জীবন মঞ্চ
ডঃ রমলা মুখার্জী(ব্যানার্জী)
বাংলা সিনেমার স্বনামধন্যা পরিচালিকা মিস্ মৃদুলা সেনের চরিত্রানুযায়ী নায়ক-নায়িকা পছন্দ আর হচ্ছেই না। নায়িকা অনেক কষ্টে যাওবা খুঁতখুঁতে মৃদুলার পছন্দ হল তো কোন ছেলেকেই আর ক্যাবলা নায়কের চরিত্রে পছন্দ হচ্ছে না। নতুন ছেলে ধরে এনে দেওয়ার ভার সহ-পরিচালক রাজীবের ওপর দিলেন মৃদুলা।
রাজীব তো মহা ফ্যাসাদে পড়ল। নামী কোন পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দেবার জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে হঠাৎ একটা প্ল্যান তার মাথায় খেলে গেল। ছুটল তার কলেজের বন্ধু অভিজ্ঞানের কাছে। বি.এস.সি.তে ভাল রেজাল্ট করে অভিজ্ঞান এম.এস.সি. করতে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হল আর সিনেমা-পাগল রাজীব পুনে চলে গেল ফিল্ম-ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করতে। কলেজে দুজনেই খুব ভাল নাটক লিখে ছেলেমেয়েদের নিয়ে নানান নাটক করাত,তাই পুনে থেকে ফিরে টালিগঞ্জে রাজীব যোগ দিলেও অভিজ্ঞানের সঙ্গে যোগাযোগটা রয়েই গেছে।
অভিজ্ঞানের নাটকের নেশা ক্রমেই বেড়ে চলল, তাই এম.এস.সিতে ভাল রেজাল্ট করতে পারল না। গ্রুপ-থিয়েটারের জন্যে চাকরির প্রস্ততিও নিতে পারে না ভাল করে- চাকরি-বাকরিও একটা জুটছে না তাই কপালে। এই নিয়ে বাড়িতেও খুব অশান্তি। তবু অভিজ্ঞান নাটক ছাড়তে পারে না। নতুন একটা নাটক লিখছিল সে, হঠাৎ ঝড়ের মত ঘরে ঢুকে রাজীব অভিজ্ঞানকে বলল,
- তোর ধুতি-পাঞ্জাবী আছে?
- হ্যাঁ দাদুর ধুতি আছে, কিন্তু পাঞ্জাবী-হ্যাঁ হ্যাঁ দিদি তো ভাইফোঁটায় গতবার দিয়েছিল-পরাই হয়নি নতুনই আছে।
- তাড়াতাড়ি পরেনে।
- মানে?
- মানে মানে করিস না তো – পরে চল নাটক করবি।
- কি বললি? ঠিক শুনছি তো?
- হ্যাঁ হ্যাঁ একটা ক্যাবলাকান্ত ছেলের পার্ট করবি।
- কি বলছিস রাজীব? কি নাটক জানি না। পার্ট মুখস্থ করলাম না-নাটক করতে চলে যাব- এ তোদের টি.ভি. সিরিয়াল না কি যে সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিপ্ট লিখে টেক করে নিলেই হয়ে গেল।
- আরে আমার ডাইরেক্টর মৃদুলা ম্যাডাম তাঁর নতুন সিনেমার ক্যাবলা হিরো পাচ্ছেন না, তাই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন একটি গোবেচারী ছেলে খুঁজে আনার। তোকে হিরো হতেই হবে- তবে ক্যাবলাকান্তের মত সেজে যাবি আর অভিনয়টাও সেই মত করবি- তোকে বোঝানোর কিছু নেই, তুই পাকা অভিনেতা- এখন ক্যাবলা হয়ে ইন্টারভিউটায় বসে যা।
- কেন হিরো ক্যাবলা কেন?
- আরে বাবা পুরুষেরা পুরুষের মত, নারীরা নারীর মত এমন সিনেমা তো এতকাল হয়ে এসেছে। কিন্তু এখন এসেছে নতুন যুগ। এখন পুরুষেরা একটু শান্তশিষ্ট, গোবেচারি আর মেয়েরা একটু মারকুটে না হলে সেই সিনেমা পাবলিক খাবে কেন বল?
- তা মৃদুলা সেনের বই তো বেশ অন্য স্বাদের হয়, আমার তো বেশ লাগে।
- এই বইটা এক্কেবারে সাংঘাতিক অন্যরকম।
- একটু অন্তত আভাস দে, নাহলে-
- শোন তাহলে- বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে মারিয়া- একেবারে পুরুষ বিদ্বেষী- ছেলেদের দেখলেই চটে যায়- অনেক ছেলে অনেক চেষ্টা করেছে- কিন্তু মারিয়ার মনের নাগাল কেউ পায়নি।
অবশ্য এর জন্যে তার বাবাই দায়ী।
- কেন?
- বাবার অমানবিক অত্যাচারেই মারিয়ার মা সুইসাইড করেন- সেই সমস্ত অত্যাচার ছোট থেকে মারিয়া দেখে এসেছে-
- আর তাই সব পুরুষকেই সে বাবার মত ভাবতে শুরু করেছে।
- না পরে ধারণা পাল্টে যাবে- ঐ ক্যাবলা হিরোই মারিয়ার সবকিছু পাল্টে দেবে- তার ভালবাসার ছোঁয়ায় সে মারিয়াকে নতুন রূপ দেবে।
- কি করে সেটা সম্ভব হল?
- আরে সেটাই তো বলছি তোকে। দুর্দান্ত প্রতাপ বাবা তার পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে জোর করে মারিয়ার বিয়ে দিয়ে দেয়।
- তারপর- মারিয়া কি মেনে নিল সেই বিয়ে?
- মেনে নিতে বাধ্য হয় কারণ বাবার সম্পত্তি বাবার অবর্তমানে জামাই অর্ধেক আর ভবিষ্যৎ বংশধরের অর্ধেক পাবে এইভাবেই উইল করা আছে। বংশধরের আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত মারিয়া ঐ অর্ধেক সম্পত্তি সন্তান লালন পালনের জন্য ভোগ করতে পারবে শুধু।
- তা সন্তান হল কি মারিয়ার?
- আরে হবেটা কি করে? দুর্দান্ত বাপের দুর্দান্ত মেয়ে- সে তো ক্যাবলাকান্তকে পাত্তাই দেয় না; তার কাছেই ঘেঁসে না- তো ছেলেপুলে হবে কি করে? অথচ সম্পত্তিটাও বাগাতে হবে?
- তাহলে কি করল মারিয়া?
- ক্যাবলা স্বামীর সঙ্গে ভালবাসার অভিনয় করে তাকে নিয়ে ছুটল ডাক্তারের কাছে-
- কেন, ডাক্তারের কাছে কেন?
- আধুনিক চিকিৎসায় টেস্টটিউব বেবির জন্ম হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে স্পার্ম ভাড়া। মারিয়া স্থির করেছে স্পার্ম ডোনারের কাছে স্পার্ম ভাড়া নিয়ে কৃত্রিম উপায়ে ডক্টরের সাহায্যে তা তার শরীরে অর্থাৎ জরায়ুতে প্রবেশ করিয়ে সন্তান নেবে- আর ক্যাবলা স্বামীর সাহায্যেই সে তা করার চেষ্টা করে।
- তার স্বামীই বা মানবে কেন?
- দেখতে ক্যাবলাকান্ত হলে কি হবে ছেলেটি আসলে গবেষক। এইসব বিষয়ে তার প্রচুর পড়াশোনা আর জানাশোনা। গোপনে সেই স্পার্মটা ডোনেট করবে স্থির করে। সে মারিয়াকে প্রচণ্ড ভালবাসে- সে যাতে ভাল থাকে- তার জন্যে সে প্রাণও দিয়ে দিতে পারে-
- একেবারেই বোকারে- একেবারে বোকা পাঁ.........
- তারপর শোন না কি হল? আসল রহস্য তো এবার
- মানে?
- এতক্ষণ দর্শক তো শুধু হেসেই যাবে- এবার দর্শক মারিয়ার ব্যাথায় মোড়া অনুরাগের শিহরণ পাবে?
- কেন রে আবার এরমধ্যে মারিয়ার অনুরাগ কি করে এল?
- ডাক্তারের কাছে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সন্তান ধারণের উপযুক্ত মনে হলে তবেই তাঁরা মারিয়ার জরায়ুতে শুক্রাণু ইনজেক্ট করবেন, কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় ই.সি.জি করার সময় মারিয়ার হার্টের কিছু সমস্যা দেখা দিল।
- তারপর- তারপর কি হল- গল্প তো বেশ জমে উঠেছে রে-
- অনেক পরীক্ষার পর ধরা পড়ল যে মারিয়ার ধমনীর মধ্যে টিউমার হয়েছে। ওপেন হার্ট সার্জারী করে সেই টিউমার অপারেট করতে হবে- জীবন মরণ সমস্যা।
- এবার এই ক্যাবলাটাই ভরসা কি বল?
- ঠিক তাই- নায়ক উত্তম কাজেও উত্তম- সে সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে- সেবা যত্ন করে মারিয়াকে সারিয়ে তুলবে।
- তখন আর স্পার্ম ডোনারেরও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল কি বল?
- ঠিক তাই। মারিয়া অন্য মানুষ হয়ে গেল। দুজনের মিল হয়ে গেল। গল্পও শেষ হল।
চাকরি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত অভিজ্ঞানের গ্রুপ থিয়েটার করে আয় তো হয় না বরং পকেট খালিই হয়ে যায়- বাবার কাছে হাত পাততে বড় খারাপ লাগে। তাই অভিজ্ঞান ভাবল যে ভাবেই হোক এই ক্যাবলার রোলটা তাকে পেতেই হবে। তবু তো কিছু অর্থ সমাগম হবে আর তাই দিয়ে থিয়েটারের গ্রুপটা আর একটু শক্তপোক্ত করা যাবে।
ইন্টারভিউটাতে উতরে গেল অভিজ্ঞান। একবছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে মৃদুলা সেন ছবিটাকে তৈরী করলেন। ছবিটা বেশ নাম করল। মৃদুলা ক্রমশই বুঝতে পারলেন অভিজ্ঞান মোটেই ক্যাবলা নয়,বরং খুব বেশি স্মার্ট, সবটাই ওর নিখুঁত অভিনয়। চরিত্রের সংগে খুব বেশি রকম একাত্ম হয়ে অভিজ্ঞানের প্রাণ ঢালা অভিনয়ে বেশ খুশি হয়েই পরের ছবিতে স্মার্ট হিরোর ভূমিকায় তাকেই নির্বাচিত করলেন মৃদুলা। তারপর নিজের জীবন নায়ক হিসেবেও কি অভিজ্ঞানকেই মৃদুলা ভাবতে থাকলেন? আর অভিজ্ঞানও কি তাই ভাবছে? সেটাই তো স্বাভাবিক।
---------------------
ঠিকানা
ডঃ রমলা মুখার্জী,
বৈঁচি, বিবেকানন্দ পল্লী,
হুগলী, পিন ৭১২১৩৪
হোয়াটসঅ্যাপ- ৯৪৭৪৪৬২৫৯০
মোবাইল- ৭০০৩৫৫০৫৯৫
Sent from RediffmailNG on Android