ছোটগল্প।। লোকটা।। শংকর লাল সরকার
লোকটা
শংকর লাল সরকার
বাঁ.চা.ও. বাঁ.চা.ও.. ডু.বে গে ল!
রূপকের চিৎকার শুনে কাছাকাছি দাড়িয়ে থাকা নুলিয়া দুজন জলে ঝাপিয়ে পড়ল।
ঢেউ এর তালে তালে নূপুর তখন খাবি খাচ্ছে। হাঁসফাঁস করতে করতে জলের উপরে হাত উচু করে বাতাস আঁকড়ে ধরতে চাইছে।
চোখের সামনে জলজ্যান্ত একটা মেয়েকে তলিয়ে যেতে দেখে আশপাশের স্নান করতে আসা পর্যটকরাও উদ্বিগ্ন। রূপকের উদ্দেশ্যে নানারকম প্রশ্ন, উপদেশ তীরের মতো ধেয়ে আসতে লাগল। দুজনের কেউই যখন ভালো করে সাঁতার জানেন না, তবে অতটা গভীরে গেলেন কেন? নেশা করে জলে নেমেছিলেন নাকি? রূপকের কানে তখন কোন কথা ঢুকছে না। কেমন একটা বোধহীন অবস্থা। স্থিরভাবে কোন কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা ও হারিয়ে ফেলেছে।
কয়েক মুহুর্ত আগেই রূপকেরও অবস্থা ছিল সঙ্গীণ। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অসহায়ভাবে জলের টানে ভেসে গিয়েছিল সে। তলিয়ে যেতে যেতে মনে হয়েছিল জলের কারাগারে বুঝি বন্দী। জলের ছাদ, চারপাশে জলের দেওয়াল, জলের মেঝে। কিছুতেই মুক্তি নেই। অসহ্য কষ্টে বুকটা ফেটে যাচিছল যেন। আশ্চর্য সেই দমবন্ধ অবস্থার মধ্যেও লোকটার মুখ ভেসে উঠেছিল। তোবড়ানো ঝুলেপড়া গাল। অসংখ্য বলিরেখা আঁকা মুখে কয়েকদিনের না-কাটা কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ। কিন্তু চোখদুটো অদ্ভুত উজ্জ্বল, কেমন যেন সম্মোহনের দৃষ্টি।
নুলিয়া দুজন অনেক কষ্টে নূপুরকে জল থেকে তুলে এনে বালির উপর শুইয়ে দিল। অচৈতন্য কোনরকমে প্রাণে বেঁচেছে। সেই লোকটাও, সৈকতে কোথায় ছিল কে জানে, ছুটে এসেছিল।
কাকে নিয়ে এল? বেঁচে আছে তো? জয় জগন্নাথ! তোমার অসীম কৃপা! আমার পার্বতীকে কেউ দেখেছ? আজও ফিরল না!
ভিড় করে আসা লোকজনের ভিতর থেকে একজন তেড়ে গেল ওর দিকে এখন কেটে পড়ো!
তাড়া খেয়েও গেলনা লোকটা। রূপকের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, আপনার বউ বেঁচে আছে?
রূপক কিছু বলতে যাচ্ছিল ভিড়ের ভিতর থেকেই একজন বলে উঠল, একদম পাত্তা দেবেন না।
নুলিয়াদের একজনকে এগিয়ে আসতে দেখে লোকটা রূপককে ছেড়ে অন্যদিকে সরে গেল। অনেক বেলা হল ওদিকটাতে যাই পার্বতীকে খুজতে হবে। এই বলে লোকটা সেখান থেকে প্রায় ছুটে চলে গেল।
একজন বলল লোকটার বউ সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে জলের টানে ভেসে গিয়েছিল, তাকে আর খুজে পাওয়া যায়নি। সেই থেকেই লোকটা সারাদিন পাগলের মতো সমুদ্রসৈকতে ছুটাছুটি করে। মাঝেমধ্যে একনাগাড়ে বিলাপ করে। রাত্রে অনেকেই ওর একঘেঁয়ে কান্নার আওয়াজ শুনেছে। যাকে সামনে পায় তাকেই জিজ্ঞাসা করে কেউ ওর বউ পার্বতীকে দেখেছে কিনা। ভিড়ের মধ্যে থেকে আর একজন রূপককে বলল আপনাকে কাল সন্ধ্যাবেলায় দেখেছিলাম লোকটার সঙ্গে কথা বলতে। ওর থেকে কিন্তু সাবধান।
জটলার মধ্য থেকে একজন বলল, লোকটা নিজেই ওর বউকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছে। তারপর থেকেই সে পাগল হয়ে গেছে। সমুদ্র সৈকতে কেবলই বউকে খুজে বেড়ায়। বেড়াতে আসা কোন দম্পতিকে দেখলে নিজের থেকেই এগিয়ে যায় আলাপ করতে। কী যে বলে, কীকরে কে জানে। আশ্চর্য! মাস তিনেক আগে আপনাদেরই মতো দুজনে নেমেছিল সমুদ্রে চান করতে। বউটা তলিয়ে গেল, বাঁচানো গেল না। তাদেরও দেখেছিলাম পাগলটার সঙ্গে খুব গল্প করতে। সেই থেকে আমরা ওকে এড়িয়েই চলি।
রূপকের মনে হল সত্যই তো আজ সকালে সমুদ্রে চান করতে নামার আগে অনেকক্ষণ লোকটার সঙ্গে কথা বলেছিল। তারপর থেকেই কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। নূপুর অতটা দূরে যেতে চাইছিল না ওই জোর করে নিয়ে গেল। সন্দেহের কথাটা বলতে ভিড় করে আসা লোকেরাও জোর গলায় সায় দিল। লোকটা ডাইন, একটা রাক্ষস, ওকে পিটিয়ে মেরে দেওয়া উচিত। পুলিশে দেওয়া দরকার। নানা রকম গুঞ্জন উঠল।
নূপুর বেঁচে গেল সেটা ওর ভাগ্য, কিন্তু রূপকের?
সকলেই এখন জোর গলায় লোকটাকে দোষারোপ করছে, কিন্তু রূপক নিজে!
পুরীতে পৌছানোর পর প্রথম রাত্রি, লোকটার সঙ্গে তখনও ওদের দেখা হয়নি। রূপক, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিল। পাশে ঘুমিয়ে থাকা নূপুরকে দেখে বিতৃষ্ণায় ওর মন ভরে গিয়েছিল। কাপড়জামার একটা জবুথবু স্তুপ যেন। মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছে। তালে তালে হাপরের মতো বুকটা উঠানামা করছে। বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল সে। মেয়েরা ঘুমিয়ে থাকলেও তার মধ্যে একটা শারীরিক আকর্ষণ থাকে। কিন্তু বিয়ের মাত্র তিন বছরের মধ্যেই নূপুরের সব আকর্ষণ, সব রহস্য রূপকের কাছে শেষ হয়ে গিয়েছে। অথচ অফিসের মুনমুনকে দেখ! চোখের দৃষ্টি, খিলখিল হাসিতে শরীরের বাঁধুনি বাগ মানতে চায় না। ঘুমন্ত নূপুরকে দেখে রূপকের মনে হয়েছিল একটা বালিস ওর মুখে চেপে ধরে। তারপর সে নিজের সেই ভয়ানক চিন্তাটার জন্য আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল।
নুলিয়াদের চেষ্টায় কিছুটা সুস্থ হয়ে বালির উপর ধীরে ধীরে উঠে বসল নূপুর। রূপকের চিন্তা সূত্র ছিন্ন হল। একটা দীর্ঘশ্বাস রূপকের বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে। চোঁয়া ঢেকুরের মতো তেঁতো একটা গন্ধ সারা মুখটাতে ছড়িয়ে পড়ে। নিমেষে পুরো মুখটা বিস্বাদময় হয়ে উঠে। মনেরভাব লুকিয়ে সে হাসিমুখে তাকাল নূপুরের দিকে।
--------------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট