প্রদীপ বিশ্বাস (অকৈতব)
- তোর মাথা তো বিক্রি হয়ে যাবে রে! পঞ্চরাম কথাটা বলল আশুর দিকে তাকিয়ে।
কথাগুলো ছুঁড়ে মেরেছিল বলাই ভালো। গোপীর বাবা পঞ্চরাম। আশু ও গোপী এক সাথে একই পাঠশালায় পড়ে। মাঁদার মাষ্টারের পাঠশালায় ।পাশের গাঁ গর্জনপুরে বাড়ী মাঁদার মাষ্টারের ।কালাচাঁদ জদ্দারের খেজুর বাগানে প্রথম পাঠশালা বসল। সেখানেই তারা একসাথে তালপাতার চাচ, তালপাতার আঁটি, কালির দোয়াত আর কঞ্চির কলম নিয়ে পড়তে যেত। অবশ্য এর আগেও আশু পাঠশালায় যাওয়া শুরু করেছিল। সতীশ মাষ্টারের পাঠশালায়। তাকে ঠিক যাওয়া বলে না।
একদিন সকালে পূবদিকের নারকেল গাছটার মাঝামাঝি সূর্যটা উঠে গেছে। আশু ঢিল ছুড়ছিল খালের জলে। নেরান(নিরঞ্জন) তালপাতার আঁটিতে চাচ আর কালির দোয়াত ঝুলিয়ে পাঠশালায় যাচ্ছিল। তাকিয়ে ছিল আশু।
- - এই পাগলা, ইস্কুলি যাবি?
- - কোন ইস্কুলি!
- - ক্যান সতীশ মাষ্টারের পাঠশালায়! অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল নেরান, যেন এমন একটা পাঠশালার নাম না জানা অপরাধ।
- - তা কি করে যাবি? মাথা চুলকাতে চুলকাতে আশু জানতে চায়।
- - সাঁতার জানিস?
- - হ্যাঁ - - - - ।আশু ঘাড় নাড়ে।
- - তা'লে আয়। নেরান ডাকে আশুকে ।ভাবটা এমন, আর কোনো সমস্যাই নেই।
আশুর মনে হ' ল, যাই দেখে আসি পাঠশালা কি জিনিস! কিন্তু বাড়ীতে কেউ নেই যে! বাবা সেই সকালে লাঙল-গরু নিয়ে মাঠে গেছে, আসবে সেই দুপুরবেলা। মা গেছে খোলেনে ধান শুকোতে। কা'কে বলে সে যাবে!
- - এ্যাই, কি ভাবছিস ? যাবি তো চল, না গেলে থাক। আমি চললাম। নেরান হাঁটা লাগাল।
আশু সাতপাঁচ না ভেবে নেরানের পিছু নিল।
হাজরা মিস্ত্রির ঘাট পেরিয়ে যেতে হবে। চার(সাঁকো)টা ভেঙে গেছে।
- - কি করে যাবি? আশু জানতে চাইল।
- - আয়, ধর এগুলো। চটপট ইজেরটা খুলে মাথায় বেঁধে নিল নেরান। তারপর চাচ, তালেরপাতা, দোয়াত হাতে নিয়ে জলে নেমে গেল। - - এবার তুইও ইজেরটা খুলি নামি পড়।
নেরানের কথামত তাই করল আশু। কত সহজে খাল পার হ'ল তারা।
সাঁতরে ওপারে বাঁশতলায় গিয়ে উঠল। ইজেরটা পরে নেরানের পিছু পিছু দিব্বি সতীশ মাষ্টারের পাঠশালায় পৌঁছেছিল আশু।
পাঠশালায় পড়া তখন শুরু হয়ে গেছে। জিয়ল গাছের নীচে জলচৌকি পেতে বসে আছেন সতীশ মাষ্টার।
নেরান আর আশুকে আসতে দেখে ইশারায় কাছে ডাকলেন। গুটি গুটি পায়ে তারা দু'জন কাছে গেল। নেরানের কানটা টেনে ধরে বললেন - - দেরী হ'ল ক্যানরে নবাব-পুত্তুর!
- - মাষ্ঠাই(মাষ্টার মশাই), হাজরার চার ভাঙি গেছে তাই-----।কানমলা খাওয়ার যন্ত্রণা ভরা নেরানের মুখটা তখন দেখবার মত হয়েছিল। আশুর হাসি পাচ্ছিল, আবার ভয়ও হচ্ছিল যদি তাকেও কানমলা খেতে হয়! তেমনটা কিছু হ'ল না বলে মনে মনে খুশি হ'ল।
- - অ---, যা গিয়ে বস। আশুর দিকে চোখ পড়তেই বললেন - - ও ব্যাটা আবার ক্যাডারে!?
- - মাষ্ঠাই, ও বড়পাগলা ।আমার সাথ এয়েছে ইস্কুলিতি।
- - অ, তোর বদলি হিসেবে? বাঃ, বাঃ! তা তামাক সাজতি পারস তো?
- - আশু মাথাটা এদিক-ওদিক দোলায়। পারে না সে তামাক সাজতে।
- - তা, পারসটা কি? যা, ওর সাথে যা, শিখে নে। দয়ালের মা'র উনুনে আগ আছে, বারান্দার কোনে বাঁশের চোঙায় মাখানো তামাক আছে। কলকেটা ভালো করে ঝেড়ে ছাইটা ফেলে দিস। দেখিস আবার ' গুলি'টা ফেলিস নে য্যান।
আশু নেরানের পিছু নিল। দয়ালের মা' র উঠোনে এসে দাঁড়াল।
পূবদিকের কোনে চোখ গেল। চালাটার নীচে উনুনে একটা বড় মাটির হাঁড়ি চাপানো আছে। নেরান সেদিকে এগিয়ে যায়। আশু তার সাথে গেল।
- - খালি হাঁড়ি! আশু জানতে চায়।
- - না রে! জল আছে, খালি হাঁড়ি আঁচে ফাটি যায় যে। তোর ঘটে কিচছু বুদ্ধি নেই। অ্যাই দ্যাখ ক্যামনে তামাকু সাজতি হয়, বলে আশুর হাতে হুঁকোটা ধরিয়ে দিল নেরান। কলকেটা নিয়ে উনুনের পাশে গিয়ে বসল। কলকেটা গালে একবার ঠেকাল।
- - ওটা কি হ'ল? আশু জানতে চাইল।
- - কতটা গরম আছে দেখি নিলাম, বিজ্ঞের মত জবাব দেয় নেরান। - - বেশী গরম থাকলি তো হাতে ছাইটো ঢালা যাবি নে' পাতায় ঢালতি হবে। না, বেশী গরম নেই।
কলকেটা বাঁ-হাতে উপুড় করে ডান হাতে উঠিয়ে নিল নেরান, ছাই বাঁ-হাতে পড়ে রইল। আশুর হাতে কলকেটা দিয়ে ছাইয়ের মাঝে কি যেন খুঁজতে লাগল। আশু মনোযোগ দিয়ে নেরানের কাজকর্ম দেখতে লাগল। পরে হয়তো তাকেই এটা করতে হবে।
দু'আঙুলের ফাঁকে কালো গোলমত কি একটা তুলে ধরে বলল, এটাই খুঁজছিলাম এতক্ষণ। এটাকে ' গুলি' কয় । এটা না দিলি তামাকুর ছাই হুঁকোর নলে ঢুকি যায়, ছ্যাঁদা তাড়াতাড়ি বুজে যায়। নলচেয় শিক ঢুকিয়ে কাঁই বা'র করতি হয়। সে আর এক ভজকট ব্যাপার।
- - অ--, আশু মাথা নাড়ে যেন সব বুঝে গেছে।--কাঁই কি!!
- - তাও জানিসনে? শোন তা'লে। কাঁই হ'ল তামাকুর নিয্যাস, ধোমা (ধোঁয়া) নলচের ছ্যাঁদা দি নীচের দিকি নামে। ছ্যাঁদার মধ্যি জমি যায়। ওটাই কাঁই। তোর পেটব্যথা হইছিল কুনদিন? তেমনটো হলি একটা কাঁইয়ের গুলি জল দি মেরে দিবি। সব ঠিক হ'য়ি যাবে।
আশুর মনে পড়ে এমনটা একবার হয়েছিল।
ভাইদা'র হুঁকো থেকে কালো চটচটে কি একটা বের করে গুলি বানিয়ে তাকে খাওয়ানো হয়েছিল।
নেরান অভিজ্ঞ হাতে নারকেল মালায় করে উনুনের আগ উঠাল। ফুঁ দিয়ে ছাই উড়াল। জ্বলন্ত কয়লার আগ টপাটপ কলকেতে তুলে নিল।
- - নে, হ'য়ি গেছে। হুঁকোটা দে। আশুর হাত থেকে হুঁকোটা নিয়ে নলচের মাথায় কলকেটা বসিয়ে দিল।
- - এ্যাই পাগলা, দ্যাখতো কেউ কুথাও আছে নিকি?
- - ক্যান রে?
- - দ্যাখ না! যা কইছি তাই কর!
আশু চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। ঘরের দরজা বন্ধ। দয়ালের মা বাড়ীতে নেই বোঝা গেল। আশেপাশেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
- - না, কেউ নেই।
- - ঠিক আছে।
হুঁকোটা নিয়ে নেরান ঘরের পিছনে গেল। কানাচে দাঁড়াল। পিছনে বাঁশঝাড়। হুঁকোয় দিল টান। গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ল।
- - এটা কি করলি তুই!? মাষ্ঠাইয়ের হুঁকোতে টান দিলি!? পাপ হবে নে!?
- - চুপ, কিচছু কইবি নে! না'লে পেঁদিয়ে বেন্দাবন দেখিয়ে দেব। চল - - - - ।
নেরানের ধাতানিতে আশু চুপ মেরে গেল। নেরানের পিছু পিছু পাঠশালায় ফিরে এল।
নেরানের হাত থেকে হুঁকোটা নিয়ে সতীশ মাষ্টার বলে উঠলেন - - এ্যাই, তোকে বলছি,
পাতা-দোয়াত এনেছিস? আশু ঘাড় নাড়ল। - - ঠিক আছে। এ্যাই নেরানে, একটা তালপাতা আর একটা কলম ওকে দে'তো। ও ঘট গড়া শুরু করুক। এসেছে যখন কিছু করুক!
নেরান বান্ডিল খুলে একটা তালপাতা বের করে দিল। কঞ্চির কলমও দিল একটা। তারপর বিজ্ঞের মত বলল - - নে, আজ. ' ঘট' গড়া শুরু কর। বাড়ী যা'য়ি পাতা, কালি বানায় দিতি কস তোর বাপেরে। এই ভাবে ল্যাখ। আশুর হাতে ধরে নেরান লেখা শেখাতে থাকে।
কলমে ভুসোকালি মাখিয়ে তালপাতার উপর গোল গোল চিহ্ন এঁকে বলল - - এইটা হ'ল বড় 'ঘট', আর এইটা হ'ল ছোট ' ঘট'-------।নে, এইবার তুই ল্যাখ দিকিনি।
হাতেমুখে কালি মেখে কোনও রকমে একটা পাতা শেষ করল আশু। দুপুর গড়িয়ে গেলে পাঠশালা ছুটি হ'ল।
এদিকে আশুর পাড়ায় হুলুস্থুলু কান্ড। আশুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আশুর মা কান্নাকাটি করছে। সবাই ছুটোছুটি করছে আশুর খোঁজে। পুকুরে জাল নামানো হ' ল। বড় পুকুর, ছোট পুকুর, বুড়ীর ঘুঁটো, হরিতলা পর্যন্ত খুঁজে এসেছে সবাই। খুঁজে পাওয়া যায় নি আশুকে। সবার মুখ ভার।
হঠাৎ শান্তিরাম চেঁচিয়ে উঠল - -মেজোখুড়ি ঐ তো তোমার বড়পাগলা ।
সবাই তাকিয়ে দেখল একহাতে ইজেরটা ধরে ভিজে গায়ে ন্যাংটো হয়ে খালপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আশু। সারা মুখে কালি-চুলি মাখা। পাশে দাঁড়িয়ে নেরান, কাঁধে ঝোলান তালপাতার বান্ডিল।
***