বিজ্ঞপ্তি
লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫
নভেম্বর ২১, ২০২৪
আমাদের গ্রামটা ছিল তিনদিকেই জল দিয়ে ঘেরা। দু'দিকে নদী আর একদিকে খাল। খাল মানে ছোট নালা নয়, বেশ ভালোই চওড়া। এলাকাটা সুন্দরবন লাগোয়া। নাম সুখচর। আসল নাম শুকনো চর। পরে ছোট ও বদলে গিয়ে হয়েছে সুখচর। একসময় নদীরই অংশ ছিল এটা। নদী ক্রমশ উত্তরে সরে যাওয়ায় এদিকটায় একটা শুখনো চরের সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালের পরে কিছু সব হারানো উদ্বাস্তু এসে ঘাঁটি গড়ে এখানে। তখন খুব ভয় ও বিপদ সংকুল অঞ্চল ছিল সুখচর। জঙ্গল আর নদী দিয়ে ঘেরা এই এলাকা টায় একদিকে ছিল বাঘের ভয় আর অন্যদিকে কুমিরের। তবু আরো মানুষজন এলো। বসতি গড়লো। জঙ্গল ছোট হলো। গ্রাম সৃষ্টি হলো।আমাদের গ্রামে বেশির ভাগ মানুষ মাছধরা আর জঙ্গলের মধু সংগ্রহের কাজ করতো। অল্প কিছু চাষবাস হতো। তবে তা হাট অবধি যেতনা। গ্রামের ভিতরেই বিক্রি-বাটা হয়ে যেত। আসলে সাগর কাছে বলে এখানের মাটিতে নুনের ভাগ বেশি। তাই ফসল ভাল হতোনা।আমাদের গ্রামে একটাই স্কুল ছিল। সেটা প্রাইমারি স্কুল। ক্লাস ফোরের পর যেতে হতো ন' মাইল দূরে 'বাসন্তী'-তে। আমাদের একটা গ্রুপ ছিল। গোপাল ছিল আমাদের গ্রুপ লিডার। সবাই প্রায় সমবয়েসি। তাদের সকলেই যে স্কুলে যেত তা নয়। অনেকেই তার বাবার সাথে মাছ ধরতে বা মধু সংগ্রহের কাজে যেত। আমাকে কিন্তু রোজ স্কুলে যেতে হতো। কারণ হলো আমার মামা। আমার মামা কলকাতায় ট্রাম কোম্পানীতে কাজ করতেন। মামা আমার বাবাকে বলেছিলেন "ছেলেকে লেখাপড়া ছাড়াবেনা। আট ক্লাস পাস করাও, তারপর দীপুকে ভালো জায়গায় লাগিয়ে দেব"তখন আমি সবে ক্লাস ফোরে উঠেছি। একবার গোপাল দিন দশেকের জন্য উধাও হয়ে গেল। তেমন কোনো খোঁজ পাওয়া গেলনা। ওর জন্য আমাদের আড্ডা আর হৈ্ হৈ্ কেমন যেন মিইয়ে গেল। আমরা জলের দেশের ছেলে। তাই আমাদের সব খেলা, সব হই্চই্ , সব আনন্দ-- সব ওই জলের মধ্যেই। আর গোপাল ছাড়া জলে ঘোরা অসম্ভব। গ্রামে একমাত্র গোপালদের তিনটে নৌকা ছিল। একটা ডিঙি, একটা মাঝারি আর একটা ইঞ্জিন টানা বড় । গোপাল থাকলে ডিঙি নয়তো মাঝারিটা নিয়ে রোজই ঘোরা যায়। জলেই জীবন বলে আমরা সবাই নৌকা বাইতে পারি। তবে গোপালের মতো নয়। ওর ভয়্ডর্ নেই। ছোট থেকেই বাবার সাথে নৌকায় গিয়ে, ওর কাছে নদী যেন খেলার মাঠ। ওর বাবা অষ্টু মাঝি ছিল এই সুন্দরবন অঞ্চলের সেরা মাঝি। প্রচুর খাটতে পারতো। লোকে বলতো "অষ্টু মাঝিকে নাকি কেউ কোনদিন ঘুমোতে দেখেনি"দশদিন পরে গোপাল স্কুলে এলো গলায় একটা কি একটা যন্ত্র ঝুলিয়ে। সিনেমা পার্টির একজন গোপালকে দিয়েছে যন্ত্রটা। যন্ত্রটা দিয়ে অনেক দূরের জিনিস একদম চোখের কাছে চলে আসে। আমাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গেল যন্ত্রটা দেখার জন্য। কখন যে হেড মাস্টার মাহাতো বাবু ঘরে ঢুকেছেন বাংলা ক্লাস নিতে, তা টেরই পাইনি। যখন টের পেলাম তখন যন্ত্রটা শূন্যে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেছে মাস্টার মশাই এর বসার চেয়ারের দিকে।মাহাতো বাবু কিছুক্ষন যন্ত্রটা দেখেশুনে মন্তব্য করলেন যে, এই যন্ত্রটা খুব ভালো মানের। গোপালের কাছে জানতে চাইলেন কি করে সে পেল এটা।"সিনেমা পার্টির একটা ভালো লোক আমাকে এটা দিয়েছে। লোকটার নাম কনমবাস। একটা বড় নৌকার মাস্তুলের কাছে কোমরে হাত দিয়ে রোদ্দুরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। আর অন্য নৌকা থেকে একজন লোক মুখে মাইক নিয়ে 'ওকে কাট' বললেই অমনি একটা ঘরে ঢুকে আরাম করতো" -- সেদিন গোপাল এইভাবেই বলেছিল যন্ত্র ও সেটার দাতার ইতিহাসটা ছোট্ট করে।সেদিন মাহাতো বাবু আর বাংলা পড়িননি। সেদিন আমরা প্রথম জেনেছিলাম, শুটিং আর পরিচালক মানে কি। জেনেছিলাম হান্স্-লিপারসে্ ও গ্যালেলিও এবং দূরবীনের কথা। আর জেনেছিলাম কলম্বাস নামের একজন খামখেয়ালী মানুষের কথা, যার নেশা ছিল অজানা সাগরে পাড়ি দিয়ে নতুন নতুন দ্বীপ বা ডাঙা আবিষ্কার করা।সেদিনের আরো একটা মনে আছে। মাহাতো বাবুর কথা শেষ হবার পর গোপালের ওই কথাটা। সেটা হল -- "সিনেমা পার্টির ওই লোকটা তাহলে তো খুব বোকা। ওর কাছেই তো যন্ত্রটা ছিল, তবু চোখের উপর হাতদিয়ে ছাউনি করে খালি চোখে ডাঙা খুঁজছিল। বোকা না হলে অমন কেউ করে?"মাহাতো বাবু বলেছিলেন "আসল কলম্বাস যখন সাগর অভিযানে যেতেন, তখনও 'দূরবীন' আবিষ্কার হয়নি। তাই আসল কলম্বাসের সঙ্গে দূরবীন যন্ত্রটা ছিল না।দূরবীন আর কলম্বাস শব্দ দু'টো আমাদের খেয়ালী গোপালকে আরো খামখেয়ালী করে তুললো। নিজেকে কলম্বাস বলে ঘোষনা করলো। আর গলায় ঝোলানো দূরবীনটা হলো ওর রাত-দিন, সব সময়ের সঙ্গী। এখন গোপাল মানেই কলম্বাস আর গলায় ঝোলানো দূরবীন।এখন ছুটির দিনে আমরা গোপালের নৌকায় শুধু ঘুরে বেড়াইনা। এখন আমরা কলম্বাসের নৌ অভিযানের সঙ্গী। মহা উৎসাহে চললো কলম্বাসের অভিযান। কলম্বাস নিজে নৌকা চালায় না। সে শুধু চোখে দূরবীন দিয়ে নতুন ডাঙা আবিষ্কার করে। শুধু মাঝে মাঝে নৌকাটা নদীর পাগলা ঢেউ আর বড় ঘূর্ণির ভিতরে তলিয়ে যাবার উপক্রম হলে কলম্বাস ওর দক্ষ হাতে হাল ধরে অনায়াসে সামলে দেয় সব বিপদ। বিপদ কাটলেই কলম্বাস আবার দূরবীন নিয়ে আবার খোঁজে ডাঙা।অনেক নতুন ডাঙাই আবিষ্কার করেছিল আমাদের কলম্বাস। কিন্তু কোনো টাই অনাবিষ্কৃত নয়। সেটা অবশ্য আমরা কলম্বাসকে বলিনি। বরং উৎসাহ আর অভিনন্দন জানিয়ে ছিলাম। কারন ওটা না করলে আমাদের নৌকায় ঘুরে বেড়ান বন্ধ হয়ে যাবে। তবে আমরা না বললেও ওখানকার মানুষ গুলো ওর ভুল ধরিয়ে দিয়েছিল। আসলে সব নতুন ডাঙার মানুষ গুলোর প্রশ্নে, আমাদের কারো না কারো চেনা মুখ ঠিক বের হয়ে যেত। অনেক সময় গোপালেরও চেনা-জানা বেরিয়েছে। যেমন, কলম্বাসের আবিষ্কার করা দ্বীপ(ডাঙা) থেকে একজন বলেছিল-- "তুই গোপাল তো? অষ্টু মাঝির ছেলে তো? হ্যাঁ, ঠিক চিনছি। তোর গলায় ওটা কি ঝুইলেছিস ? তোর বাপ কে বলবি, নয়াচরের নিমাই খুড়ো দেকা করতে কয়েছে।"এতো সবের পরেও কিন্তু আমাদের কলম্বাসের উৎসাহে কোনো খামতি এল না। একবার এক ছুটির দিনে আমরা নৌকা নিয়ে উত্তর-পূবে অনেকটা চলে গিয়েছিলাম। এদিকটায় আমাদের কলম্বাস ছাড়া আর কেউ আমরা আসিনি। এদিকের নদী, সাগরের মতো চওড়া। দু'দিকের পাড় দেখা যায়না। নদী এদিক দিয়েই সোজা গিয়ে সাগরে মিশেছে। নৌকা চলেছে কলম্বাসের নির্দেশে। নৌকাটা বারবার বড় ঢেউ আর ঘূর্ণিতে পড়ছিল। একসময় কলম্বাস নিজে হালে বসলো। নৌকা চলতে লাগলো একটা নির্দিষ্ট দিকে। জল ছাড়া আর অন্য কিছুই চোখে পারলনা। আমাদের এবার একটু ভয় লাগলো। ভয় হলো যদি সাগরে গিয়ে পড়ি।আমি গোপালকে বললাম "নৌকো ফেরা, নাহলে সাগরে গিয়ে পড়বে নৌকা"কলম্বাস বললো "সামনে দেখ। ডাঙা দেখতে পাবি"আমি কিন্তু জল ছাড়া অন্য কিছুই দেখতে পেলামনা। ও কে বললাম সে কথা। কলম্বাস ওর দূরবীনটা এগিয়ে দিয়ে বললো "দেখতো, ডাঙা দেখতে পাস কিনা"আমি দূরবীনটা দিয়ে দেখলাম, দূরে সত্যিই ডাঙা দেখা যাচ্ছে। একটা নয়, অনেক গুলো ডাঙা যেন মালার মতো গাঁথা আছে।কোনো নৌকা বা ঘাট কিছু না পেয়ে, নৌকাটা একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে আমরা ডাঙায় নামলাম। পাড়ে উঠে কোনো মানুষজন বা ঘর বাড়ি কিছুই নজরে এলোনা। একটু অপেক্ষা করে বুঝতে চাইলাম বাঘের ডেরায় এসেছি কিনা। পাখির স্বাভাবিক শব্দে অনুমান করলাম বাঘের কোনো ভয় নেই। একটু এগোতেই একটা ছোট ফাঁকা জায়গায় কিছু মুরগি চড়তে দেখলাম। কলম্বাস সবাইকে থামতে বলে আমার হাত ধরে একটু ঘুর পথে এগোতে লাগলো মুরগি গুলোর কাছে। তারপর আমাকে থামিয়ে ও নিজের জামাটা খুলে শিকারি বেড়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো মুরগির পালের মধ্যে। পরক্ষনেই কানে এলো "এই কে রে..। আমার মুরগি চুরি করছে। ধর.....ধর...ধর"ধর বললেই কি কলম্বাসকে ধরা যায়। সেটা সম্ভব নয়। কলম্বাস তখন 'বস্তু'টাকে জামায় জরিয়ে ছুট লাগিয়েছে নৌকার দিকে, ওর পিছনে আমিও। আর আমার পিছনে "ধর... ধর...মুরগি চোর..." ইত্যাদি শব্দ করে ছুটে আসা একদল লোক। আমাদের বাকি সঙ্গীরা হওয়া বুঝে আগেই গিয়ে বসেছে নৌকায়।কলম্বাস নৌকায় উঠেই জামাটা চালান করেদিল আমার হাতে। নিজে বসলো হাল টানতে। নৌকাও কিছু বোঝার আগে তিনটে পাক খেয়ে চলে এলো মাঝনদীতে। আমাদের ধরতে আসা লোক গুলোর নাগালের বাইরে।নৌকা আমাদের গ্রামের ঘাটে বাঁধবার আগেই মুরগি রান্না করে খাওয়া হয়ে গেছে আমাদের। জেলে নৌকায় রান্না করার মোটামুটি সব সরঞ্জাম থাকে। তাই দিয়ে রান্না করা মুরগির সেই স্বাদ আজ এত বছর পরেও যেন মুখে লেগে আছে। কিন্তু তার দাম চুকিয়ে ছিলাম ঠিক তার একদিন পরেই।পরদিন সকালেই ঘটনাটা জানাজানি হয়েগেল। মুরগির মালিক গোপাল আর অষ্টু মাঝির নৌকা, দু'টোই ঠিক চিনেছিল। সকাল বেলা গোপালের বাপের কাছে নালিশ জানাতে এসে গোটা গ্রামকে শুনিয়ে গেছে ঘটনাটা। গোপাল আর নৌকা-- এই দু'টো শব্দই বাকি অপরাধী ধরার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমাদের সবার কপালেই জুটে ছিল তাদের বাপের বরাদ্দ করা শাস্তির কোটা। আমিও মার খেয়েছিলাম কম নয়। সেদিন দুপুরের মধ্যেই আমরা জেনে গিয়েছিলাম যে, কার ভাগে কতগুলো আর কি কি পড়েছে। শুধু একজনেরই খবর পাওয়া যায়নি, সে হলো কলম্বাস। শুনলাম সে ভোর বেলায় ওর বাপের সাথে নদীতে নৌকা নিয়ে বেরিয়েছে।তখন অনেক রাত। ঘরে আমরা সবাই গভীর নিদ্রায়। হঠাৎ দরজায় দুম দাম শব্দে আমাদের ঘুমটা ভেঙে গেল। বাবা গিয়ে দরজা খুলল। খালি গায়ে, দু'হাতে বুকের কাছে দূরবীনটা লুকিয়ে নিয়ে গোপাল সবেগে ঘরে ঢুকে সোজা খাটে উঠে আমার মায়ের কোলে মাথা দিয়ে কাঁদতে লাগলো। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম বেশ জ্বর। গোটা পিঠে লাঠির দাগগুলো যেন, অনেক গুলো সাপ লম্বা হয়ে শুয়ে আরাম করছে। মা সারা রাত ধরে গোপালের সেবা করলো। পরে গোপাল বলে ছিলো ওর পিঠের দাগের রহস্য। সেদিন সব শুনে অষ্টু মাঝির যতটা না রাগ হয়েছিল গোপালের উপর, তারথেকে অনেক বেশি রাগটা গিয়েছিল ওর ওই গলায় ঝোলানো যন্ত্রটার উপর। কেড়ে নিতে চেয়েছিল ওটা। কিন্তু পারেনি। সেদিন বুকের কাছে লুকিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে নিজের প্রিয় যন্ত্রটা বাঁচিয়েছিল কলম্বাস। যন্ত্রটা না পেয়ে সেদিন কলম্বাসের পিঠেই তিনটে মোটা লাঠি ভেঙেছিল অষ্টু মাঝি।পরের দিন বেলায় অষ্টু মাঝি ছেলের খোঁজে আমাদের বাড়ি এলো। সঙ্গে আরও দু'জন লোককে নিয়ে। আমার মা, গোপালের বাবাকে দেখেই একটা চ্যালা কাঠ নিয়ে পেটাতে লাগলো। আশেপাশের আরো বাড়ির লোকজন মা'কে উৎসাহ দিতে লাগলো। আসলে মা মারা গোপালকে গ্রামের সকলেই খুব ভালো বাসতো। আর, গোপাল আমার মা'কে মা বলে ডাকতো। তাই সেদিন অষ্টু মাঝি চ্যালা কাঠের মার খেয়েও ছেলেকে ফেরত পেল না। ভয়ে পালিয়ে বাঁচলো।দু'দিন পর আবার এলো গোপালের বাবা। আমার মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে ছেলেকে ফেরত নিয়ে যেতে। বললো "সেদিন ভরা হাটে সববার সমুখে কালু দুলে আমাকে চোর বললে। আমিই নাকি ছেলেকে মুরগি চুরি করতি পাটাই। আমরা বাপ ব্যাটা দু'জনেই চোর। ওসব শুনে মাথাটা ঠিক রাখতে পারিনি। এবারের মতো মাফ করে দেন দিদি। আর কনু দিন এমনটা হবেনি। আমি নিজেও এই দু'দিন কিচ্ছুটি মুখে তুলিনি"কলম্বাসের শরীরটাও এই দু'দিনে বেশ ভালো হয়ে গেছে। মা'য়ের রাগ ও আর আগের মতো নেই। গোপাল নিজেও তার বাবাকে খুব ভালোবাসতো। তাই গোপালও চলে গেল ওর বাবার সাথে।গোপালের বাবার আগে আমার বাবা মারা গিয়েছিল। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। একদিন আমাদের গ্রামের হারান কাকা সঙ্গে আরও একজনকে নিয়ে হাজির হলো বাসন্তীর স্কুলে। তখন আমাদের অঙ্কের ক্লাস নিচ্ছিলেন রমেন বাবু। এমন সময় স্কুলের পিওন এসে রমেন বাবুকে একটা চিরকুট দিলো। রমেন বাবু ওটাতে চোখ বুলিয়ে আমার নাম ধরে ডাকলেন। আমি উঠে দাঁড়াতেই বললেন "আজ তোমায় ছুটি দিয়ে দিলাম। তুমি বাড়ি চলে যাও"জলা-জঙ্গলের ছেলে আমি। তাই একটা খটকা লেগেছিল। রাস্তায় হারান কাকারা কিছুই বলল না।বাড়ি এসে দেখলাম, উঠোনে খড়ের বিছানায় বাবার শরীরটা একটা চাদরে ঢাকা দিয়ে শোয়ানো। বাবার ঘাড়টা যেন বুকের কাছে ঝুলে আছে। পরে শুনেছিলাম মধু সংগ্রহে গিয়ে বাঘের শিকার হয়েছে বাবা। প্রথমে ঘাড়ে কামড় বসিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে জঙ্গলের গভীরে। ওতেই বাবার ঘাড়টা অর্ধেক আলাদা হয়ে যায় বাকি শরীর থেকে। এরপর মানুষের তাড়া খেয়ে শুধু ডান পা'টা শরীর থেকে ছিঁড়ে নিয়ে পালিয়ে যায় জঙ্গলের আরো গভীরে।এর পরের ঘটনা গুলো কেমন যেন খুব দ্রুত ঘটে গেল একটা আবঝা ঘোরের মধ্যে দিয়ে। ঘোর যখন কাটলো তখন আমি বাসন্তীর খেয়া ঘাটে আমার মামার সাথে। গন্তব্য কোলকাতা। আমার পিঠোপিঠি এক দিদি আছে। আমিই আমার বাবার একমাত্র ছেলে। তাই বাবার অবর্তমানে সংসার নামের চাকা বিহীন রথ-- যে এবার আমাকেই টানতে হবে, তা আমি এই ক'দিনে জেনে গেছি। সেদিন আমাদের বেশ কিছু সঙ্গী সাথীকে নিয়ে কলম্বাস এসেছিল আমাকে বিদায় দিতে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল "তুই এখান নিয়ে চিন্তা করবি না। তোর মায়ের এক ছেলে এখানে আছে। কলম্বাস আছে। এখানটা আমি সামলে দেব"আমি কোলকাতায় এসে ট্রাম কোম্পানীর কাজটা পেলামনা। কারন আমি এইট পাস নই। দিন কুড়ির মধ্যে আমার জন্য একটা কাজ মামা জুটিয়ে দিল। কোলকাতা নয়, আরো দূরে ধানবাদে। রেল কোম্পানীর অফিসে ছোকরার কাজে।আমার মা অল্প কিছু লেখাপড়া জানতো। কলম্বাস যে তার কথা রেখেছিল তা মা'য়ের চিঠি থেকেই জানতে পারতাম। মানি অর্ডারের প্রাপ্তি পত্রের প্রতিটাতেই গলায় দূরবীন ঝোলান কলম্বাসের কথা থাকতো। ও সত্যিই আমাদের সংসারের সব দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। আমি তো শুধু মাত্র টাকা পাঠাতাম। নতুন জায়গা আর কাজে ডুবে গেলাম। ক্রমে নিজের বাড়ির চিন্তা একদম কমে গেল। মনের ভিতর একটা নিশ্চিন্ত ভাব আসতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে একটু আধটু চিন্তা এলে মনকে বোঝাতাম-- ওখানে কলম্বাস আছে। কলম্বাস তো আছেই।তিন বছর পর ধানবাদ থেকে বাড়ি গেলাম। উপলক্ষ দিদির বিয়ে। দেখাশোনা সব মিটে গেছে। শুধু অনুষ্ঠানটাই বাকি। বাড়ি আগেও যেতে পারতাম। কিন্তু মামার নিষেধ ছিল। মামা বলতেন "আমি না বললে বাড়ি যাবি না। ঘনঘন বাড়ি গেলে কাজে মন বসাতে পারবিনা"ধানবাদ থেকে কলকাতায় একদিন থেকে তারপর গিয়েছিলাম গ্রামে। দিদির বিয়ের অনেক কিছু জিনিসপত্র কিনেছিলাম কোলকাতা থেকে। একটা ভালো দূরবীন নিয়েছিলাম কলম্বাসের জন্য।আমি বাড়ি যাওয়াতে সবাই খুব খুশি। পুরোন বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে দারুন লেগেছিল। শুধু একজনকেই পেলাম না আড্ডায়। সে হলো কলম্বাস। কার দিদির বিয়ে, সেটা কলম্বাসকে দেখে অনুমান করাই দায়। আমি যেন অতিথি। আমার হাতে অঢেল সময়। কিন্তু গলায় দূরবীন ঝোলান কলম্বাসের কাজের শেষ নেই। একা হাতে চরকির মত ঘুরে সব সামলাচ্ছে। যেমন করে সামলাতো নদীর সেই পাগলা ঢেউ আর বড় বড় ঘূর্ণি। তবে দূরবীনটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল গোপাল। যন্ত্রটা যখন চোখে লাগিয়ে দেখছিল, তখন মনে হচ্ছিল 'সেই পুরোনো কলম্বাস'।ধানবাদ ফিরে এসেছিলাম একদম দায়হীন মন আর একরাশ গর্ব নিয়ে। আমার গ্রাম, আমার গ্রামের মানুষ, আমার গ্রামের বন্ধু ও বিশেষ করে কলম্বাসের জন্য -- অনেক ও অনেক গর্ব অনুভব হচ্ছিল আমার। এরপর নিজেকে পুরোপুরি মিশিয়ে দিলাম সময়ের স্রোতে। দিন,মাস,বছর সব এগিয়ে গেল নদীর স্রোতের মত দ্রুত থেকে দ্রুততর।বছর চারেক পর মায়ের চিঠিতে জানলাম যে, কলম্বাসের বাবা সাপের কামড়ে মারা গেছে। সঙ্গে আরও একটা ছোট চিঠি। সেটা মা'য়েরই হাতে লেখা। কিন্তু বয়ান টা কলম্বাসের। কলম্বাস বলছে " দীপু তোকে এখন আসতে হবেনা। বাবা তো আর নেই। দেহটাও পুড়ে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে গেছে। আমিও এখন তোদের বাড়ি থাকি। তুই এলে তোর কাজের ক্ষতি হবে। কিন্তু কোনো লাভ হবেনা। তুই এলে পুজোয় আয়। আমার দূরবীনটার একটা কাঁচ ভেঙে গেছে। তুই একটা নতুন আনবি।"চিঠির তারিখ বলছে সেটা ন'দিন পুরোন। সেবার পুজোয় বাড়ি যাবো ঠিক করলাম। যাবার তিনদিন আগে ভোর বেলা হটাৎ খাটটা খুব জোরে দুলে উঠলো। আর তারপর অনেক মানুষের একসাথে চিৎকার। বুঝতে পারলাম ভূমিকম্প হচ্ছে। বড় রকমের ভূমিকম্প।সব কিছু যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কানে আসতে লাগলো সমুদ্রের তলায় হয়েছে ভূমিকম্পটা। অনেক দেশে অনেক ক্ষতি হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। আমাদের দেশেও ক্ষতি হয়েছে। অনেক খারাপ খবর এলো রেডিওর টুকরো খবরে। বহু নদী ব্রিজ আর রেল লাইন চলে গেছে জলে ভেসে। সবথেকে খারাপ খবর দক্ষিন ভারত, উড়িষ্যা আর বাংলার। মনটা ছটফট করলেও গ্রামের কোনো খবর পাওয়া গেলনা। তার কোনো উপায়ও নেই। ভগবান যেন খেলার ছলে গোটা পৃথিবীকে আলাদা আলাদা, ছোট ছোট দ্বীপে ভাগ করে দিয়েছে। সবাই সবাইয়ের সাথে বিচ্ছিন্ন। কেউ কারো খবর জানতে পারছে না।একুশ দিন পর কখনো লরি বা বাস, আবার কখনো গরুর গাড়ি নয়তো পায়ে হেঁটে পৌঁছলাম কোলকাতায়। মামাকে পেলাম কিন্তু আমার মা, কলম্বাস বা গ্রামের কোনো খবর পেলাম না। আমাদের গ্রামে যাবার কোনো উপায় নেই। সরকার আর সেনা বাহিনী ওদিকে যেতে দিচ্ছেনা। এটুকু শুনলাম সুন্দর বন ধ্বংস হয়ে গেছে।আরো দশ দিন ঘোরাঘুরি করে আমার ধানবাদ অফিসের বড় সাহেবের এক চেনা মানুষকে খুঁজে বের করলাম। মানুষটি সরকারী অফিসের এক বড় অফিসার। ওনার পা ধরে কেঁদে ফেললাম। অনুরোধ করলাম একবার আমার গ্রামে যাওয়ার অনুমতি করিয়ে দেওয়ার জন্য।একটা সরকারী মেডিক্যাল টিমের সাথে টানা চারদিন ও এগারোটা রেসকিউ ক্যাম্প ঘুরেও মা বা কলম্বাসের কোনো খোঁজখবর পেলাম না। ক্যাম্প গুলোই তখন সুন্দরবনের ক্ষতিগ্রস্তদের বর্তমান ঠিকানা। কিছু চেনা মুখ অবশ্য পেয়েছিলাম। কিন্তু তাদের অসহায়, করুন আর আতঙ্কিত চোখ গুলোর দিকে তাকিয়ে আমি নিজেই হয়ে গেছিলাম ওদেরই মতো অসহায় একজন। আলাদা করে আর নিজের মা'য়ের কথা জানতে পারিনি ওদের কাছে।পঞ্চম দিনে লাস্টের ক্যাম্পটায় পেয়েছিলাম কালু রুদাসকে। আমাদের ছোটবেলার কলম্বাসের নৌ অভিযানের সঙ্গী। কালু সব হারিয়ে তখন পুরো একা। দেখেছিলাম কেমন করে একটা সব হারানো মানুষ নিজে সান্তনা দিচ্ছে অপরকে। চেনা নদী ওর দু'বছরের ছোট্ট ছেলেটাকে রেহাই দেয়নি। আমাকে জড়িয়ে ধরে ছোট শিশুর মতো অনেক কেঁদেছিল সেদিন কালু।ওর মুখেই শুনেছিলাম যে, আগের রাতে কলম্বাস, কালু ও আরো দু'জন সাগরে গিয়েছিল মাছ ধরতে। ভোর বেলা মাছধরে ফেরার সময় যখন ওরা সাগর ছেড়ে নদীতে, তখন হঠাৎ সাগর যেন খুব জোরে টান মারে নদীকে। যেন সাগরে একটা বিরাট গর্ত হয়েছে। আর নদীর জল ছুটে চলেছে ওই গর্তের দিকে। তার অল্প পরেই আসে উল্টো স্রোত। অনেক জল সাগরের দিক থেকে তালগাছ উচুঁ হয়ে ছুটে আসে সামনের দিকে। ইঞ্জিনে ছিল কলম্বাস। ও ইঞ্জিন বন্ধ করে আমাকে নিয়ে বসলো হালে। বাকি দের বললো জল ছেঁচতে। ঢেউ গুলো ফনা তুলে বার বার ছোবল মারছিল নৌকায়। কলম্বাসের কথা মত ওরা শুধু নৌকাটাকে স্রোতের সঙ্গে সমান তালে পাক খাওয়াচ্ছিল। দু'দিন জলে ঘুরপাক খেয়েও কোনো ডাঙা দেখতে পায়নি। চারদিকে শুধু জল।দু'দিন পর একটা সরকারী জাহাজ ওদের বাঁচায়। ক্যাম্পে নিয়ে আসে। ওরা সব ক্যাম্প খুঁজল। বিশু আর মধু ওদের বাড়ির কিছু মানুষকে পেল। কিন্তু কলম্বাস আর কালু ওদের নিজের মানুষদের কোথাও খুঁজে পেলনা। কলম্বাস জেদ ধরেছিল গ্রামে যাবার। কিন্তু পুলিশ যেতে দিয়নি। ওই রাতেই কলম্বাস নিখোঁজ হয়ে যায়। কালুর ধারনা ও গ্রামেই গেছে।আমি যে মেডিক্যাল টিমটার সাথে ছিলাম, সেখানের বড় সাহেব ছিলেন একজন অবাঙালি। আমি ওনার জন্যই এই টিমের সাথে ঘুরতে পারছিলাম। ওনাকে গিয়ে বললাম সব। উনি খোঁজ খবর নিয়ে জানালেন সুখচর গ্রামটার সত্তর ভাগ এখন নদীর তলায়। ও গ্রামে কেউ নেই। যারা বেঁচে ছিল তাদের সবাইকে এনে রাখা হয়েছে। এখানের বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। ওখানে যাওয়ার পারমিশন নেই। কিছুতেই কিছু করা গেলনা। কালুর সাথে পরামর্শ করে ঠিক করলাম নৌকা চুরি করে পালাব। রাতে নৌকা চুরি করে পালাতে গিয়ে সেনার হাতে ধরা পড়লাম।সেনা বাহিনীর অফিসার সব শুনে কথা দিলেন পরদিন একটা রেসকিউ বোট পাঠাবেন। আমরাও যাবো তাতে।পরের দিন যখন বোটটা লাগলো সুখচরের মাটিতে, তখন বুকটা যেন ফেটে গেল। গ্রাম বলে কিছুই নেই। উত্তরে সরে যাওয়া নদী আবার সরে এসে আবার ফিরিয়ে নিয়েছে তার দান করা ডাঙা। প্রচন্ড খিদেয় এক কামড়ে খেয়ে নিয়েছে সুখচর নামের গ্রামকে। শুধু অল্প কিছু শুকনো ডাঙা ফেলে রেখেছে মানুষের চোখের জলে ভেজানোর জন্য। সত্যিই আমরা আর জল ছাড়া আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব অনুভব করলাম না এখানে। কলম্বাসের কোনো চিহ্ন পেলামনা।হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে অবশিষ্ট সুন্দরী গাছের জঙ্গলটার দিকে গিয়েছিলাম। চেনা কিছুকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। একটু কাছে যেতে যেন মনেহল একটা গাছের গুঁড়ি দূরবীন চোখে দাঁড়িয়ে আছে। কালুকে ডেকে দৌড়ে গেছিলাম ওদিকে।জল কাদা মাখা কলম্বাসের পাথরের মতো স্থির মূর্তিটা চোখে দূরবীন দিয়ে একমনে খুঁজে চলেছে তার মা, নিজের ঘর আর তার নিজের চেনা ডাঙা। আমাকে দেখেই ওর দূরবীনটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল " দেখতো, ডাঙাটা দেখতে পাস কিনা"সেদিন কলম্বাস আবার আমাদের ফাঁকি দিয়ে বোট থেকে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে গেছিল। আজও হয়তো এক উল্মাদ চোখে দূরবীন দিয়ে সুখচরের জলে জলে খুঁজে চলেছে তার হারানো ডাঙা। দেখা হলে নাম জিজ্ঞেস কোরো। হয়তো উত্তর পাবে, "আমি কলম্বাস"
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
------------------------------
Samiran jan RoyVill-Gopal Nagar. P.O-Par Gopal Nagar. P.S- Singur. Dist- Hooghly. Pin - 712407Phone and Whatsapp No :- 9732470703
samiranjanroy.