ছোটগল্প ।। পিরামিড।। ঋভু চট্টোপাধ্যায় ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;
সরাসরি মা বা বাবাকে তো জিজ্ঞেস করা যায় না,'তোমরা কি সব চুপিচুপি আলোচনা করছিলে?' বাবা চুপ থাকলেও মা হয়ত রেগে যাবে।তাই জানার ইচ্ছে থাকলেও চুপ করেই থাকতে হল।কয়েকদিন পরেই অবশ্য সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। স্কুল থেকে ফেরবার সময় কমার্স সেকসেনের অমৃতা বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলল,'কিরে খবরটা দিস নি তো?'
কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল রূপা।চয়ন মানে চাঙ্কির সাথে ঘোরাঘুরি নিয়ে অনেকেই জিজ্ঞেস করে।রূপা উত্তরও দেয় আবার দেয়ও না, তবে অমৃতাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করে,'কোন খবরটা রে?'
-সেকিরে, তোর নাকি ভাই বা বোন হবে।বেশ ভালো, তবে এজ গ্যাপটা একটু বেশি হয়ে যাবে।
রূপা এবার বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,'কি বাজে বকছিস?'
-বাজে নয় কাজের কথাই বলছি, তুই খবর না দিলেই বা আমি ঠিক খবর পেয়ে গেছি।কবে ট্রিট দিবি বল?
আকাশ থেকে পড়ল রূপা, চারপাশটা দেখে গম্ভির ভাবেই বলে উঠল,'তোকে কে বলল?'
-মা, বাবা আলোচনা করছিল।আমি শুনেছি, তোর মা আমার মাকে বলেছে।
সব শুনেও রূপা কিছু সময় কোন কথা বলতে পারল না।রাস্তার একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, তাহলে গুজুর ফুসুর মানে এই সব।কয়েক সপ্তাহ আগে বাবা অফিস কামাই করে মা কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছিল, তারমানে ভিতরে ভিতরে এতদূর সবকিছু হয়ে গেল, আর কিছুই জানা গেল না।নিজের ওপরেই রাগ হল রূপার।অমৃতাকে বলল,'আমার একটু তাড়া আছে।'তারপরেই তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।বাড়ি পৌঁছে নিজের ঘরে ঢুকতেই চোখ ফেটে জল এল।কারোর সাথে কোন কথা না বলে দরজা বন্ধ করে সন্ধে পর্যন্ত বসে রইল।মাঝে মা কয়েকবার এসে 'কি হয়েছে, কেন এমন করছিস?' এসব জিজ্ঞেস করল।স্কুলে বা টিউসনে কোন কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল।রূপম নামের সেই ছেলেটা আর কোন বিরক্ত করছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করল।সব প্রশ্নেরই এক উত্তর,'না কিছু হয় নি, কেউ কিছু করেনি, তুমি যাও।' সন্ধের পর বাবা এসেও জিজ্ঞেস করল,কিন্তু এবারেও উত্তর পেল না।
সমস্যা আরো বাড়ল।খেতে বসবার সময়।রূপা প্রথমে তো আসতেই রাজি হচ্ছিল না।পরে বাবার কথা শুনে খাবার টেবিলে এলেও খাবার নিয়ে বসে রইল।বাবা-মা দুজনে গিয়ে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে রূপার দু'চোখ দিয়ে জল নেমে এল।কিছুসময় পর রূপা কাঁদতে কঁদতেই বলে উঠল,'আমার নাকি ভাই বোন কিছু একটা হবে?'
-কে বলল তোকে?কথাটা মা কিছুক্ষণ চুপ থাকবার পর বলল।
-কে বলল জানতে হবে না।সত্যি না মিথ্যা সেটা বল।বাবা এবার লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল,'হ্যাঁ, চারমাস চলছে।'
-আর ইউ ম্যাড, অর সেভজ ইললিটারেট?
মা কোন উত্তর না দিয়ে গালে এক চড় কষিয়ে দিল।আচমকা আসা এই আঘাতে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও কিছুসময় পরেই গালে হাত বোলাতে বোলতে বলে উঠল, 'আমাকে চড় মারলে, কিন্তু পাড়ার সবাই, ফ্ল্যাটের সবাই?ছিঃ ছিঃ করছে তোমাদের।ক'জনকে চড় মেরে মুখ বন্ধ করবে।'
সেই রাতে আর কারোরই খাওয়া হল না।পরেরদিন সকালে উঠেই বাবা রূপাকে চায়ের টেবিলে ডেকে বলল,'দেখ তুই বড় হয়ে গেছিস, আজকের যুগের মেয়ে, আসলে ঘটনাটা খুবই সাডেন, এমনকি তোর মা পর্যন্ত বুঝতে পারেনি।'
-বোকা বোকা কথা বল না বাবা, তুমি বুঝতে পারোনি, দ্যাটস ওকে, বাট মা!
-তোর মায়ের একটা প্রবলেম আছে সেটা তো জানিস।তোর সাথে ডাক্তারও দেখাতে গেছিল।
-আমি বুঝতে পেরেছি কি পারিনি, সেটা তোকে বলব না, তোর আমি ইয়ার দোস্ত না। আমরা মা-কাকিমাদের কখনও এই সব কথা বলবার সাহস পেতাম না।
-তোমাদের কথা আলাদা মা।
-আলাদা মানে কি? মা-বাবার সাথে এই সব কথা বলা?
-তোমরা কি এই সব কথা বলবার জন্য আমাকে ডাকলে, তাহলে আমি আসছি, কাজ আছে।
-কাজ মানে তো ফোনে ফটর ফটর করা।
-আমার এটাই বয়স।যে বয়সে যেটা মানায়, সেটাই করতে হয়।
বাবা কিছুসময় চুপ থেকে মা-মেয়ের কথা শুনছিল।রূপার কথা শেষ হতেই বাবা বলে উঠল,'ঠিক আছে, এবার বল তোর মতামত কি?'
-হোয়াই সুড আই বাবা।ইউ হ্যাভ নট আসকড মি বিফোর ডুইং দ্যাট।
-তা না, আমরা তো, মানে ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা।
-দুর্ঘটনা!হাউ ফানি বাবা, দুর্ঘটনা মেড মাই মাদার প্রেগন্যান্ট।
-শোন ব্যাপারটা ঠিক ওই রকম নয়।আসলে আর বছর তিন পরে তোকে বিয়ে দিতে হবে,তার পরে তো আমরা একা।
-ইস ইট এনি এক্সকিউস?আমার বিয়ের পরে তোমার জামাই আসবে।কোথাও তো লেখা নেই বিয়ের পর মেয়েরা বাবা-মা কে দেখবে না।তাছাড়া আমি বিয়ে করব কিনা সেটাও ঠিক নেই।তোমরা এত কিছু ভেবে এই বয়সে এরকম করে ফেললে?
-শোনো, মেয়ের কথা শোনো, তোমার প্রশ্রয়েই আজ এই রকম অবস্থা।আমার না হয় ভাই বোন নেই, কিন্তু তোমার তো আছে, বুগি তোমার থেকে কত ছোটো?
- মা, নন সেন্সের কত কথা বল না।বুগি বাবার থেকে এগারো বছরের ছোট, না জ্যাঠা বাবার থেকে বারো বছরের বড়, এটা নিয়ে কোন কমপ্যারিসন হয় কি?
-ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে বলে কথা, বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবার বহর শোনো।
-মা, আমার শিক্ষা আমাকে তোমাদের সামনে এইভাবে কথা বলতে শিখিয়েছে।আর পৃথিবীর কোথাও লেখা নেই সন্তান হলে বাবা-মায়ের ভুল বলা যাবে না।
শেষের কথা গুলো বলেই ব্রেকফাস্টের টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।বাবা একভাবে দরজার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে আবার একটা জোরালো শ্বাস ছেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,'কি হয়ে গেল বল তো?'
-তুমি বল।তখন বারবার বারণ করেছিলাম, এখন সামলাও।
২
মাস তিন আরো পেরিয়ে গেল।রূপার মায়ের গর্ভের সেই অপত্য স্নেহের প্রাণ এই তিনমাসে আরো তিনমাস বড় হয়ে গেছে।রূপার মাকে এখন দেখলে বোঝা যায়। সেদিনের ঘটনার পর রূপার ব্যবহার জটিল থেকে যৌগিক হয়ে উঠল।রূপার বাবা-মা ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওয়াশের ব্যাপারে আলোচনা করেছিল।রূপার কথাও বলেছিল।কিন্তু ডাক্তারবাবু সবকিছু পরীক্ষা করে বলেন,'আপনাদের এইরকম পরিকল্পনা থাকলে আরো আগে ভাবতে হত।এখন ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে। এমনকি ম্যাডামের কিছু ভালো-মন্দ হয়ে যেতে পারে।তারথেকে মেয়ের সাথে আবার কথা বলুন, বোঝান।'
বাড়ি ফিরে রূপাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয় নি।বরং দিন দিন রূপা তার নিজস্ব পৃথিবীর মধ্যে নিজেকে আরো বেশি করে পেঁচিয়ে রাখতে আরম্ভ করে।প্রয়োজন ছাড়া বাবা মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।লাঞ্চ তো একা খেতই, ড়িনার নিয়েও নিজের ঘরে চলে যেতে আরম্ভ করল।বাবা-মায়ের প্রশ্নের কোন উত্তর দিত না।স্কুল বা টিউসন থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরতে আরম্ভ করল। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বেশির ভাগ সময়েই এড়িয়ে চলে যেত, অথবা চিল্লিয়ে বলত,'তোমাদের কি?'
একটা ছেলের সাথে ঘোরাঘুরির কথাও কানে এল।কিন্তু রূপাকে কিছু বলতে সাহস হয় না।একদিন রাত্রি নটার সময় বাবা বাড়ির সামনে একটা ছেলের বাইক থেকে নামতে দেখে।বাড়ি ফিরলে ছেলেটার ব্যাপারে প্রশ্ন করতে খুব বাজে ভাবে উত্তর দেয়,'তাতে তোমার বিজনেস?'
মা শুয়ে শুয়েই চেল্লাতে আরম্ভ করে,'এর মানে!আমরা জিজ্ঞেস করব না, তো কে করবে?'
বাবা শান্ত করে বলে,'ডাক্তার তোমায় উত্তেজিত হতে বারণ করেছে,শান্ত থাকো।আমি ওর সাথে কথা বলছি।' তারপর খুব শান্ত ভাবেই ছেলেটার কথা আবার জিজ্ঞেস করতে রূপা জবাব দেয় ,'ও চাঙ্কি আমার টাইম পাটর্নার,এনি প্রবলেম?'
তবে ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শূন্যের দিকে গেলে বাবার কাছে এসে গম্ভির গলায় বলে , 'বাবা আমাকে কিছু ফান্ড ট্রান্সফার করে দেবে তো।'
বাড়িতে টুকটাক কাজ করবার জন্যে আলপনা মাসি ছাড়াও রান্নার জন্যে আরকজন এসেছে।খিদে পেলে তাদের কাউকে বলে টিফিন থেকে আরম্ভ করে বাকি সব নিয়ে নেয়।
মা কিন্তু এখন এক্কেবারে শয্যাশায়ি।ডাক্তার বলেছেন,'বেশি বয়সের তো, বেশ কমপ্লিকেটেড প্রেগনেন্সি।রেস্ট না নিলে রিস্ক হতে পারে।'
রূপা কিন্ত কোনো দিনও মায়ের ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করেনা,'কেমন আছো?'সাধের দিন পিসি আর দূর সম্পর্কের মাসি,মামিরা এলেও রূপা স্কুল চলে যায়।এমনকি আগের রাতে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফোনে বলে,'তাহলে কাল টিউসন থেকে ফেরার সময় পার্টি হবে।' আরো মাস দেড় পরে একরাতে দরজাতে বাবার জোরে জোরে ধাক্কা মারবার আওয়াজে রূপার ঘুম ভেঙে যায়।বাইরে বাবার গলার আওয়াজ পায়,'মাম্পি তোর মায়ের শরীর খারাপ, তুই দরজা খোল।'একবার দুবার তিনবার।রূপা কিন্তু দরজা খোলে না।শুধু ভিতর থেকেই জোরে বলে ওঠে, 'শরীর খারাপ তো আমি কি করব ,তোমাদের ব্যাপার, তোমরা বোঝো।'মিনিট পনেরো পরে একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়।ঘরের ভিতরে আরো কয়েকজন মানুষের উপস্থিতিও বোঝা যায়। 'আস্তে, একটু নামাও।'এইসব কয়েকটা কথাও কানে আসে।আরো কিছু সময় পরে আবার বাবার গলা পায়।'মাম্পি, তোর মাকে নিয়ে হাসপাতাল যাচ্ছি।আলপনা থাকল, পারলে সকালে আসবি।'
রূপা কিন্তু তার পরেরদিন হাসপাতালে যায়নি।সকালে উঠেই টিউসন চলে গেল।বাড়ি ফিরে অবশ্য তাকে আরো গুম হয়ে থাকতে হল।ঘর ভর্তি লোকজন।ঘরে ঢুকতেই প্রশ্ন,'তোর মা কেমন আছে জানিস?সে কিরে?'তারপরেও হাজারটা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা।রূপা কোনরকমে সবাইকে এড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল।কিছুসময় পরে দরজাতে টোকা দেওয়ার আওয়াজ শুনে দরজা খুললে পিসি ঘরের ভিতরে এসেই বলে উঠল,'পড়তে গেছিলি?'
-হ্যাঁ।
-তোদের রান্নার মেয়েটা বলল সাড়ে আটটার মধ্যে চলে আসবে।তোর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।
-কেন?
-তোর মাকে দেখতে যাবি না?
-তোমরা যাচ্ছো তো।
-তোর মায়ের এখনও জ্ঞান ফেরেনি।
-ও।
-ও মানে!ডাক্তার বলেছে ক্রিটিক্যাল স্টেজ।
কিছু সময় চুপ থেকে রূপার কাঁধে হাত রেখে বলল,'কাল ওটিতে ঢোকানোর সময়ে ঐ ব্যথার মধ্যেও তোর নাম ধরে ডাকছিল।দাদাকে বলে,'তুমি বাড়ি যাও, মাম্পি একা আছে।'কথাগুলো বলে বেরিয়ে যাবার সময় দরজাতে হাত রেখে বলে উঠল, 'তোর বোনটাও বাঁচেনি।'
নিজের ঘরে এই প্রথম রূপা নিজে খুব একা হয়ে উঠল।খোলা জানলা দিয়ে বাইরের হাওয়া ঢুকলেও নিজের গরম লাগছিল।ব্যাগটা কিছুসময় আগেই বিছানাতে রেখেছিল।এবার নিজের শরীরটাকেও বিছানাতে জড় পদার্থের মত ফেলে রাখল। মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়.........।মোবাইলে হিন্দি গান বেজে উঠল।একবার, দুইবার তিনবারের বার মোবাইলে চোখ রাখল।স্ক্রিনে চাঙ্কির ছবি দেখা যাচ্ছে।
-বল....
-বাড়িতে কেউ নেই তো, স্কুলে আসবে?
-কেন?
-আমারও বাড়ি ফাঁকা।
-একটু ব্যস্ত, পরে কল করব।
ফোনটা কেটে বিছানাতে মুখ নিচু করে কিছুসময় শুয়ে রইল।পিসির কথাগুলো কানে বাজছে।কিছুসময় পরেই বিছানাতে উঠে বসল।বাইরে একটা আওয়াজ আসছে।সবাই বেরোচ্ছে।রূপা ফোনটা সাইলেন্ট করে জোরে বলে উঠল,'পিসি.....তোমরা কখন যাবে?আমি রেডি।'
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ********************************
SOUGATA CHATTERJEE
B1-85/1, V.K.NAGAR, M.A.M.C
DURGAPUR-713210, BARDHAMAN PASCHIM
PHNO-9002157241/9732381127