Click the image to explore all Offers

গল্প ।। মানুষের সন্ধানে ।। রঞ্জন চক্রবর্ত্তী ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;




ম্যাসিডনের সমুদ্রসৈকতে ইতস্তত ঘুরছিলেন একজন প্রৌঢ়তাঁর চলাফেরার গতি মন্থর, মুখাবয়বে অদ্ভুত এক নিরাসক্তি খেলা করছে। দেখে মনে হচ্ছিল লোকটি ভবঘুরে। আপনভোলা মানুষটি সূর্যস্নান করতে এসে নিজের মনেই কী এক গভীর চিন্তায় মগ্ন। বোধহয়চিন্তাজগতের কোন জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল তাঁর মন। আপাতদৃষ্টিতে সূর্যস্নান তাঁর উদ্দেশ্য হলেও মনের গহনে তিনি কোন জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন

সম্রাট ফিলিপের পুত্র তখন বন্ধু, সহচর ও স্তাবকবর্গ দ্বারা পরিবৃত হয়ে সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁর চোখে পড়ল এই আত্মমগ্ন প্রৌঢ়কে। কী আশ্চর্য! তাঁকে দেখেও লোকটির এতটুকু চাঞ্চল্য নেই। সচরাচর স্তাবক দ্বারা পরিবৃত থেকে তাদের প্রশংসাবাক্য শুনে সম্রাটপুত্র অপরিসীম আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। কিন্তু এই প্রৌঢ়ের আকাশ ছোঁয়া ঔদাসীন্য দেখে তিনি অবাক হলেন, হয়ত আশৈশব সযত্নলালিত অহংবোধেও একটু আঘাত লাগল। সমগ্র ম্যাসিডন রাজ্যে তাঁকে সামনে দেখেও কেউ এতখানি নির্লিপ্ত থাকতে পারে! এ যে বিশ্বাস করা যায় না।

ঘোড়া থেকে নেমে প্রৌঢ়ের দিকে এগিয়ে গেলেন সম্রাটপুত্র আলেকজাণ্ডার। তিনি লোকটিকে ভাল করে দেখতে চান, তার সঙ্গে কথা বলতে চান। সমুদ্রের রূপোলী সৈকতে কিশোর আলেকজাণ্ডার এক স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির সামনে এসে দাঁড়ালেন। যুবকের ক্ষমতার গর্ব এবং ধ্যানমগ্ন প্রৌঢ়ের ঔদাসীন্য পরস্পরের মুখোমুখি হল।

সম্রাটপুত্র গম্ভীরভাবে বললেন, এই আলোকজ্জ্বল প্রভাতে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমি ম্যাসিডনের সম্রাট ফিলিপের পুত্র  আলেকজাণ্ডার,এই রাজ্যের যুবরাজ। আপনি নিশ্চয় আমার নাম শুনে থাকবেন। আপনার পরিচয় জানতে পারি?

প্রৌঢ়ের কন্ঠস্বরে নির্লিপ্ত ফুটে উঠল, আমি অতি নগণ্য ব্যক্তি, নাম ডিওজিনিস। আমাকে একজন প্রশ্নজীবী, অথবা সন্ধানীও বলতে পারেন। আমি জ্ঞানী সক্রেটিশের ছাত্র।

 আলেকজাণ্ডার আগে কখনও ডিওজিনিস বলে কারুর নাম শোনেন নি। তাছাড়া প্রশ্নজীবী কথাটার অর্থও তিনি কতটা বুঝলেন বলা শক্ত। তাঁর ইচ্ছে হল প্রৌঢ়কে প্রশ্ন করে ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে নেবেন। কিন্তু তার আগেই প্রৌঢ় বলে উঠলেন, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল যুবরাজকিন্তু আপনার উপস্থিতি আমার অসুবিধার কারণ হচ্ছে। তাই এখন আপনাকে অনুরোধ করব আমার সামনে থেকে একটু সরে দাঁড়ান।

আলেকজাণ্ডার চমকে উঠলেন! এভাবে যে কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারে সেটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সেই বিস্ময় ফুটে উঠল তাঁর কথায়, কেন? সরে দাঁড়াব কেন?

একইরকম নির্লিপ্তভাবে প্রৌঢ় উত্তর দিলেন, এই সূর্যালোক হল মহান ঈশ্বরের দান। আমাকে তা আরও একটু উপভোগ করতে দিন।

একথা শুনে আরও একবার অবাক হলেন আলেকজাণ্ডার। তিনি বুঝতে পারলেন এই প্রৌঢ়ের কাছে প্রকৃতি শুধুই ঈশ্বরের দান নয়। আকাশ, সূর্যালোক বা সমুদ্র তাঁর কাছে কেবলমাত্র কোনও সংবেদের অনুভূতি বয়ে নিয়ে আসে, যা থেকে জীবনের বিভিন্ন মূলগত প্রশ্নের উদ্ভব হয়। এটা অনুধাবন করে সম্রাটপুত্র যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ হলেন। তাঁর কথায় ফুটে উঠল সেই মুগ্ধতা, আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানবেন। যদি যুবরাজ আলেকজাণ্ডার না হতাম তাহলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতাম যাতে আমি ডিওজিনিস হতে পারি।

সম্রাটপুত্রের এই কথার উত্তর দিলেন না ডিওজিনিস। ততক্ষণে তিনি আবার নিজের চিন্তার জগতে ডুব দিয়েছেন। তাঁকে আর বিরক্ত না করে সেখান থেকে চলে গেলেন আলেকজাণ্ডার। প্রাসাদে ফিরে তিনি সঙ্গীদের বললেন, তোমরা কেউ কী এই অদ্ভুত লোকটিকে আগে থেকে চিনতে?

একজন পার্শ্বচর বলল, নগরীর সকলেই লোকটিকে চেনে। প্রায় প্রতিদিনই নগরীর পথে পথে একে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায়। দিনের বেলায় প্রখর সূর্যালোকেও এর হাতে থাকে একটি জ্বলন্ত লন্ঠন।

আলেকজাণ্ডার সবিস্ময়ে বললেন,এ আবার কী অদ্ভুত ব্যাপার! দিনের বেলায় প্রকাশ্যে লোকটি লন্ঠন হাতে নিয়ে রাজপথে ঘোরে কেন?

পার্শ্বচরটি বলল, ও যা করে সেটা শুনলে আপনি আরও আশ্চর্য হবেন। কোনও আগন্তুক বা অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখলে তার মুখের সামনে ঐ লন্ঠনটা তুলে ধরে কী যেন গভীরভাবে দেখে। এই অদ্ভুত আচরণ দেখে নগরীর অনেকেই লোকটিকে পাগল বলে।

আলেকজাণ্ডার দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, না, তার সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝেছি লোকটি পাগল নয়। বরং তার আচরণের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক প্রগাঢ় জিজ্ঞাসার অভিব্যক্তি। আচ্ছা,কেউ কী তাকে প্রশ্ন করেছে কেন সে এমন করে?

এবার আর একজন পার্শ্বচর বলল, তাকে এই প্রশ্নটা অনেকেই করেছে। যে উত্তরটা সে দিয়েছে তার কোনও অর্থ হয় না। লোকটি প্রতিবারই উত্তর দিয়েছে সে মানুষ খুঁজে চলেছে। একজন প্রকৃত মানুষের সন্ধান পাওয়ার তাগিদেই সে লন্ঠনের আলোয় অপরিচিতদের মুখ ভাল করে দেখে নেয়। তাছাড়া সে নাগরিকদের জনে জনে প্রশ্ন করে তারা কেউ একজন প্রকৃত মানুষের খোঁজ দিতে পারে কিনা।

মাথা নেড়ে বললেন যুবরাজ, প্রৌঢ়ের আচরণ নাটকীয় মনে হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তার এই প্রশ্নের মধ্যে যে সংবেদনশীলতা মিশে আছে তা আসলে এক চিরন্তন অন্বেষার প্রতীক। সমাজের বিভিন্ন প্রকরণের মধ্যে যে আত্মতৃপ্তির অন্ধকার মিশে আছে, এই প্রশ্ন যেন তাকে এক পরিপূরক আলোকরশ্মির সন্ধান দেয়।ভাল করে ভেবে দেখলে তোমরা বুঝবে প্রশ্নটির সঙ্গে যে আবেগ জড়িয়ে আছে তার আর্তি যেন সভ্যতার ঠাসবুনোটের অনুষঙ্গসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে প্রশ্নটি অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে আছে।

যুবরাজের কথা শেষ হতে উপস্থিত সকলের মনে জাগল একটি অনুচ্চারিত প্রশ্ন, এই সন্ধানের কী কোনও শেষ আছে?

------------------- 

ছবিঋণ- ইন্টারনেট । 

রঞ্জন চক্রবর্ত্তী
রেসকোর্স পাড়া, জলপাইগুড়ি
PIN - 735101
মোবাইল - 7551099167
ই-মেল - ranjan25574226@gmail.com

 


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.