাজ হল দেখা আর আমাদের কাজ হল জমিয়ে প্রেম করা। তা না হলে আমাদের প্রেমটি কিভাবে অমর হবে। অনীশ তার মুখটি ঝুমার কানের কাছে নিয়ে আসে, ঝুমা মাথাটি সরিয়ে নেয়।
-তোমার খালি দুষ্টামি। সর এবার উঠি। ঝুমা তার কাঁধ থেকে অনীশের হাতটি সরিয়ে দেয়।
-আর একটু থাকো না প্লীজ। ঝুমার হাতটা ধরে থাকে। দক্ষিণের বাঁধের ধারে জলা জমিতে তিনজন ছেলে শাপলা আর কলমির সংগ্রহ করছে। অনীশ হাতের ইশারা দিয়ে ছেলেদেরকে ডাকল। তারা কেউ শাপলা কেউ কলমির কাঁধে নিয়ে অভয়ে এসে তাদের থেকে মিটার দুয়েক দূরে দাঁড়াল।
-একটি লাল শাপলার ফুল দাও তো। অনীশ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
-ক্যানে দাদা ফুল তুই কি করিবু? সবচেয়ে ছোটো ছেলেটি বলল
-একেনা দে পাইসা দিম।
-ও বুঝিসু! অনীশের সঙ্গে ছোটো ছেলেটির আর অনেক কথা হল। ছেলেটি খুবই স্মার্ট। মুখ দিয়ে যেন কথার ফুলঝুরি বেড়য়। তারা একটি লাল শাপলার ফুল অনীশের হাতে দিয়ে দশ টাকার একটি নোট নিয়ে গান করতে করতে চলে যায়-'দিল তো পাগল হে.......'। অনীশ ফুলটি ঝুমার হাতে দিল।
-আজ প্রথম সাক্ষাৎটি না হয় লাল শাপলার ফুল দিয়েই পূর্ণতা করি। গোলাপ তো সকলেই দেয়।
কাশ আর হোগলা বনের পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলঢাকার জলরাশি কলকল পায়ের শব্দে আপন খেয়ালে চলে ডাহুকের দল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্ষুধাত বকটি জলের দিকে। মাঝিহীন নৌকাগুলি চরে খুঁটিতে বাঁধা। একটি নৌকায় চারজন বছর তিরিশের যুবক পিকনিক করছে। চারজনের কাপড়ের ব্যাগ, জলের বোতল, চিপস, চানাচুর, কেকের প্যাকেট, পাশে রাখা তিন চার ধরনের সংবাদ পত্র। তারা প্রত্যেকেই কবি লেখক সাহিত্যিক। আকাশে ছুঁড়ে দেয় কাব্য বানী–-কতটা রাত পেরিয়ে আজ তপ্ত বালি চরে/কাশ বনে লিখে দিই প্রিয় নাম/জমানো কষ্টগুলো ভেসে দিই নদীর জলে/খোলা মনে ভরে রাখি সুখটুকুর দাম।
বেলা তিনটে, মামার বাড়ি থেকে ফোন আসল ঝুমার মোবাইলে। তার বড়ো মামার ফোন। এর আগে তাদের বাড়িতে ফোন করেছে। তার মা বলেছিল কোন বান্ধবীর বাড়ি হয়ে যাবে। মামা তাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলল। ঝুমা কলটি কেটে, যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। সে তার বড়ো মামাকে ভীষণ ভয় করে। শুধু বড়ো মামা কেন মেজমামা, ছোটো মামা, মামাতো দাদাদেরও চোখের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে তার গলা কাঁপে।
নগ্ন অভিমান নিয়ে অনীশ উঠে দাঁড়াল। সাইকেল নিয়ে ঝুমা আগে আর পিছনে অনীশ হাঁটতে লাগল। সে মনে মনে ভাবছে ভালবাসার প্রথম পর্বটি যদি করতে পারতাম। ভাবতে ভাবতে দু'জনে রেল ব্রিজের পাশে সংযুক্ত পারাপারির পথ ধরল।
সেখানকার আরপিএফ গার্ড দুইটি বেশ কয়েকবার তাদের বসে থাকার দিকে নজর দিয়েছিল। ব্রিজের মাঝখানে এসে অনীশ সাইকেলটি টেনে ধরল। সে আর থাকতে পারছে না। অনীশ ব্রিজের দু'পাশে দেখে ঝুমার পিছনের চুল ধরল, তার পর তার ঠোঁট দু'টি ঝুমার নরম হালকা লিপস্টিক পড়া ঠোঁটে স্পর্শ করল। মুহূর্তের মধ্যে দুইজনে এক অমৃত সাগরে ডুবে গেল। ঝাঁকি মারল দু'জনের শরীর। দু'জনেই লজ্জিত বোধ করল। ঝুমার ঠোঁটের লিপস্টিক ভাগ করে নিল অনীশের ঠোঁট। নীরবে দু'জনে দিকে যেতে লাগল। একটি আপ মালট্রেম ছুটে চলল ব্রিজের উপর দিয়ে। ব্রিজের কাঁপনি আর ট্রেনের আওয়াজ অনীশের হৃৎকম্প কে ছাপিয়ে যেতে পারল না। আরপিএফ দুটি দৃশ্যটি লক্ষ করেছিল। অনীশ ব্রিজ থেকে বাঁধের দিকে পা বাড়ালে একজন আরপিএফ তার ডান হাতটি ধরল এবং নিচে তাদের কোয়াটারের কাছে নিয়ে আসল।
-জানিস না এই সব নোংরামি এখানে চলে না, এটা রেলব্রিজ, রেল ডিপার্টম্যান্টের এলাকা। বস এই বেঞ্চ। ধমক দিয়ে বলল আরপিএফের একটি গার্ড। অন্য গার্ডটি বলল–কি নাম তোর? বাড়ি কোথায়?
-অনীশ অধিকারী, বা....। কথা আটকে দিয়ে
-এখানে প্রেম করতে এসেছিস, কত বয়স তোর? জানিস না এখানে অসভ্য কিছু করা চলে না। অনীশ কিছু বলতে গিয়ে না বলে মাথা নিচু করে থাকল। সেখানে কয়েকজন লোক আসল। তারা প্রতিদিন এখানে আসে, তাস-তুস খেলে গল্পগুজক করে সময় কাটায়। তাদের মধ্যে বিপিন বাবু একটু মাতব্বর প্রকৃতির। ঘটনাটি শুনে তিনি অনীশকে রেগে গিয়ে বলল-
-এক চড়ে তোর দাঁত ফেলে দিব, জান আমি কে? এই বয়সে এইগুলো, রেল ব্রিজে উঠে চুমু খাওয়া। তোকে থানায় দিতে হবে। এই থানায় ফোন করত। থানা পুলিশের কথা শুনে অনীশ এবার ভয় পেলে গেল। সবে মিলে তাকে শাসাতে লাগল। অনীশ মাথা হেট করে সব গালিগালাস হজম করে নিচ্ছে। কখন সে তাদের হাত থেকে ছাড়া পাবে, নাকি সত্যি সত্যি আমায় পুলিশের হাতে তুলে দিবে মনে মনে ভাবতে থাকে অনীশ। তার বাড়ির লোক যদি জানতে পারে তাহলে তাকে আর আস্ত রাখবে না। তিনি বাড়ির আদরের ছোটো ছেলে। সকলে তাকে ভীষণ ভালবাসে। পড়াশোনা ব্যাপারে আর বলার কিছু নেই, বিদ্যালয়ের গণ্ডি প্রথম শ্রেণিতেই উত্তীর্ণ হয়েছে।
সূর্য নিঃশব্দে জলঢাকার জলে ডুব দিতে যাচ্ছে। কত আপ-ডাউন ট্রেন বাধাহীন ভাবে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলে গেল। শাপলা কলমির তোলা ছেলেরা ব্যাট বল নিয়ে খেলা করছে নদীর চরে। সারাদিন ঘাস খাওয়ার পর গরুরপাল নিজ পথ ধরে বাড়ির দিকে সারি সারি করে বালি উড়িয়ে চলছে।
এইগুলো দেখতে দেখতে অনীশ বাড়ির কথা মনে করে। কত কাকতি মিনতি করেও সে মুক্তি পেল না। আর ওই দিকে নিন্দুকেরা তাদের আপন ভাষায় বকতে থাকে নিজ নিজ ভদ্রতার জ্ঞানী ডায়েলক। ঘূর্ণিপাকের মতো অনীশের মন ঘুরে চলছে জলঢাকা রেল ব্রিজের কার্নিশে। আজ তার এই রকম পরিস্থিতির জন্য দায়ী চুমুটি। ভালবাসার মায়ায় ডুবে গেলে পার্থিব জ্ঞান আর থাকে না। এইটাই ভালোবাসার এক লক্ষণ। কিন্তু অনীশেও তো অন্য প্রেমিকদের মতো। সে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে কয়েকজনকে ফোন লাগালেন কিন্তু সবাই পরিসীমার বাইরে। বিপদের সময় এটাই হওয়া স্বাভাবিক। তার চারপাশে আবার আঁধার নেমে এল। সেই চারজন পাগল কবি নৌকায় তাদের কবিবাসর সেরে খাতা, ডায়েরি, পেপার নিয়ে বাঁধের দিকে আসছে। অনীশ তাদের আসা দেখছে আর মনে মনে ভাবছে তাদেরও একই ডায়েলক তাকে হজম করতে হবে ।
ঘটনাটি শোনার পর নরেশবাবু বলে–ছোটো ছেলে ভুল করেছে তাকে ছেড়ে দিন অনেক দূর যাবে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসছে। নরেশবাবু সেই চারজন পাগল কবির মধ্যে বয়জেষ্ট্য। সাহিত্য জগতে তাঁর বেশ নাম ডাক। এই তল্লাটে তাঁকে সকলে ভীষণ কদর করে। তাঁর সাথে বাকী যে তিনজন তাঁরেই অনুগামী উদীয়মান কবি লেখক। তাঁর কথা শুনে অনীশ একটু আশ্বাসের গন্ধ পেল। বাকী লোকগুলো সকলে তাদের লাউস স্পিকারটি বন্ধ করল। আরপিএফের গার্ড দুটিও আর কিছু বলল না। শেষে একজন বলল–এই নরেশবাবুর জন্যই তোকে আজ ছেড়ে দিচ্ছি ভবিষ্যতে আর এই রকম কর না, মন দিনে পড়াশোনা কর। কথাটি যাতে মনে থাকে। অনীশ নরেশবাবুর পা ছুঁল।
-আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাও। অনীশ দ্রুত বাড়ির দিকে রওনা দিল। কুর্শামারী ত্রিপথীতে টোটোয় চড়ে মোবাইলের ডাটা অন করা মাত্রই দশ-বারোটি হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ ঢুকল। দেখল ঝুমা লেখেছ-কোথায় এখন? কি করছ? কোন রেসপন্স নেই কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। অনীশ কোন রিপ্লাই না দিয়ে শুধু এই চুমুটির কথাই ভাবছে।
----------------------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট