আমার জীবনে বহুবার প্রেম এসেছে । দশম বসন্তে সেই মানুষটার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো , আমি স্কুল থেকে ফিরছিলাম , হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে ধুলোমাখা সে দাঁড়িয়ে রয়েছে । এক পা খোঁড়া নেড়ি কুকুরটার বাচ্চা দুটো কোলে নিয়ে আদর করছে খুব , বিস্কুট ভেঙে খাওয়াচ্ছে ওদের । অতি সাধারণ দৃশ্য , অথচ এক অমোঘ আকর্ষণে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম । তার ডানগালের চাপালিতে রোদ এসে আলতো চুমু খাচ্ছে । আর সে একনাগাড়ে আদর করে চলেছে ছানা দুটোকে । ওরাও অনেকদিন পর মানুষের আদর বেশ উপভোগ করছে । মানুষটার অবাধ্য চুলগুলো বারবার হাওয়ায় সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে চোখের ওপর চলে আসছে । তার ওপর ছানাগুলো নিজেদের ছোটো ছোটো জিভ দিয়ে ভালোবেসে গাল চেটে দিচ্ছে তার । সে যেন এসবে একটুও বিরক্ত নয় , বরং সস্নেহে উপভোগ করছে । অবাক হলাম , বাকিরা যেখানে এসব রাস্তার কুকুরের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে , ভুল করে ছুঁয়ে ফেললে বাড়ি ফিরে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয় , সেখানে এ মানুষ টা ব্যতিক্রম । মনে হলো , এমন একটা মানুষ , যার এসব অবোলা জীবদের ওপর খুব স্নেহ , তাকে নিঃসন্দেহে ভালোবাসা যায় । ধীরে ধীরে পা চালিয়ে বাড়ির দিকে এগোলাম , কিন্তু মন পড়ে রইলো ফেলে আসা মানুষটার ওপর । সেদিন সারাক্ষণ ওই কথাটাই ঘুরে ফিরে মাথায় এলো । এমন সময় দেখলাম আমি আর সে এক জায়গায় চুপচাপ বসে আছি , সে কি যেন বলছে , অথচ আমি শুনতে পাচ্ছি না । হঠাৎ সে এগিয়ে এলো আমার দিকে আর আমার গালে একটা চুমু খেয়েই দূরে ছুটে গেলো .... এতো অব্দি দেখেই উত্তেজনায় চোখ খুলে যেতেই দেখি আমি বিছানায় ঘুমাচ্ছিলাম , বুঝলাম স্বপ্ন ছিলো এটা । সারাদিনের কাজের ফাঁকে বুঝে গেলাম আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি সেইমতো স্কুল থেকে ফেরার পথে অপেক্ষা করতে লাগলাম তার জন্য , মনের কথাটা বলে দেওয়াই ভালো । কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও তার দেখা পেলাম না । কুকুর ছানা দুটো একমনে খেলছে । একবার ইচ্ছে হলো ওদের কাছে গিয়ে আদর করি , কিন্তু তারপর ভাবলাম আমায় দেখে যদি সে ফিরে যায় , তাই এগোলাম না । একটা সময় পরে রোদ পড়ে আসতে লাগলো , বুঝলাম সে আজ আসবে না । মনটা খারাপ হয়ে এলো , চুপচাপ বাড়ি ফিরে এলাম । এরপরে টানা বেশ কয়েকদিন সেই রাস্তায় তার জন্য অপেক্ষা করেছি , দেরীতে বাড়ি ফিরে বকুনিও খেয়েছি , কিন্তু সে আর কোনোদিনও আসেনি । ভেবেছিলাম এই পথটা বোধহয় সে ভুলে গিয়েছে । সময়ের সঙ্গে আমিও তার অপেক্ষা করা ছেড়ে দিলাম ।
তখন ক্লাস নাইনে পড়ছি , ছোড়দির বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে । আমি তো আঁটঘাট বেঁধে নেমেছি কনেযাত্রীর পক্ষ থেকে । বিয়ের দিন সারা বাড়ি লোকজনে ভর্তি , আমিও টুকিটাকি কাজবাজ করে দিচ্ছি । আটটা নাগাদ লুচি ভাজার মনকাড়া গন্ধে আর থাকতে পারলাম না , প্রথম ব্যাচেই খেতে বসে গেলাম । গরম গরম ফুলকো লুচি পাতে পড়া মাত্রই আঙুল দিয়ে সেটা ফাসাতে গেছি .... আর উফফ্ , লুচির গরম ভাপে আঙুল জ্বালা করে উঠলো । মুখের মধ্যে আঙুলটা ঢুকিয়ে থুতু দিয়ে জ্বালা ভাবটা কমাচ্ছি , এমন সময় পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো , " সাবধানে ছিঁড়তে হয় , না হলে গরম ভাপটা লাগে যে ... আচ্ছা দাঁড়াও " বলে সে নিজেই আমার পাতের গরম ভাজা লুচি গুলো টুকরো টুকরো করে দিয়ে বললো , " এবার খেয়ে নাও , অসুবিধা হবে না আর " । সেই টুকরো লুচি দিয়ে একটা পনীরের টুকরো মুখে দিয়ে ভাবতে লাগলাম , এমন মানুষ-ও আছে তাহলে ? একটু লজ্জা লজ্জা লাগলো , নীচু স্বরে বললাম , " ধন্যবাদ " । সে দেখি বেগুনিতে একটা কামড় দিয়ে বললো , " কনেপক্ষ নাকি বরপক্ষ ? " আমি সেটা জানাতেই সে বললো , " আমি বরপক্ষের , বাড়ি অনেকটা দূরে , তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচ্ছি , ফিরতে হবে যে । এবার তোমাদের পালা , তোমরা আসবে আমাদের ওখানে , আবার দেখা হবে তখন , তা কিসে পড়ো ? " নাইনে পড়ি বললাম । সে বললো , " বেশ বেশ , ভালো পড়াশোনা করো , তোমার ও এমনভাবে বিয়ে হবে , আমায় নিমন্ত্রণ করতে ভুলো না কিন্তু তখন " । আমি হেসে ঘাড় নাড়লাম । মাংস আমার অতি পছন্দের । একটা ঠ্যাং চুষতে চুষতে ভাবলাম , এনার নামটা জিজ্ঞেস করে নিই বরং , কিন্তু তারপর ভাবলাম , এখন থাক , কিছু যদি মনে করে , খেয়েদেয়ে নিয়ে আয়েস করে বসে জিজ্ঞেস করা যাবে । আইস ক্রিমের বাক্সটা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি সে নেই । হয়তো বিয়ের ওখানে আছে , ভেবে ওখানে গেলাম , কিন্তু পেলাম না । বুকটা হালকা ধকধক করে উঠলো । তার নামটা জিজ্ঞেস করা হলো না যে ... সারা বাড়ি খুঁজলাম , কতোজনের সঙ্গে ধাক্কাও লাগলো , কেউ কেউ তো বলেই ফেললো , " উফ কি জ্বালাতন রে বাপু , চোখেও দেখে না " । তাও আমি দমলাম না । অবশেষে ক্লান্ত হয়ে যখন ঠাম্মার ঘরে ঢুকলাম, তখন চোখে জল চলে এসেছে । সেটা না মুছেই বুড়িকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম । সে রাতে স্বপ্ন দেখলাম , সেই মানুষটা একটা থালায় লুচি নিয়ে এসে হাত দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে লুচি ছিঁড়ে মাংস দিয়ে আমার মুখে তুলে দিচ্ছে । জিজ্ঞেস করলাম , " নাম কী তোমার ? " সে হাসতে হাসতে বললো , " আমাদের ওখানে এসো , বলবো " । বৌভাতের দিন আমি এতো তড়িঘড়ি করতে লাগলাম যেন আমি না গেলে অনুষ্ঠান আটকে যাবে । সেজো পিসিমনি ঠাট্টা করে বললো , " আমার মনে হয় এই সুযোগে আমাদের মানুর বিয়েটাও দিয়ে দেওয়া উচিত " । আমার কান গরম হয়ে উঠলো , আমার বিয়ে যদি ওই মানুষটার সঙ্গে হয় , তবে এক্ষুনি আমি বিয়ে করতে রাজি । ও আমায় প্রতিদিন কি সুন্দর করে গরম খাবার ফুঁ দিয়ে খাইয়ে দেবে ... ঈশ ,কী লজ্জা লাগছে ! ছোড়দির শ্বশুরবাড়ি গিয়েই অন্য কাউকে না দেখে আমি খুঁজে বেড়াতে লাগলাম সেই মানুষটাকে । কিন্তু কোথথাও পেলাম না দেখতে । তারপর মনে হলো , খাবার ওখানে নেই তো ? একছুটে সেখানে গিয়ে দেখি কতো লোক খেতে বসেছে সেখানে । কিন্তু ওই মানুষটা কোথায় ? কয়েকজন আবার আমায় দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে । গা টা জ্বালা করে উঠলো , তাও এদিক ওদিক তাকালাম যদি চোখে পড়ে কিন্তু হাল ছেড়ে দিতে হলো অবশেষে । মনমরা হয়ে থাকলাম সারাক্ষণ । নতুন জামাইবাবু আমার গাল টিপে বললো , " কি হে , কাউকে মনে ধরেছে নাকি ? " মনে হলো বলি , হ্যাঁ , একজন আছে , যে খুব সুন্দর করে গরম লুচি ছিঁড়ে ফুঁ দিয়ে দেয় , নাম জানো তার ? তারপর ভাবলাম , এতে সবাই আমায় নিয়ে হাসাহাসি করবে , তাই না বলাই ভালো । বাড়ি ফিরে এসে কতোবার যে ভেবেছি , হয়তো সে কোনো প্রয়োজনে ফের আসবে আমাদের বাড়িতে আর আমি তাকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে নেবো তার নাম আর সেদিন কোথায় ছিলো সে ! কিন্তু কোথায় কি ?সেই মানুষটাও অল্প অল্প করে ফিকে হয়ে আসলো আমার মনে ।
মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হলাম ঋজু স্যারের কোচিনে । অঙ্কে ভালো নম্বর ছিলো তাই সায়েন্স নিয়েছিলাম । ঋজু স্যার পড়াতো তিনতলায় । স্যারের দুই ছেলে মেয়ে , দু'জনেই পড়াশোনায় ভালো । আমি একটু তাড়াতাড়ি চলে আসতাম কোচিং এ । উদ্দেশ্য ছিলো স্যারের ঠিক পাশে বসা , যাতে সব অসুবিধেগুলো নির্দিধায় জানাতে পারি । সেদিনও পড়ার ঘরে বসে খাতা খুলে অঙ্ক গুলো দেখছিলাম মিলিয়ে । কয়েকটা পারিনি , স্যারকে দেখাতে হবে । তাই পেন বের করেই বসেছিলাম । এমন সময় " তুমি বেশ ভালো অঙ্ক পারো তো " কথাটা শুনেই মুখ তুলে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে । অল্প হেসে বললাম , " কে বললো ? " " বাবার মুখে শুনেছি , আমিও টুকিটাকি পারি অঙ্ক । তা দেখি , আজ কোন্ গুলো পারোনি " , বলেই সে এসে আমার পাশে বসে পড়লো । আমি প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও খাতাটা তাকে দেখালাম । সে বেশ আবিষ্ট হয়ে বললো , " তোমার হাতের লেখা তো দারুন , বড়ো বয়সে সবার handwriting কম বেশি বিগড়ে যায় , কিন্তু তোমার .... " বেশ লাগলো অন্যের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে । যে অঙ্ক গুলো পারিনি , সেগুলো সে বেশ সাবলীল ভাবে আমায় বোঝাতে লাগলো । আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকটার উত্তর পেয়ে গেলাম । হাসি হাসি মুখে ওর দিকে তাকাতেই দেখি ও আগে থেকেই আমার দিকে চেয়ে রয়েছে । আমি তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলো । জানি না কেন বুকের মধ্যে হালকা ছ্যাঁত করে উঠলো । তবে কি ... ! হঠাৎ সে আমার ডানহাত টা চেপে ধরে বললো , " আরোও ভালো করে পড়াশোনা করো , যদি অঙ্ক বুঝতে সমস্যা হয় , আমি মাঝেমাঝে দেখিয়ে দেবো , বুঝলে ? " আমি দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে বললাম , " হু " সে আমার গালটা আদর করে টিপে দিয়ে চলে গেলো । সেদিন বাড়ি ফিরে মনটা খুব খুশি খুশি লাগছিলো । সময় নষ্ট না করে স্যারের হোমওয়ার্কের খাতাটা খুলে বসলাম । কিন্তু বারবার মন চলে যাচ্ছিলো সন্ধ্যের ঘটনায় । আচ্ছা , ও কি আমায় পছন্দ করে তাহলে ? কিন্তু কেন ? অঙ্ক পারি বলে , হাতের লেখা সুন্দর বলে , নাকি অন্য কোনো কারণ আছে ! রাতে খেতে বসে আনমনে আমার পছন্দের ইলিশ মাছের ডিমের বড়াটা না খেয়েই উঠে পড়লাম । বাবা মা বেশ অবাক হয়েছিলো । এরপর স্যারের বাড়িতে আরোও আধঘন্টা আগে পৌঁছে যেতাম , ছোট্ট একটা আশা ছিলো , হয়তো তার সঙ্গ আরোও কিছুক্ষণ বেশি পাবো । কিন্তু ঘড়ির কাঁটা নিজের ছন্দে সাতটার ঘরে পৌঁছে যেতো , অথচ তার দেখা পেলাম না । মনে মনে অধৈর্য্য হয়ে উঠছিলাম , একদিন আর থাকতে না পেরে স্যারকে বলেই ফেললাম , " আপনার বাড়িতে সব ঠিকঠাক তো ? " স্যার কিছুক্ষণ আমায় জরিপ করে বললো , " হম , কেন বল তো ? " " না এমনিই " আমি লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলাম । তারপর থেকে ক্লাস করতে করতে কতোবার যে হাওয়ায় কেঁপে ওঠা পর্দাটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকেছি , সেটা আমিই জানি । যতো সময় গেছে , ততোই আমার আকুলতা কমে এসেছে । একটা সময় পরে সবকিছু মন থেকে মুছে ফেলেছি । পড়া শুরু হওয়ার ঠিক দশ মিনিট আগে অন্যান্য অনেকের সঙ্গে একসাথে কোচিং এ ঢুকেছি ।
কলেজে সেইভাবে কারুর সঙ্গে মিশতাম না । নিজের মতোই থাকতাম , অযথা বকবক করতাম না । প্রফেসরদের কাছে " good student " এর তকমাটা পেয়ে গিয়েছিলাম । একদিন ল্যাবে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি , পাশের টেস্টটিউব দুটোয় সোডিয়াম আর সালফার । কিন্তু কোন্ টা যে ১০% মেশাতে হবে , কিছুতেই মনে পড়ছে না । কাউকে যে জিজ্ঞেস করবো , সে উপায় নেই । কারন এখানে সবাই স্ব-দলে বিভক্ত । এই গ্ৰুপিজম আমার কোনোকালেই পছন্দ নয় , তাই কারুর সঙ্গে সেভাবে আলাপ করি নি । এখন নিজের প্রয়োজনে কথা বলতে চাইলে ওরাই বা সাহায্য করবে কেন ! কপাল বেয়ে একটা ঘামের রেখা গাল বেয়ে নামছে । কী যে করি এবার ! " Any problem ? " প্রশ্নটা শুনে এপাশে তাকিয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে রয়েছে । হাতে একটা টেস্টটিউবে নীলচে সোডিয়াম । আমি শুকনো হেসে বললাম , " ইয়ে মানে .... কোনটা যে মেশাতে হবে , ঠিক ... "। সে আমার চোখে চোখ রেখে বললো , " জানি তুমি একজন ভালো স্টুডেন্ট , নিজের পড়াশোনা নিয়েই সবসময় মেতে থাকো ।
কিন্তু কখনও সময় পেলে বইয়ের বাইরের পৃথিবীটায় একটু শ্বাস নিয়ে দেখো .... সেখানে সোডিয়াম , পটাশিয়াম ছাড়াও আমরা সবাই আছি , টেস্টটিউবের বাইরের পৃথিবীটা ধূসর নয় , সেখানে ভুলে যায় না কেউ , মিলেমিশে বাঁচে ... আমরা এতোটাও খারাপ নই "
বলে আমার হাতে সোডিয়ামের টিউবটা দিয়ে বললো , " যদি ভরসা করো , তাহলে মেশাও আর নিজেও মিশে দেখো , সবাই সমান হয় না "। সে চলে গেলো । আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম ক্রমশ দূর হতে থাকা তার ছায়াটার দিকে । এগুলো কি কিছুর ইঙ্গিত ছিলো ? কিভাবে মিশবো আমি ? কে আপন করে নেবে আমায় ? হঠাৎ বেলের শব্দে মনে পড়লো সোডিয়ামটা মেশানো হয় নি । তাড়াতাড়ি কাজটা কমপ্লিট করে ইনচার্জ প্রফেসরকে দেখিয়ে অ্যাটেনডেন্স নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে । চোখ থেকে চশমাটা খুলে আকাশের দিকে তাকালাম । নীল রঙের জামদানি শাড়িতে অপরূপ লাগছে তাকে । মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে । হঠাৎ মনে হলো , সত্যিই পৃথিবীটা ধূসর নয় । এখানেও শ্বাস নেওয়া যায় । আরামে ঘুমানো যায় , হঠাৎ করেই কাউকে ভালো লেগে যায় । ভয় হলো , সেও আবার বাকিদের মতোন হারিয়ে যাবে না তো ! চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম ল্যাবের বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে । একগোছা ফুলে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে গাছটা । মনে হলো , দৃশ্যটা বেশ নতুন লাগছে আজ । আচ্ছা , এভাবেও প্রেমে পড়া যায় তাহলে ! কিছুক্ষণ পর দেখি ওদের গ্ৰুপটা হইচই করতে করতে বেরিয়ে আসছে । আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ওর বন্ধুদের ফিসফিস করে কিছু একটা বলে ওখান থেকে বেরিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো । আমি বড্ড নার্ভাস ফিল করছি । মনে হচ্ছে , এই বুঝি গলা শুকিয়ে গেল । সে কাছে এসে বললো , " তাহলে good student , কি ঠিক করলেন ? আমার মতো bad student এর সাথে আজ চা খেতে যাওয়া হবে নাকি ? আমরা কিন্তু বঙ্কুদার দোকান থেকেই চা খাই । স্পেশাল চা , উইথ আদা , লেবু এন্ড ... আর একটা জিনিস আছে , সেটা এখন বলবো না । খেয়ে বুঝতে হবে ওটা কী ! আসুন " বলেই আমার হাতের মুঠো চেপে ধরে টেনে নিয়ে গেলো চায়ের দোকানে । আমার মনে হলো , জীবনে এভাবে হাত চেপে ধরে টেনে নেওয়ার মানুষ সবার দরকার । বাইরের পৃথিবীটা যে ধূসর নয় , সেটা কেবল সেইই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারে । গরম চায়ে ফুঁ দিতে দিতে সে বললো ,
" মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে আয়নায় নিজের মুখটা দেখেছেন কখনো ? চশমার আড়ালে থাকা চোখদুটো যে কিছু বলতে চায় , কখনও ভেবেছেন ? ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পায়েসের বাটিতে আঙ্গুল ডুবিয়ে সেটা মুখে রেখে দেখেছেন কেমন লাগে ? খাতার শেষ পাতায় কলেজের গার্ডকাকুর ছবি এঁকে গোঁফটা তালপাতার সেপাই এর মতো টেনে দিয়েছেন ? আকাশে কেটে যাওয়া ঘুড়ি দেখে ' ভো কাট্টা ' বলে চেঁচিয়ে উঠেছেন ? ভারত সেমিফাইনালে হেরে গেলে সারারাত চোখের জলে , নাকের জলে হয়েছেন ? অমন হাঁ করে কি তাকিয়ে আছেন ?
এসব যদি জীবনে কোনোদিনও না করে থাকেন , তাহলে আপনার জীবনটা সত্যিই বৃথা । আচ্ছা এক কাজ করুন " বলে উঠে দাঁড়িয়ে সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো । আমি নিঃসংকোচে তার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম । সে মুচকি হেসে বললো , " সামনে দেখুন একজন বুড়ি মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছে । আমরা ওর কাছে গিয়ে ' ও বুড়ি তোমার বয়স কতো ' বলেই দৌড়ে পালাবো , বুঝলেন ? " আমি ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রয়েছি দেখে সে ফিক করে হাসলো , " জীবনে কিছু কিছু মনে রাখার মতো ঘটনা ঘটাতে হয় , তাড়াতাড়ি " আবার আমার হাতে টান পড়ে । বুড়িকে প্রশ্নটা করেই উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলাম আমরা । পিছন থেকে বুড়ির চিল্লানি কানে আসছে , " মুখপোড়া ছোঁড়া ছুঁড়ির দল , হাড় বজ্জাত , তোদের ঘরে মা ঠাকুমা নাই লো ! অ্যাঁ ... সব্বোনেশে .... "। আরোও কতো কথা , সবটা শুনতে পাই নি । হাঁপাতে হাঁপাতে যখন দাঁড়ালাম , শরীরে ক্লান্তির চিহ্নমাত্র নেই । মনটা যথেষ্ট ফুরফুরে লাগছে । সে আমার দিকে চোখ মটকে বললো , " কেমন লাগলো ? " " দারুন " আমি উত্তর দিলাম । সে ফিসফিস করে বললো , " আপনার ওই বোরিং good student ওয়ালা লুকের চেয়ে এটা হাজারো বেটার ... তো ! কি ভাবছেন ? এই জীবনটা ভালো নয় কি ? " ইচ্ছে হলো বলি , তুমি সারাজীবন এভাবে পাশে থাকলে আমি এমন জীবন সবসময় কাটাতে রাজি , মুখে বললাম , " ভালো "। এরপর থেকে বাড়িতে আয়নার সামনে কতোরকম ভাবে যে নিজেকে দেখেছি , নিজের মনেই বকবক করেছি নিজের সঙ্গে । রাতে পড়তে পড়তে খুব লুকিয়ে একখানা চিঠি লিখেছি তার জন্য , কিছু কিছু রোম্যান্টিক quotes আবার গুগল থেকে সার্চ করে বের করেছি । বাথরুমে স্নান করতে করতে আপন মনে গান গেয়ে উঠেছি । বাড়ি ফিরে মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে গালে চুমু খেয়ে বলেছি , " অ মা , মা .. আজ একটু আদর করো না গো ... "। মা অবাক হয়েছে , তাও নুন হলুদ মাখানো হাত দিয়ে আমার গাল টিপে দিয়েছে । নিজের ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম যে , কেমন লাগছে এতে ! অনেকদিন পর বৃষ্টিতে ভিজে মনে হলো বৃষ্টির জলের মনকাড়া এক গন্ধ আছে , যেটা হয়তো এর আগে পাইনি কখনও । খেতে খেতে জিভে কামড় খেয়ে হেসে ফেলেছি ফিক করে , ঠাম্মা বলতো , কেউ যখন আমাদের কথা খুব ভাবে , তখন আমরা এভাবে কামড় খাই .... তার মানে .... ! আচ্ছা , আমায় লাল রঙে বেশি মানায় , নাকি নীলে ? বাবাকে বলতেই বাবা বললো , " কি ব্যাপার বলতো ? আজকাল প্রেম টেম করছিস নাকি ? আগে তো এতো ... " বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি " উফফ্ তুমিও না .. " বলে লজ্জায় ঘরে ঢুকে গিয়েছি । তার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে বেশ কয়েকটা ছবি সেভ করে নিয়েছি । ইচ্ছে আছে সুযোগ পেলে সব ছবিগুলো একসাথে বাঁধিয়ে নিজের টেবিলে রেখে দেবো । অবশেষে এসে গেলো ভ্যালেন্টাইনস ডে । আমি কোনোবারই এসব বোকা বোকা ডে পালন করি না । কিন্তু এবার মনে হচ্ছে , ভাগ্যিস এই দিনটা ছিলো , নাহলে যে মনের কথা মনেই রয়ে যেতো । সময়মতো রঙিন প্যাকেট মোড়া গিফ্ট আর আমার লেখা সেই প্রেমপত্র নিয়ে হাজির হলাম নির্দিষ্ট জায়গায় । আজ ওকে বেশ সুন্দর লাগছে আগের চেয়ে । জানি ও ও আমাকে মনে মনে পছন্দ করে । সব লজ্জা একজায়গায় করে সবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওকে মনের কথা জানালাম । বুকটা খুব ধুকপুক করছে । কান গরম হয়ে যাচ্ছে । নিঃশ্বাস টা ঘন লাগছে । মানুষ টা খুব শান্তভাবে আমার কথাগুলো শুনলো , তারপর বললো , " তোকে সবসময় বন্ধু হিসেবেই দেখেছি , একটু একটু করে স্বাভাবিক করে তুলতে চেয়েছি , মনে হয়েছিলো তুই খুব একলা , তাই তোকে সঙ্গ দিয়ে একাকিত্ব দূর করিয়েছি । বাঁচতে শিখিয়েছি আমাদের মতো , সবকিছুকে ভালোবাসতে শিখিয়েছি । কিন্তু .... আমার কাছে তুই খুব ভালো একজন বন্ধুই আছিস আর থাকবি সারাজীবন । এর বেশি কিছু আশা করিস না ... কারন আমার পক্ষে এটা সম্ভব নয় , প্লিজ ভুল বুঝিস না । দেখ , তোকে আমার ভালোলাগে , কিন্তু ভালোবাসি না । আমি চাই না তুই মিথ্যেকে আঁকড়ে বাঁচিস , তাই সবসময় পাশে আছি তোর , কিন্তু ভালোবাসতে পারবো না , সরি .... " ওর পরের কথাগুলো কানে ঢোকেনি আর । মনে হয়েছিলো এর চেয়ে ও আমায় মেরে ফেলতে পারতো ! লজ্জায় অপমানে বাকি কথা কানে ঢোকেনি আর । অবশেষে চোখের জল মুছতে মুছতে যখন বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম , তখন ভেতর থেকে পুরো ভেঙে পড়েছি আমি । চিঠিটা রাস্তায় ছিঁড়ে ফেলেছিলাম , গিফ্টটা কোথায় যে ছুঁড়ে দিয়েছি , মনে নেই । সারাক্ষণ কিচ্ছু খাই নি , মুখে খাবার তুলতে পারি নি । বাবা মা আমার দরজায় অনেকবার কড়া নেড়ে গেছে । তাও বের হইনি । যে মানুষটা আমায় আকাশ চেনালো , সে আমায় ভালোবাসে না ? যার জন্য আমি নিজেকে ভালোবাসতে শিখলাম , সে আমায় কোনোদিন ভালোই বাসেনি ? চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছিলো , গলা শুকিয়ে গিয়েছে , কিন্তু হুঁশ নেই সেদিকে । জীবনে যে কটা বসন্ত এসেছে , সবকটা বেরঙিন । কেউ ভালোবাসেনি আমায় , কেবল আমার দিক থেকেই অনুভূতি ছিলো , one sided . আর ওরা ! আমায় বাঁচতে শিখিয়ে নিজেরাই সরে গিয়েছে । কেন ? সবসময় আমার সঙ্গেই কেন হয় এগুলো ? কি দোষ করেছি আমি ? বিছানার চাদর খামছে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি । মাঝরাতে উঠে বসেছি বিছানায় । কোন্ টা সহজ ? অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেওয়া ? নাকি ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কেটে ফেলা ? ওপর দিকে তাকালাম , পাখাটা ঘুরছে । গলায় ফাঁস দিলে কেমন হয় ? নাকি ছাদে উঠে যাবো ? সেটাই ভালো । চুপচাপ ছাদে উঠে গেলাম । উঠে দাঁড়ালাম পাঁচিলে । মাথার ওপর তারা জ্বলা আকাশ । হাওয়া বইছে শিরশির করে । চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে আমার । মনটা খুব শান্ত । সামনে তাকিয়ে দেখি কতো বাড়ি , গাছপালা । দুটো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকেই যাচ্ছে অনবরত । আচ্ছা , কাল ভোরে আমার ডেড বডিটা কে প্রথম দেখবে ? খুব বিভৎস দেখাবে কি আমায় ? সেই মানুষটার চোখে কি একফোঁটা জল ও আসবে না ? নিজের মনে একটু হলেও অনুশোচনা হবে না ওর ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ একটু একটু করে বাড়ছে । হঠাৎ মনে হল সবকিছু থমকে গেলো কী ! বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম , তারপর হাত দুটো ছড়িয়ে দিলাম দু'দিকে ।
কি ভাবছেন ? ঝাঁপ দিলাম ? হমম , দিতাম হয়তো , যদি না পেছন থেকে মায়ের আর্তনাদ কানে আসতো , " মানুউউউ ... " উপেক্ষা করতে পারি নি এই ডাক , বিশ্বাস করুন । বাবা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আমায় নীচে নামিয়েছে , ঠিক যেমন করে ছোটোবেলায় কোলে নিত । মা এসে থাপ্পড়ের পর থাপ্পড় মেরেছে গালে । আমি আটকাইনি । মারুক , যতো ইচ্ছে মারুক । খুব আরাম লাগছে মার খেতে, তৃপ্তি লাগছে ভীষন মনে পড়ছে , আমি কী ভীষণ ভুল করতে যাচ্ছিলাম , স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়েই মেতেছিলাম । ভাবি নি আমি ছাড়া এই মানুষগুলোর বাঁচার দ্বিতীয় কোনো অবলম্বন নেই । আমার মুখ চেয়ে বেঁচে রয়েছে এরা । আর আমিই কি না .... ! ঠাম্মা মারা যাওয়ার সময় আমি যে প্রমিস করেছিলাম , সবাইকে আগলে রাখবো । এটা কি করছিলাম আমি ! যে আমায় ভালবাসে না , তার জন্য নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিলাম ? খুব অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে । মা আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে , " কেন করছিলি এমন তুই ? কিসের কষ্ট তোর ? জীবনে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সবাই জিততে পারে না ! তুই কিনা নিজে থেকেই .... তোর বাবাকে দেখ , মানুষটা নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছে তোকে বড়ো করার জন্য ... আর তুই ? ডিপ্রেশন , ব্রেক আপ , অর্থ সমস্যা - কোন্ টা ? কিসের জন্য এমন করছিলি ? বল আমায় আমরা বেঁচে আছি এখনো ... কিসের ভাবনা তোর ?
জীবনে সবকিছু পাওয়া যায় না মানু ... কখনো কখনো নিজেকে সামলে নিতে হয় আর ব্যর্থতাকে 'it's okk' বলে সামনে এগোতে হয় । আমরা মানুষ , আমরা সব করতে পারি , শুধু ধৈর্য্যটা দরকার ।
জীবনে সবার জন্যই ভালো কিছু অপেক্ষা করে থাকে , বেঁচে থাকার অবলম্বন অনেক আছে , শুধু সেটা খুঁজে নিতে হয় ... কান্না পেলে কেঁদে নে মানু , এটা কিন্তু খুব স্বাভাবিক । এতে লজ্জার কিচ্ছু নেই । দেখবি কাঁদলে মন হালকা হয়ে যায় । আমাদের যদি মনের কথা বলতে না পারিস , আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন কর , ঠিক উত্তর পাবি ... জীবনে যে মানুষগুলো সবসময় তোর পাশে আছে , তাদের জন্য বাঁচতে হয় আমাদের । মরে যাওয়া খুব সোজা , আসল মানুষ তো জানে বাঁচার আনন্দ কতোটা .... "। সত্যিই , জীবনে এই মানুষদুটো না থাকলে আমরা কোনোদিন জানতাম ই না যে , আমাদের গুরুত্ব কতোটা ! আমাদের চলার পথে ওরা ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করে রাখে , যাতে ভুল পথে না চলে যাই । সেজন্য ওরা যদি কোনো কারণে বকুনি দেয় কিংবা মারে , তখন সেটাকে মেনে নিতে হয় । কারন নিঃস্বার্থভাবে ওরাই সবসময় পাশে থাকবে আমাদের । বুঝলে দিদিভাই ?
এতো অব্দি বলে আমি থামলাম । আমার পনেরো বছরের নাতনি চোখের জল মুছে আমার বুকের কাছে আরোও একটু সরে এসে বললো , " তাহলে তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে তুমি পেলে কিভাবে ? "
তেনার খোঁজ পেয়েছিলাম চাকরী করতে করতে । সন্ধ্যে সাতটার বাস ধরার জন্য আমরা একই স্টপেজে রোজ দাঁড়িয়ে থাকতাম । একবার হয়েছিল কি , প্রবল বৃষ্টি নামে , অথচ আমার কাছে ছাতা নেই । কি করবো ? তখন তিনি লাজুক মুখে জানালেন যে , ওনার বাড়ি বাস থেকে নামতেই এক মিনিটের পথ । আমার আপত্তি না থাকলে ওনার ছাতাটা আমি নিয়ে যেতে পারি । পরদিন এখানেই ফিরিয়ে দেবো সেটা । সেইমতো কাজ হলো । ছাতা নিয়ে পরদিন হাজির হলাম বাস স্ট্যান্ডে । কিন্তু ওনার আর দেখা নেই । তিনদিন অপেক্ষায় রইলাম । পরের দিন এসে হাজির উনি । প্রশ্ন করতেই জানালো , জ্বরে পড়ে গিয়েছিলো । আমার মায়া হলো , ইশশ , আমায় ছাতা দিয়ে বেচারা নিজে ভিজেছে । একটু সহমর্মিতা তো দেখাতেই হয় , বললাম , " চা খাবেন ? " সে বললো , " বেশ , তবে একটু আদা আর লেবু দিয়ে স্পেশাল চা খাওয়া যাক " । তার কথাটা শুনেই বুকটা ধুক করে উঠলো । চা খেতে খেতে জানতে পারলাম সে বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসে । সোঁদা মাটির গন্ধ আর ন্যাপথলিনের গন্ধ ব্যাপক লাগে তার । মাঝরাতে উঠে ফ্রিজ থেকে রসগোল্লা বের করে খাওয়া তার দৈনন্দিন অভ্যেস । স্নান সেরে ভিজে গামছাটা বিছানায় রেখে ভুলে যায় সে । পথের কুকুর বিড়াল খুব ভালোবাসে । খোলা আকাশ দেখে সে বিভিন্ন ছবি কল্পনা করে । সে বাঁচতে শিখে গেছে , জীবনটা উপভোগ করতে জানে । বুঝলাম , একে হাতছাড়া করা উচিত নয় । ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম , প্রেম টেম করে কিনা ! সে বললো , " ওসব প্রেম টেম পোষায় না , বিয়ের পর হানিমুনে গিয়ে প্রথম প্রেমের স্বাদ নেবো , একেবারে কোমর বেঁধে নামবো " । এমন মানুষকে হাতছাড়া করা বোকামি , তাই সেদিন বাড়ি ফিরেই বাবা মাকে বলে সব ঠিক করে রাখলাম । পরদিন সকাল হতে না হতেই মিষ্টির হাঁড়ি , ঘটক আর বাবা মাকে পাঠিয়ে দিলাম সম্বন্ধের গাট বন্ধনের জন্য । যা হোক , একটা শুভ দিন দেখে আমাদের চার হাত এক হয়ে গেলো । হানিমুনে গেলাম কাশ্মীর । ওহ্ , তারপর সে কী প্রেম ! স্বয়ং রোমিও জুলিয়েট থাকলে বোধহয় লজ্জা পেয়ে যেতো । তাই বলছি দিদিভাই , জীবনের সঠিক মানুষটা সময়মতো আসবে , সেজন্য খুচরো খাচরা প্রেমের জন্য কষ্ট পাওয়া কেন ? আমাদের নাতজামাইকেও বিয়ের আগে বাজিয়ে নিতে হবে যে , সে আকাশ ভালোবাসে কি না ? বৃষ্টির জল গায়ে মেখে হিহি করে কাঁপতে ভালোবাসে কি না ? নরম রোদে ছায়া হতে পারে কি না ! মাঝরাতে কৌটো থেকে চানাচুর চুরি করে খায় কি না ! তবেই না সে বাড়িতে আমার দিদিভাইকে পাঠাবো । তাই তো ? " দু'জনে মিলে হাসতে হাসতে কাশতে কাশতে চোখে জল এনে ফেললাম ।
---------------------------------------
©আরশি সেন (স্বাগতা)
হরিণাভী এম এন রয় রোড , কলকাতা - ৭০০১৪৮ ,
দক্ষিণ ২৪ পরগণা