গল্প ।। সাত বছর পরে ।। সুব্রত সুন্দর জানা
সাত বছর পরে
সুব্রত সুন্দর জানা
উঃ বড্ড দেরি হয়ে গেছে। একটুর জন্য তিনটে পঞ্চাশের লোকালটা বেরিয়ে গেল। এখন আবার সেই ছ'টার গাড়ি। এত সময় প্লাটফর্মে বসে থাকতে হবে। শিয়ালদহ সাউথ স্টেশানে টাইম-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলি ভাবছিল প্রিয়ব্রত। ডিসেম্বর যায় যায়, শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। এখন আবার সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতে সন্ধ্যে। তাই একটু সকাল সকালই বেরিয়ে ছিল সে। কলেজস্ট্রিটে কতগুলি জরুরি বই কিনতে হবে। সব বই ঠিকঠাক ভাবে পাওয়া গেলেও বাধ সাধল একটি বই। সেটা আর কিছুতেই পাওয়া যায় না। বহু কষ্টে পুরানো বইয়ের স্টল হাতড়ে তবেই পাওয়া গেল। আর তার জন্যে তিনটে পঞ্চাশের গাড়িটা ফসকে গেল।
শীতকাল, সন্ধ্যে হয় হয়। তাই গেটের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে জনস্রোত। একটা একটা গাড়ি ঢুকছে আর লোক ভর্তি করে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। লোকেরাও বাদুড় ঝুলা হয়ে ঝুলতে ঝুলতে চলে যাচ্ছে দূর দূরান্তে। বারো-তেরো নম্বর প্লাটফর্মের সামনে যেখানে গার্ড ও ড্রাইভারদের বাক্স পড়ে থাকে, সেখানে একটা ফাঁকা চত্তর আছে। বিভিন্ন শিক্ষানবিশ আর্টিস্টরা সেখানে বসে আঁকা প্র্যাকটিস্ করে। প্রিয়ব্রত সেই জায়গাটায় চলে এলো। দাঁড়াতে দাঁড়াতে একটা বসার জায়গাও পেয়ে গেল। বড় ভালো আঁকে ওরা। প্রিয়ব্রত সময় পেলেই এখানে দাঁড়ায়। ওদের আঁকা দেখে।
একটি ছবি খুব মন দিয়ে দেখছিল প্রিয়ব্রত। সামনে বসে আছে প্লাটফর্মের বাসিন্দা একটি আঠারো ঊনিশ বছরের মেয়ে। মুখে সামান্য সস্তা কসমোটিক্সের আভাস থাকলেও শীর্ণ দেহের শ্রী বলতে কিছুই নেই। শতছিন্ন একেবারে মলিন একখানি শাড়ি শরীরটাকে কোন রকমে ঢেকে রেখেছে। কোলে একটি হাড় জিরজিরে শিশু। ভদ্রলোক জল রঙ দিয়েই ছবিটি এঁকেছিলেন। নিখুত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মুখের অভিব্যক্তি। দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল প্রিয়ব্রত। সেই সময় হঠাৎই কার ডাকে চমকে উঠল সে।
---আরে প্রিয়ব্রত! তুমি যে এখানে? কি ব্যাপার, কোথায়?
মুখ ফেরালো প্রিয়ব্রত। চৈতালি। কয়েক দিন আগে দেখা না হলে চিনতে পারতো না প্রিয়ব্রত। সোনারপুর স্টেশনে আশিসের সঙ্গে দেখেছিল ওকে। আশিসই চিনিয়ে দিয়েছিল। ট্রেনের তাড়া ছিল বলে সেদিন কথা কিছুই হয়নি। আজ হঠাৎই তাকে দেখে প্রথমটা সে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল। তারপর আমতা আমতা করে বললো --কলেজস্ট্রিটে গিয়েছিলাম বই কিনতে, এখন বাড়ী ফিরছি। বলেই সে প্রথমে হাতের ঘড়িটা দেখে নিল। তারপর ইলেক্ট্রনিক্স বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বুঝল ডায়মণ্ডহারবারের ট্রেন দশ নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। চৈতালিও তার স্বাভাবিক চপল হাসিটি হেসে বললো --তার মানে ডায়মণ্ডে তো? আমিও তো বারুইপুরে ফিরছি। চলো একসঙ্গে যাই।
---তুমি এখন বারুইপুরে থাকো?
---হ্যাঁ, একরকম। চলো, ট্রেনে বসে কথা হবে।
ট্রেনে যথেষ্ট ভীড় ছিল। তা সত্ত্বেও দুজনে পাশাপাশি দুটি জায়গা করে নিল। প্রথমে কিছুটা নীরবে কাটল। তারপর কে কোথায় থাকো, কী করো, কেমন আছো। আবার চুপচাপ। হয়তো কোন কথাই যোগাচ্ছিল না। কিংবা এত কথা মনে পড়ছে তার মধ্যে কোনটা আগে বলবে সেটাই কেউ ভেবে পাচ্ছিল না।
প্রিয়ব্রত মনে মনে হিসাব করে দেখল প্রায় সাত বছর আগে তারা একসঙ্গে রাজনগর হাইস্কুলে পড়ত। তখনকার রঙিন দিনগুলি একটি একটি করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। আজ যে চৈতালি তার পাশে বসে, তখন সে এক অন্য মেয়ে। কৈশোর পেরিয়ে সবে যৌবনে পা রেখেছে। যেমন রূপ, তেমনি ছিল তার দস্যিপনা। সব ব্যাপারেই কথা বলা চাই। নিজের স্বাভাবিক ক্ষমতাতেই ও সব জায়গাতে কর্তৃত্ব ফলাতো। মেয়েরা তো দূরের কথা, কোন ছেলেই ওর কাছে পাত্তা পেতো না।
একদিনের কথা মনে করে হাসি পেলো প্রিয়ব্রতর। প্রিয়ব্রত বরাবরই চুপচাপ। ক্লাসে নীরবে স্যারের পড়া শুনে যেত। খুব প্রয়োজন না হলে কথা বলতো না। চৈতালি এবং ওরা একই সঙ্গে স্যারের কাছে পদার্থবিদ্যার টিউশান পড়ত। পড়াশুনা নিয়ে চৈতালিই বেশিরভাগ সময় স্যারের সঙ্গে আলোচনা করত। তার সঙ্গে অন্যান্য মেয়েরা যোগ দিত। ছেলেরা থাকতো একেবারে চুপচাপ। একদিন একটি নতুন বিষয় পড়াতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে একটি জটিল বিষয় চলে এলো। সেই বিষয়ে কেউ পারছে না দেখে প্রিয়ব্রতই মুখ খুলল এবং সারা ক্লাসটা একটানা প্রিয়ব্রতই স্যারের সঙ্গে আলোচনা করে গেল। সেদিন ক্লাসের শেষে প্রিয়ব্রত বন্ধুদের কাছে খুবই প্রশংসা পেয়েছিল। কারণ আজ সে চৈতালিকে পরাস্ত করতে পেরেছে। চৈতালিকে সেদিন সত্যিই কিছুটা নিঃস্প্রভ লাগছিল।
তার এই সদা চঞ্চল হাসি খুশি মুখের মধ্যে আর একদিন বিষাদ দেখেছিল প্রিয়ব্রত। যে দুরন্তপনা তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছিল, তাকে করেতুলেছিল আকর্ষণীয়া, সেই দুরন্তপনার জন্যই তাকে হস্টেল থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। ঐ স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। চৈতালি তখন উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী। ওদেরই হস্টেলের কাছাকাছি একটি রুমে পড়েছে একটি প্রতিবন্ধী ছেলের সিট। পরীক্ষার শেষে সবাই চলে যাওয়ার পরেও ঐ ছেলেটি অতিরিক্ত আধঘন্টা সময় পায়। একদিন ঐ সময় ঐ রুমে গাড় দিচ্ছিলেন স্কুলে নতুন আসা একজন মাস্টারমহাশয়। চৈতালি তাঁকে দেখে কোন তোয়াক্কাই করল না। স্যার থাকাকালীনই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং ছেলেটিকে উত্তর বলে দিতে লাগল। ছেলেটি যখন খাতা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন আবার তাকে জিজ্ঞেস করছে ঠিক ঠাক লিখতে পেরেছে কিনা। নিজের উপস্থিতিতে এই অবমাননা স্যার কিন্তু কিছুতেই মেনে নিলেন না। হেড স্যারের কাছে গিয়ে নালিশ করলেন। হেড স্যার ছিলেন ন্যায় নীতির বিচারে খুবই কঠোর। তিনি সব ব্যাপারটা জেনে দৃঢ় ভাবে আদেশ দিলেন চৈতালিকে হস্টেল ছাড়তে হবে। অন্যান্য স্যারেরা হেড স্যারকে কত বোঝালেন। এই পরীক্ষার সময় হস্টেল থেকে তাড়িয়ে দিলে ও মনে একটা বিরাট আঘাত পাবে। কিন্তু হেড স্যারের রায় কিছুতেই পরিবর্তিত হল না। অগত্যা চৈতালিকে হস্টেল ছাড়তে হল। প্রথমে স্যারেদেরকে প্রণাম করে তাঁদের আশীর্বাদ নিল। তারপর সকল অপরাধের সাজা মাথায় নিয়ে, সবার চোখের সামনে দিয়ে, যেই পথে একদিন সে নবাগতা হয়ে হস্টেলে এসেছিল সেই পথেই অধঃমুখে বেরিয়ে গেল। যে দুঃখ বলে জানেনা, সকল সময় আনন্দ ফুর্তি করে সময় কাটায় সে যদি সত্যি সত্যিই কোন দিন দুঃখ পায় তাহলে সেটা যে কতবড় মর্মান্তিক হয়ে ওঠে তা না দেখলে বোঝা যায় না। চৈতালির এতটুকু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য যে ছেলেরা তার পেছনে ঘুর ঘুর করত তারা সেদিন কতটা সমব্যথী হয়েছিল কে জানে। তবে প্রিয়ব্রত সেদিন মনের মধ্যে একটি কষ্ট অনুভব করেছিল।
---এই প্রিয়ব্রত, কি হল? এত দিন পরে দেখা হল, চুপ-চাপ হয়ে গেলে যে। কিছু বলো। অনেক্ষণ পরে চৈতালিই মুখ খুলল।
---আচ্ছা চৈতালি, তোমার অতীতের কথা মনে পড়ে? স্কুলের পত্রিকায় আমার গল্প পড়ে বলেছিলে, আরো ভালো লেখার চেষ্টা করো। মনে আছে সে সব কথা?
স্কুল পত্রিকায় প্রিয়ব্রতর একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সবাই তার খুব প্রশংসা করেছিল। কেবল চৈতালিই গল্পটি পড়ে বিজ্ঞের মতো বলেছিল, --হুঁ এ আর এমন কি। আরো ভালো কর। সেদিন কিন্তু চৈতালি কিছুটা তাচ্ছিল্লই করেছিল প্রিয়ব্রতকে। আজ আর তার কথায় কোন উত্তর দিতে পারলো না কেবল একটু উদাস ভাবে বাইরের দিকে তাকালো। তার পর মুখ ফিরিয়ে বললো, --আচ্ছা প্রিয়ব্রত, আমি সেদিন তোমাকে দেখেই চিনতে পারলাম। অথচ তুমি কেন আমাকে চিনতে পারলে না। প্রিয়ব্রত প্রথমটা কি বলবে ভেবে পেল না। তারপর ধীরে ধীরে বোলল, --তুমি আগে কত সুন্দর দেখতে ছিলে চৈতালি। হাসি খুশি অথচ স্মার্ট। চঞ্চলা অথচ কর্তব্যপরায়না। আর আজ! আজ তোমার সেই চঞ্চলতা ভাব নেই, বেপরোয়া ভাব নেই, সেই সৌন্দর্যও নেই।
--কেন বুঝতে পারছো না প্রিয়ব্রত? এর মধ্যে সাতটা বছর কেটে গেছে। সাত সাতটা বছর! শেষের কথাগুলো একটু মনে মনে আওড়ালো চৈতালি। তার পরে ঠোটে একটু হাসি আনার চেষ্টা করে বললো, --আচ্ছা প্রিয়ব্রত, একটা প্রশ্ন করবো সত্যি কথা বলবে?
প্রিয়ব্রত স্বাভাবিক ভাবেই বললো, -বলো।
---স্কুলে পড়া কালীন তুমি কি আমাকে এতটুকুও ভালোবাসতে না? প্রশ্ন করেই আগ্রহের দৃষ্টিতে প্রিয়ব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো চৈতালি। প্রথমে কিছুটা থমকে গেল প্রিয়ব্রত। তারপর বললো, --শুধু বাসতাম নয় চৈতালি, এখনো বাসি।
চৈতালি বিস্ময়জড়িত গলায় অস্ফুটে বললো, --প্রিয়ব্রত!
---হ্যাঁ চৈতালি। ফুলকে যেমন ভালোবাসি, প্রজাপতিকে যেমন ভালোবাসি, রামধনুকে যেমন ভালোবাসি, তোমাকেও তেমন ভালোবাসি। এদেরকে দূর থেকে ভালোবাসা যায়। কিন্তু কামনা করা যায় না।
---কিন্তু আমিতো ফুল, প্রজাপতি নই, আমিতো একটি মেয়ে। জলজ্যান্ত এক নারী। আমি যেমন ভালোবাসা পেতে চাই, ভালোবাসতেওতো চাই।
---ভালোবাসার মানে কি শুধুই কামনা চৈতালি? আমিতো জানি নারীরা সৌন্দর্যের প্রতীক। সুন্দর দূর থেকেই সুন্দর। কাছে আনলে তার সৌন্দর্যতা নষ্ট হয়ে যায়। আমি তো তোমাদের চেয়ে চেয়ে দেখতাম। কত সুন্দর তোমরা, ফুলের মত।
চৈতালির চোখটা জলে ভরে এলো। এই প্রিয়ব্রত আগের মতোই আছে। সবার সঙ্গেই আছে আবার সবার থেকেই আলাদা। সবকিছুতেই আছে অথচ কোন কিছুতেই তার আকর্ষণ নাই। স্কুল জীবন পেরিয়ে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, তারপর এই বি এড। কত বন্ধুই এসেছে তার জীবনে। কিন্তু নিঃস্বার্থ নিস্কাম ভালোবাসা সে কারোর কাছ থেকেই পায়নি। সবার অলক্ষ্যে চোখটা একটু মুছে নিয়ে বললো, --চলি প্রিয়ব্রত, ট্রেন বারুইপুরে ঢুকছে। আমাকে নামতে হবে। জানিনা আর কোন দিন দেখা হবে কিনা। তবে আজ তুমি আমাকে যা দিলে এটা আমার এক অমূল্য পাওয়া।
প্রিয়ব্রতর কণ্ঠস্বরটা ভারী হয়ে এলো। --আচ্ছা এসো চৈতালি, ভালো থেকো। আশিসকে আমার কথা বোলো।
এইবার বাষ্পোচ্ছ্বাসে চৈতালির গলা বুজে এলো। প্রিয়ব্রতর হাত দুটি দুহাতে চেপে ধরে বললো, --না না প্রিয়ব্রত, একথা তুমি আমাকে বোলো না। আজকের দিনের ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবো না। এটা আমারই। কেবল আমারই। তারপর কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে, প্রিয়ব্রতর হাত ছেড়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল।
ঘন অন্ধকার চিরে ট্রেন ছুটে চলেছে ডায়মন্ডহারবার অভিমুখে। বারুইপুরের পরে ট্রেন প্রায় ফাঁকা। কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। প্রিয়ব্রত চাদরটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিল। আজ সন্ধ্যেটা যেন স্বপ্নের মত কেটে গেল। কত বদলে গেছে চৈতালি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বদলে যায়। কেবল স্মৃতিগুলির কোন পরিবর্তন হয়নি। সাতবছর আগে যেমন ছিল, সাতবছর পরেও তেমন আছে। সাত বছর পরে। সাত বছর………….।
- ০ –
সুব্রত সুন্দর জানা
গ্রাম ও পোঃ- গণেশনগর
থানা – কাকদ্বীপ
জেলা – দঃ ২৪পরগনা
পিন নং- ৭৪৩ ৩৫৭
ফোন নং- ৯১৪৩১ ৫৭৩৩৮