Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প।। ফিলগুড হর্মোন ।। শংকর লাল সরকার

 

ফিলগুড হর্মোন

শংকর লাল সরকার

 

 দিগন্ত বিস্তৃত লালজমি, চাষের খেত, উঁচু নীচু টাঁড়জমি আর দূর সীমানায় শালগাছের জঙ্গল দেখতে দেখতে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলা লালকাঁকুরে রাস্তায় সাইকেলে যাচ্ছিল কলি আর কাকলিওরা দুই বোনচণ্ডীপুর গ্রাম থেকে ওদের সারদা হাইস্কুলের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটারএই পথটা ওরা দুজনে সাইকেলেই যাতায়াত করেকলি পড়ে ক্লাস ইলেভেনে আর কাকলি ক্লাস নাইনে

পথের দুপাশে সারিবদ্ধ শালগাছগুলো যেন সারবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা সিপাহির মতোসেদিকে তাকিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে কলি বলল, কাকলি জানিস কাল আমি পড়ছিলাম চোখের জলের কথাঅবাক হয়ে ভাবছিলাম প্রকৃতি কত সুন্দর পরিকল্পনা করে আমাদের চোখের জলের মধ্যেকার কেমিক্যালগুলো সৃষ্টি করেছেনতুই যখন কাঁদবি, তখন তোর মনে একটা ফিলগুড হর্মোন তৈরী হবে যেটা মনের উপরে চেপে বসা দূঃখের ভার লাঘব করবেজানিস তো কাকলি আমি যতই মানুষের শরীর সম্পর্কে পড়তে থাকি ততই আমার ভালো লাগেআমার নামের আগে বসবে ওই দুটো সম্মানীয় অক্ষর, এই ভাবতেই খুব মজা লাগে

ডাক্তার! তাই তো

কলি কোন উত্তর দেয়নাএকমনে সাইকেল চালাতে থাকে

কাকলি বলে আমার কিন্তু ডাক্তারি পড়বার একদম ইচ্ছা নেইরক্ত দেখলেই শরীর খারাপ করতে থাকেদিনরাত মানুষের রোগভোগ আর দুঃখযন্ত্রণা দেখতে কার ভালো লাগে

কলি বলল রোগাক্রান্ত, অসহায়, মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর মানুষের কাছে ডাক্তারই তো শেষ ভরসা, নিরাপদ আশ্রয়স্থল

বিকট আওয়াজ করতে করতে একটা মোটর সাইকেল ওদের পাশ দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়েই থমকে গেল, তারপর গতি কমিয়ে ওদের সাইকেলের পাশাপাশি চলে এল মোটরসাইকেলের পিছনে বসে থাকা একটা ছেলে, রোগাটে পাকানো চেহারা, শক্ত চোয়াল, চকরাবকরা টিশার্টটাইট জিন্সের প্যান্টহাতে অ্যানড্রয়েড ফোনচুলের স্টাইল দেখলেই বোঝা যায় অনেক অর্থ আর সময় ব্যয় হয় মেনটেন করতেছেলেটা দীঘল চেহারার শ্যামলাবর্ণের কলির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, এই তোর সঙ্গে কথা আছে

তোমার সঙ্গে আমার কোন কথা নেই, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কলি

চোখ কুঁচকে বিকৃত স্বরে মোহিত নামের ছেলেটা বলল তুই আমার প্রস্তাবে রাজী কিনা তাই বল

একটা অসভ্য ছেলে, দেখলেই আমার ঘৃণা হয়

ক্যালানে কল্যান মাস্টারের সঙ্গে তোর বৃন্দাবন লীলা আমি একেবারে ঘুচিয়ে দেবআমি কিছু বুঝিনা ভেবেছিস

মোহিতের জেল লাগানো চকচকে কালো চুলগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে রয়েছেচোখের দৃষ্টি লালএই সকাল বেলাতেই নেশা করেছেএকদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কলির বুকের দিকেএকটা প্রচণ্ড ঘৃণায় কলির সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠেপেটের ভিতরটা পাক দিয়ে উঠলঅস্বস্তিকর লোলুপ দৃষ্টির থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য কলি পিঠ থেকে খুলে স্কুলব্যাগটা বুকের সামনে দুহাত দিয়ে চেপে ধরলকলির মনে হল মোহিতের গলার সোনার হারটা কলির শরীরে বিষ ঢেলে দেবার জন্য যেন সাপের মতো ফুঁসছেতীব্র বিতৃষ্ণা আর ঘেন্নায় গা রিরি করে উঠল কলিরসে চেঁচিয়ে বলল পথ ছাড় স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছে  

বিশ্রী অঙ্গভঙ্গী করে কয়েকটা কুৎসিত গালাগাল ছুড়ে দিয়ে মোহিত নামের ছেলেটা বলল আমাকে লাথি মেরে মাস্টারের সঙ্গে রাসলীলা করা তোর চিরতরে বন্ধ করছি বলতে বলতেই এটা কাঁচের শিশি বার করে কী একটা তরল ছিটিয়ে দিল কলির মুখের উপরমুহুর্তের মধ্যে মুখটা যেন আগুনে জ্বলে গেলতারপর আর কিছু মনে নেই কলির

অ্যাসিড হামলার পর দীর্ঘ তিনমাস হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল কলিকেতারপরেও দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলেছিলওর সৌভাগ্য যে চোখদুটো কোনমতে বেঁচে গিয়েছিলকিন্তু চোখের অশ্রুগ্রস্থি চিরতরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলকলির চোখে আর জল আসত নাফিলগুড হর্মোন হারিয়ে গিয়েছিলঅন্যদিকে এলাকার প্রভাবশালী প্রমোটারের ছেলে মোহিত আইনের গলিঘুজি ঘুরে আশ্চর্যজনক ভাবে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল

ম্যাডাম বাবাকে একটু দেখবেন চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে বাস্তবে ফিরে এলেন ডাক্তার কলি গুছাইত টেবিলের ওপারে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে দৃষ্টি বিভ্রম ঘটে গেল মোহিত! বিখ্যাত প্রমোটার মন্মথবাবুর ছেলে মোহিত রায়! শুধু দৃষ্টিবিভ্রম নয় কলির বোধহয় সময়জ্ঞানও চলে গিয়েছিল উনি দুহাজার কুড়ি সালে বাঁকুড়ার একটা হাসপাতালে বসে আছেন, সেসব ভুলে গিয়ে পঁচিশবছর আগেকার প্রথম যৌবনের দিনে ফিরে গেলেন ওনার মনেও হল না পঁচিশ বছর পরে একই ছেলেকে একই চেহারায় দেখতে পাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয় সময় কখনও স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকে না তবুও তিনি আঠারো বছরের তরুণীর মতই উত্তেজিত আর বিচলিত হয়ে উঠলেন আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠলেন মুহুর্তর মধ্যেই তিনি তার যন্ত্রণাময় অ্যাসিড অ্যাটাকের দিনগুলিতে ফিরে গেলেন

ম্যাডাম বাবার অবস্থা খুব খারাপ আপনি যদি দয়া করে একটু দেখেন ছলছল চোখে কান্নাভেজা গলায় ছেলেটি কাতরভাবে অনুনয় করল

উত্তেজনা চোপে রেখে যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় ডাক্তার কলি বললেন, আপনার নাম

মলয়, মলয় রায় বাবা মোহিত রায়

ভিতরে ভিতরে থর থর করে কেঁপে উঠলেন মুখের উপরের প্রচন্ড জ্বালাটা যেন আবার ফিরে এল না ডাক্তার কলির মুখে আজ আর কোন পোড়া দাগ নেই অ্যাসিড অ্যাটাকের পরেও মনের জোর হারান নি পাশে পেয়েছিলেন প্রথম কৈশোরের প্রেম গৃহশিক্ষক তথা বর্তমানে তার গৃহকর্তা ডঃ কল্যান গুছাইতকে কল্যান সত্যই তার জীবনে কল্যান হয়ে দেখা দিয়েছিলেন অ্যাসিড অ্যাটাকের পরপর কলির মুখ বীভৎষ আকার ধারণ করেছিল সেসব দিনগুলোতে কল্যান ওর পাশেপাশে থাকত, মনের জোর দিত অবসাদে যখন কলির শরীর মন ভেঙে যেতে চাইত তখন কল্যানই ছিল ওর একমাত্র আশার আলো তারপর ডাক্তারিতে চান্স পাওয়া কলির মনে পড়ে যেদিন সে মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছিলেন সেদিন সকলে মিলে কী আনন্দটাই না করেছিল বিয়ের আগে কল্যানের আগ্রহেই কলি মুখের প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিলেন আজ আর ওনাকে দেখে চিনবার উপায় নেই

মেল ওয়ার্ডে এসে মোহিতের বেডের সামনে দাড়ালেন মোহিত শুয়ে আছে ডাক্তারকে দেখে ওর ফরসা নিরক্ত মুখে সামান্য খুশিয়াল দেখা দিয়েই মিলিয়ে গিয়েছিল চাদরের নীচ থেকে নিস্পন্দ চাবির গোছার মতো বেরিয়ে রয়েছে মোহিতের ডান হাতের কব্জি আর আঙুলগুলো হাতেই পঁচিশবছর আগে সে ধরেছিল অ্যাসিড ভরা বোতলটাচোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, সেখানে কাম লালসার বিষ নেই সিরোসিস অব লিভারে ভুগছে মোহিত জীবনের আয়ু আর বড়োজোর মাসখানেক

কলি যেন আবেগের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে প্রানপণ চেষ্টায় নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করেন একটু একা থাকার জন্য দ্রুতপায়ে  মেল ওয়ার্ড ছেড়ে নিজের কেবিনে ফিরে গেলেন কলি আজ পঁচিশ বছরবাদে চোখদুটো আবার ঝাপসা হয়ে এল কলির অশ্রুগ্রস্থি কী আবার কর্মক্ষম হয়ে উঠছে ডাক্তার কলি গুছাইতের শরীর ভরে ফিলগুড হর্মোনের ঢল  


শংকর লাল সরকার

                                                                                                                        Mob. 8637852643

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.