অণুগল্প ।। জামাই ষষ্ঠী ।। রবীন বসু
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছে রাধারানি l স্নান ও নিত্য পুজো সেরে এখন মেয়ের ঘরের দরজায় l
—কী ভুলো মেয়ে রে বাবা, ভুলেই বসে আছে আজ কী দিন l
এবার তিনি জোরে দরজায় ঘা দিলেন l
—শোভনা, এ্যাই শোভনা, উঠবি তো রে ! আর কত বেলা অবধি ঘুমোবি? এদিকে আজ যে—
মায়ের শোরগোলে ঘুম ভেঙে গেল শোভনার l বাইরে আসতেই মা ঝাঁপিয়ে পড়ে l
—কী বেআক্কেলে মেয়ে রে তুই? আজ না জামাইষষ্ঠী, কত কাজ—তুই নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিস? আমি তোর মেজো মেসোকে বলেছি বাজার করে দিয়ে যাবে l কাল রাত থেকে নিলয়কে ফোন করছি, পাচ্ছি না l এ বাড়ি থেকে তো ওকে ষষ্ঠীতে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করতে হবে l যাই আর একবার ফোন করি l
রাধারানি চলে গেলেন ড্রয়িংরুমের দিকে l
শোভনা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল l তার আজ আর অফিস যাওয়া হবে না l মাকে চোখে চোখে রাখতে হবে সারা দিন l
বিয়ের এক বছরের মাথায় বাবা হঠাৎ চলে গেল l আর তার দু'বছর পর নিলয়ের সঙ্গে তার ডিভোর্স l বাবার চলে যাওয়া মাকে ভেঙে দিয়েছিল, কিন্তু তার ডিভোর্স মাকে সব ভুলিয়ে দিল l মেনে নিতে পারেননি l অন্তর মহলে জামাই নিলয়কে আজও ধরে রেখেছেন l
শোভনা খুব ভয় পেয়েছিল l ডাক্তার বসাকের চেম্বারে নিয়ে যেতে বলেছিল, অকস্মাৎ আঘাতে নার্ভাস ব্রেকডাউন। খুব যত্নে আর সাবধানে এসব পেশেন্টকে ট্রিটমেন্ট করতে হবে l সব ভুলে যাবেন কিন্তু যে কারণে তাঁর এই অবস্থা সেটা অবচেতনে রয়ে যাবে l
তখন থেকেই শোভনা খুব সতর্ক l কিন্তু আজ তো মা সারাদিন জামাই জামাই করবে l কি করে সে বোঝাবে তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে, নিলয় আর তার জামাই নেই l সে এখন অন্য কোথাও ষষ্ঠী নিচ্ছে l
চার বছর প্রেম করে তারপর বিয়ে l শোভনা বুঝতে পারেনি নিলয়ের স্বরূপ l অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে তবু নানা অছিলায় সে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দিত শোভনাকে l বলত, বাপের একমাত্র মেয়ে তুমি, সব তো তোমারই—আনবে না কেন?
না, বলতেই চলত গালাগাল মারধোর, এমন কি প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি l কয়েকবার এনেও দিয়েছিল l টাকা হাতে পেয়ে নিলয়ের অন্য রূপ l তিন চার দিন বাড়ি ফিরত না, যখন ফিরত বেহেড় মাতাল l কোন নোংরা জায়গায় যে পড়ে থাকত কে জানে l শ্বশুর শাশুড়িকে বললে বলতেন, ছেলেদের ওসব একটু থাকে l মেনে নিতে হবে l
—আর আমি যদি তিন চার দিন বাড়ির বাইরে থাকি মেনে নেবেন তো আপনারা?
শোভনা উত্তর পেয়েছিল, শাশুড়ির হাতের একটা চড় l সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আর না l এ সম্পর্ক তাকে আর কিছু দেবে না l বরং একা অসহায় মায়ের পাশে ফিরে যাওয়াই ভালো l
ফিরে সে এসেছিল l দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর বিচ্ছেদ l তারপর শোভনার চাকরি খোঁজা l স্কুলজীবনের এক বন্ধুর সাহায্যে এক কর্পোরেট হাউসে ঢোকা l জীবন তার এখন ভারমুক্ত, কিন্তু বিনিময়ে সে হারিয়েছে মায়ের স্মৃতি l এক আলোআঁধারি ভ্রম আর বিভ্রমে তাঁর অবস্থান l শোভনা চায় যে কোন মূল্যে সে মাকে সুস্থ করে তুলবে l অফিস কলিগ অমৃতকে একটা ফোন করল l
দুপুরের মধ্যে সব রান্না শেষ করে ফেলল শোভনা l রাধারানি চেয়েছিল আজ তিনিই রান্না করবেন জামাইয়ের জন্য l অনেক বুঝিয়ে তাঁকে নিবৃত্ত করে মেয়ে l আসন পেতে হাতে হাতপাখা নিয়ে ফোঁটার সরঞ্জাম সাজিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে ছিলেন রাধারানি জামাইয়ের অপেক্ষায় l দুপুর গড়িয়ে যেতে ডোর বেল বাজল l
—ওই বোধহয় নিলয় এলো—
দৌড়ে গেলেন দরজা খুলতে l তারপর জামাইকে দেখে এক মুখ হাসি l
—এসো বাবা, ভিতরে এসো l বলি ও শোভনা, এদিকে আয়—দ্যাখ নিলয় এসেছে l
শোভনা দেখল, দরজা দিয়ে তার অফিস কলিগ অমৃত ঢুকছে l এক অবরুদ্ধ যন্ত্রণা আর আনন্দে শোভনার চোখ ভরে জল এলো।
••
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ।
-----------------------------------রবীন বসু
১৮৯/৯, কসবা রোড, কলকাতা-৭০০ ০৪২
ফোন : 9433552421, হোয়াটসঅ্যাপ: 8017135485
e-mail : rabindranathbasu 616@gmail.com
অপূর্ব লেখনী। ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন