গল্প।। দুশ্চিন্তার মেঘ ।। সেখ মেহেবুব রহমান
দুশ্চিন্তার মেঘ
সেখ মেহেবুব রহমান
স্নান সেরে সবে খেতে বসেছে মনামী, হঠাৎই ফোন বেজে উঠল। দ্রুত সেদিকে নজর দিতে দেখে অফিস থেকে ফোন আসছে। মনে হয়, আবার কোনো পজিটিভ কেস। রিসিভ করতেই ওপার থেকে এক স্থানীয় বাসিন্দার করোনা পজিটিভ হওয়ার সংবাদ এল। এক্ষুনি বেড়োতে হবে। হাসপাতাল কর্মীরা আসছে। জনৈক ব্যাক্তিকে দ্রুত ভর্তি করতে হবে। অতএব, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাওয়া শেষ করেই বেড়োতে হবে।
মনামী পেশায় স্বাস্থ্যকর্মী। পিতৃহীন সংসারে মা, ভাইয়ের দায়িত্ব মনামীর কাঁধেই। মাস্টার্স শেষে কিছুদিন টিউশন পড়িয়ে সংসার চালিয়েছে। সাথে, অন্য চাকরির প্রস্তুতিও নিয়েছে জোরকদমে। বেশ কয়েক বছর আগে চুক্তি ভিত্তিক কাজটি পায়। পরে যদিও এই পদেই স্থায়ী নিযুক্তি হয়। স্বল্প অর্থ হলেও কাজটা মন দিয়েই করে। কর্মের প্রতি একনিষ্ঠতার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রশংসাও কুড়িয়েছে। কাজই এখন ওর আগামীর পথ চলার অনুপ্রেরণা।
করোনা পরিস্থিতিতে মনামীর চাপ বহুগুণে বেড়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে সচেতন করা, আক্রান্ত ব্যাক্তিকে হাসপাতালে পাঠানো, রোগীর পরিবারের মানুষজনের সোয়াব সংগ্রহ, এরকম নানাবিধ দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করছে। এরই মধ্যে সাক্ষী থেকেছে বিচিত্র অভিজ্ঞতার। কখনো তা অনুপ্রেরণাদায়ক, কখনো আবার হতাশা মিশ্রিত তিক্ততার স্মৃতি।
করোনা অতিমারি মানুষের জীবনযাত্রা বদলে দিলেও, ব্যার্থ থেকেছে একাংশ মানুষের স্বভাব পরিবর্তনে। কুসংস্কার এখনও মানুষের সাথে জড়িয়ে রয়েছে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে। মূলত বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব এর জন্য দায়ী। যুক্তিহীন অন্ধ চেতনায় আজও তারা এই সমাজকে দেখতে অভ্যস্ত। এইসব কিছু সামলে মনামীকে নিজের কাজ করে যেতে হচ্ছে। শত বাধায় এখনও সে অপ্রতিরোধ্য থেকেছে।
করোনার দ্বিতীয় প্রকোপ বাড়ার সাথেই মনামী নিজেকে পরিবারের সাথে আলাদা করে নেয়। মূলত, মা ভাইয়ের সুস্থতার স্বার্থে। ওর ঘরে সেভাবে কেউই প্রবেশ করে না। নিত্যদিন এভাবে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই অতিবাহিত হচ্ছে।
ফোন রেখে মনামী পুনরায় গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করল। খাওয়ার সময় এই ব্যস্ততা দেখে, জানলার বাইরে থেকে মায়ের ধীরে খাওয়ার আদেশ এল। যদিও তা দ্রুত প্রত্যাখ্যান করে এক গাল ভাত নিয়ে মনামী বলল, "সময় নেই মা। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে"।
মেয়ের কথা শুনে একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, "তোর তো শুধু ডিউটি। যত ঝামেলা আমায় পোহাতে হয়"।
মনামী বলল, "কেন? কি হয়েছে?"
তিনি বললেন, "কি হবে আবার! পাড়ার লোকের নোংরা কথা তো আমায় শুনতে হয়। সবাই বলে, 'আমি নাকি করোনা লালন পালন করছি!' রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে মেলা মেশা ওরা ভালো চোখে নেই না। তোকে এসব বলে যদিও কোনো লাভ নেই। কোনোদিনই বুঝবি না"।
এই মারণ ভাইরাস বহু মানুষের প্রাণ কেরেছে। এই মুহূর্তে পারস্পরিক সহযোগিতা একান্ত কাম্য। একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে যথাসাধ্য চেষ্টায় আমাদের মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু কিছু মানুষের অজ্ঞতা সেই পথে কাঁটা হিসাবে দাঁড়িয়েছে। শারীরিক দূরত্ব অপেক্ষা তারা মানসিক দূরত্ব বেশি বাড়িয়ে নিয়েছে। মনামী সেই অসহযোগিতার স্বীকার। করোনা মোকাবিলায় নিযুক্ত থাকায়, পাড়া প্রতিবেশী তাকে সামাজিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। সেই সকল মানুষদের দাবী, মনামীর দ্বারা সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এভাবে একজন যোদ্ধার সাথে নির্মম আচরণ করতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্থ নয়। অগ্রণী চিন্তাধারা এ এক জঘন্য অধঃপতন।
মনামী সাময়িক খাওয়া থামিয়ে বলল, "আমি স্বাস্থ্য কর্মী। এটা আমার কাজ। কতো লোককে সঠিক সময়ে চিকিৎসার সুযোগ করে দিয়ে বাঁচানো গেছে জানো?"
মেয়ের কথা প্রসঙ্গে বললেন, "কিন্তু ওদের কি সে হুশ আছে? শুধু নিজেদের নিয়েই ভাবছে"।
মনামী বলল, "জানি মা, ওরা এসব দেখেও অন্ধ। তুমি ওদের কথায় কান দিও না"।
মেয়ের কথায় আশ্বস্ত হতে পারলেন না, বললেন, "ওরা অসভ্য ভাষা ব্যাবহার করে। কেমন গালিগালাজ করে জানিস? এসব আর কত সইব"।
মনামী সবই জানে। এই কুকথার আক্রমণ ওরা কানেও পৌঁছেছে। গত পরশু কয়েকজন তো ওকে সরাসরি হুমকি দিয়েছে। মা যাতে চিন্তা না করে সেই জন্যই জানায় নি। মনের মাঝে চেপে রয়েছে। সেই সকল ব্যক্তিবর্গের প্রতি ওর নিজেরও সীমাহীন রাগ, ক্ষোভ আছে। মনে মনে শপথ নিয়েছে সঠিক সময়ে তার ব্যাবস্থা নেবে। এখন যদিও সেসব সংযম করে বলল, "এবার কিছু বললে তুমি আমায় জানবে। আমি সামলাবো"।
তিনি বললেন, "তোকে জানিয়ে লাভ? তুই হয় হাসপাতালে নাহলে রোগীর বাড়িতে। হ্যাঁ রে, তোদের অন্য স্টাফরা ডিউটি করে না? সব সময় তোকেই কেন এগিয়ে দেয়!"
মনামী হেসে বলল, "কি যে আজেবাজে বকছ"।
"তুই হাসছিস!"
"তাছাড়া, তুমি এসব উল্টোপাল্টা বকছ যে"
"তোকে নিয়ে পারব না আমি। ভালো লাগে না"
মনামী মাকে আশ্বস্ত করে বলল, "দেখো, আমরা কিন্তু সবাই মিলেই পরিস্থিতি সামলাচ্ছি। সবার ডিপার্টমেন্ট তো এক নয়। কাজও তাই আলাদা। তুমি এসবে মাথা ঘামিও না"।
তিনি মনামীর কথায় বিন্দুমাত্র সন্তুষ্ট হলেন না। চোখেমুখের চিন্তার রেখা সেকথার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। গভীর উদ্বেগ নিয়ে বললেন, "টেনসন তো হবেই। এই ক'দিনে ঘরে কম বাইরে বেশি কাটিয়েছিস। খাওয়া দাওয়া ঠিকভাবে হচ্ছে না। বাইরের এত মানুষের সাথে মিশতে গিয়ে তুই নিজেই যদি..."।
মায়ের দুশ্চিন্তা বুঝে বলল, "তুমি ভেঙে পড়লে কি'করে মন দিয়ে কাজ করি? এতো ভেবো না। সব ঠিক থাকবে"।
মেয়ের উত্তরে তিনি নিশ্চুপ রইলেন। মনামী এরই মাঝে প্রত্যক্ষ করেছে, মায়ের হাঁচি কাশি শুরু হয়েছে। যদিও খুব বেশি নয়, তাসত্বেও এই সময়ে এইরকম লক্ষণ চিন্তার কারণ। চোখমুখও থমথমে। একটু উৎকন্ঠায় বলল, "জ্বর হয়েছে? সর্দি করেছে তো। অনেকক্ষণ ধরে দেখছি, নাক টানছ"।
তিনি বললেন, "ও কিছু না। কাল বৃষ্টিতে ভিজেছি"।
মনামী বিরক্ত হয়ে বলল, "কেন? এখন কেউ বৃষ্টিতে ভেজে!"
"কাজ ছিল বিশেষ। তুই খেয়ে নে। আমি সুস্থ আছি রে"
"এরকম করো না। কিছু হলে ভাই একা পারবে না"
"বেশ বেশ, বুঝেছি"
মাকে দুদণ্ড শাসন করতে ইচ্ছা হলেও মনামী কথা বাড়াল না। সময় অনেক গড়িয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেড়োতে হবে।
দ্রুত খাওয়া শেষ করল মনামী। তারপর মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, "জলের বোতলটা ভরতি করে দিও। আমার সময় হবে না। টিফিন দিতে হবে না, বাইরেও কিছু খাব না"।
"এতক্ষণ না খেয়ে থাকবি!"
"পেট ভরেছে। সন্ধের মধ্যে ফিরে যাব। ততক্ষণ অবধি আশা করি খিদে পাবে না"
মেয়ের উত্তরে বললেন, "ঠিক আছে। যা ভালো মনে হয় করিস। কিন্তু এখন কোথায় যেতে হবে? আমাদের গ্রামেই?"
"না, পলাশপুর যাব"
"ওখানে আবার কার হয়েছে?"
মনামী বলল, "তুমি চিনবে না, কুণালের বাবা। কলকাতায় থাকত। গত এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছিল। দুদিন আগে রিপোর্ট করায়"।
তিনি বললেন, "ঠিক আছে, তুই রেডী হয়ে নে। আমি ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছি"।
"গোছানোর পর হাত স্যানিটাইজাড করে নিও"
"হুমম, খেয়াল আছে আমার। এই কদিনে এসব অভ্যাস হয়ে গেছে"
মনামী কিঞ্চিৎ হাসল। তারপর প্রস্তুতি নিতে দরজা বন্ধ করল।
মেয়ের ব্যাবহৃত অপরিষ্কার থালা গ্লাস ধীরে সুস্থে পরিষ্কার করলেন তিনি। শেষে জলের বোতল ভর্তি করে টেবিলের ওপর রাখলেন। মিনিট দশ পর মনামী নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দেখল, কিছু দূরেই মুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে মা দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারণ তো অজানা নয়। এখন কথা শুরু করলে, মা যদি পুনরায় দুশ্চিন্তার কথা ব্যক্ত করতে শুরু করে! অতএব, নিশ্চুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় শ্রেয় মনে করল। কিন্তু মেয়ে তো, বেড়িয়ে যাবার পূর্বে একইকম নীরব থাকতে পারল না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মা'কে উদ্দেশ্য করে বলল, "ওষুধ খেয়ে নিও। চিন্তায় চিন্তায় প্রেসার বাড়িয়েছ অনেক। কাশির সিরাপ আছে। ভাইকে বলো ও বের করে দেবে"।
কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তিনি বললেন, "তোকে এসব ভাবতে হবে না। নিজের কাজে যা। আমি ঠিক থাকব"।
"মা...। এভাবে কেন বলছ!"
"তুই যাবি? আমার অনেক কাজ আছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করতে পারব না"
অনিচ্ছা স্বত্বেও মেয়েকে কাজে যাওয়ার অনুমতি দিতে তাঁর যে সীমাহীন কষ্ট হচ্ছে, ঝাঁঝাল প্রত্যুত্তর তারই মৌখিক বহিঃপ্রকাশ। মনামী এসবের পরেও কিছু বলতে পারত, কিন্তু ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি মিসড কল এসে যাওয়াতে কথা না বাড়িয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
পলাশপুরে, কুণালের বাড়ি পৌঁছতে মনামীর মিনিট দশ সময় লাগল। অনেক আগে থেকেই সেখানে অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা এসে হাজির হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষজন বেশ সচেতন। কেউই মনামীর প্রতিবেশীদের মতো নয়। সকলেই সহযোগিতা করছে।
কুণালের বাবার শারীরিক অসুস্থতা খুব গুরুতর নয়। অক্সিজেন সাপোর্ট এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই। তাও পরিস্থিতি অবনতির আগেই দ্রুত তাকে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।
আধঘন্টার মধ্যে মনামীদের কাজ মিটল। যদিও আজ এখানেই নিস্তার নেই। ইতিমধ্যেই আরও একজনের আক্রান্তের খবর এসে পৌঁছেছে। সেই রোগীর শারীরিক অবস্থাও বেশ সঙ্কটজনক। উচ্চ রক্তচাপও রয়েছে। পলাশপুর থেকে সরাসরি সেখানে যাবার নির্দেশ এল। আদেশ অনুসারে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হল ওরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, রোগীর অবস্থা দেখে কেউই তার সাথে হাসপাতালে যেতে রাজি হল না। অবশেষে সেই ভার এসে পড়ল মনামীর ওপর। দ্রুত আক্রান্তকে অ্যাম্বুলেন্স তুলে মনামী হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।
করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির বয়স ষাটের ওপর। তিনি স্বাভাবিক শ্বাস নিতে পারছেন না, দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। মারণ ভাইরাস হয়তো ফুসফুসের সক্রিয়তা সম্পূর্ণ নষ্ট করেছে। অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতেও রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল করা গেল না। উচ্চ রক্তচাপ থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। মনামী তাকে মানসিক ভাবে সতেজ রাখার চেষ্ঠা করলেও, কোনো লাভ হল না। রোগীর অবস্থা ক্রমেই সঙ্কটজনক হতে থাকল। জীবন মৃত্যুর এই টানাপোড়েন, মনের জোর নিয়ে প্রত্যক্ষ করতে রইল মনামী। এ যেন এক অসম লড়াই। নিষ্ঠুর খেলা বললেও অত্যুক্তি হবে না। মারণ ভাইরাসের নির্মম মানব হত্যার শেষ এখনও অজানা।
নিকটবর্তী হাসপাতালে পৌঁছে সেই ব্যাক্তিকে ভর্তি করল মনামী। রোগীর পরিবারের কয়েকজন এসেছে। মনামী আক্রান্তের পরিবারের মানুষজনের সুস্থতার কথা মাথায় রেখে তাদের আসতে নিষেধ করেছিল। যদিও কেউই সেকথা শোনে নি। রোগীর অতিসংকট অবস্থা তার পরিবারের মানুষজনকে ঘরবন্দী রাখতে পারেনি। তাদের সব বুঝিয়ে মনামী হাসপাতালের বাইরে এল। সময় অনেক গড়িয়েছে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল। দিনের শেষ আলো নিভে যাওয়ার আগে মনামীর চোখে এসে পড়ল। গরমের সময়ে দৌড়াদৌড়ি করে মনামী নিজেও বড্ড ক্লান্ত। ঘামে স্নান করেছে একপ্রকার।
মনামীর খিদে পেয়েছে প্রচন্ড। টিফিনের খোঁজে ব্যাগে হাত ভরতে খেয়াল হল, নিজেই মাকে টিফিন দিতে নিষেধ করেছিল। বাইরে কিছু কিনেই খেতে হবে। এদিকে হঠাৎ'ই মায়ের কথা স্মরণে আসতে, রাগ প্রশমন হলো কিনা সেই হদিশ নিতে ফোন করল। কিন্তু কোনো উত্তর পেল না। রিং হল, রিসিভ করল না কেউই। হয়তো ফোন ওপরে আছে। মিনিট দশ পর আবার ফোন করার সিদ্ধান্ত নিল।
তীব্র খিদের জ্বালায় বাধ্য হল বাইরের খাবার খেতে। দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে দ্রুত সেটি শেষ করল। দশ টাকার বিস্কুটে পেট না ভরলেও, মনের খাদ্য আন্দোলন কিছুটা সামাল দেওয়া গেছে। এবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা। আজ আর কোনো পজিটিভ কেস আসেনি। রাতে এলে হয়তো আবার বেড়োতে হবে। শরীরও ক্লান্ত, বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেওয়া অত্যাবশ্যক বুঝে তড়িঘড়ি ট্রেন ধরার জন্য অটোয় চড়ল।
স্টেশন যেতে অটোয় মিনিট সাত সময় লাগবে। এই ফাঁকে অনতিবিলম্বে মাকে ফোন করল। উত্তর একই - আবারও দীর্ঘ রিং গুলো একাকিত্বের নিদর্শন দিয়ে স্তব্ধ হল। প্রথমবারের জন্য মনামীর মনে দুশ্চিন্তার উদ্রেক ঘটল। এরকম তো আগে কখনো হয়নি। অভিমানে ফোন ধরছে নাতো? কিন্তু এর আগেও তো মায়ের রাগ প্রকাশিত হয়েছে, এরকম তো করেনি। মনামীর কাছে এই নিস্তব্ধতার কোনো উত্তর নেই।
অটো থেকে নেমে স্টেশন ঢোকার আগে আবারও মা'কে ফোনে পাওয়ার চেষ্ঠা করল। কিন্তু অদ্ভূত ভাবে এবার ফোন বন্ধ এল! প্রথমে রিসিভ করল না আর এখন সুইচড অফ! কি যে হলো? মনের মাঝে ভয়ের মেঘ ক্রমেই ঘনীভূত হতে রইল।
প্রতিবেশীদের নম্বর আছে। ফোন করে খোঁজ নিলেই হয়তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রথমেই কাউকে করার সাহস পেল না মনামী। তাদের পূর্ব ব্যাবহার মনামীকে যত না আঘাত দিয়েছে, ঢের বেশি ভীত, সন্ত্রস্ত করেছে। এরপরেও মনের মাঝে সাহস জুগিয়ে দু'একজনকে ফোন করতে ভেসে এল শুধুই ভর্ৎসনা। পাড়া প্রতিবেশী এতটা নিষ্টুর হয়ে উঠতে পারে মনামী বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। মায়ের বলা পূর্বতন কথাগুলো নিজের অন্তর আত্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
প্লাটফর্মে বসে আছে মিনিট দশ। ট্রেনের খবর ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। যদিও প্লাটফর্মে এখনো তার দেখা মেলেনি। এরই ফাঁকে মনামী আরও দুবার চেষ্ঠা করেছে, কিন্তু উত্তরের পরিবর্তন হয় নি। পাড়ার লোকজন আবার আক্রমণ করতে আসেনি তো! যদি মাকে কিছু উল্টো পাল্টা বলে। মায়ের যা প্রেসার খারাপ কিছু হতে দুদণ্ড সময় লাগবে না। কিন্তু এতে ফোন কেন বন্ধ হবে! আচ্ছা, ওদের আগ্রাসী মনোভাবে ভীত হয়ে ফোন বন্ধ করে দেয়নি তো? সেরকম হলে আমাকে বললো না কেন? বিচ্ছিন্ন ভাবনার কোনো সরল যোগসূত্র স্থাপন করতে পারল না মনামী।
কিছু পূর্বেই উচ্চ রক্তচাপ সম্পন্ন আক্রান্তের করুণ পরিণতি দেখে এসেছে মনামী। এলোমেলো চিন্তায় সেই বাস্তব উপলব্ধিও জুড়ে গেল। সকাল থেকেই মায়ের শরীর ভালো ছিল না। শরীরে সামান্য জ্বর সর্দি ছিল। এই অসুস্থতা সীমা অতিক্রম করে গেল নাতো? বাড়িতে এখন শ্বাসকষ্ট হলে...
মনামী স্থিরভাবে বসে থাকতে পারল না। লাফিয়ে উঠে দ্রুত পায়চারি আরম্ভ করল। নিজেকে অপরাধী মনে হল মনামীর। কাজের প্রতি নিষ্ঠা দেখাতে গিয়ে প্রিয় মানুষটির প্রতি দায়বদ্ধতার কথা ভুলেই গিয়েছে। বারবার ফোন বের করে সময় দেখতে থাকে ও। ঘড়ির কাঁটা যেন আজ ধর্মঘট ডেকেছে। কিংবা লক ডাউন ঘোষণার পূর্বেই তারা সময়ের চাকায় তালা ঝুলিয়েছে।
ট্রেনে উঠেও মনামী স্থিরভাবে কোনো আসনে বসতে পারল না। করোনা বাড়বাড়ন্ত ট্রেন বাসে ভিড় সেরকম নেই বললেই চলে। এদিকে মনামীর মনের আন্দোলন অস্থিরতার ভঙ্গিতে বেড়িয়ে আসতে থাকে। এই মিনিট কুড়ির ট্রেন যাত্রায় আরও কয়েকবার চেষ্ঠা করেছে। উত্তর একই।
স্টেশন থেকে মনামীর বাড়ি মিনিট পাঁচ-এর হাঁটা পথ। ট্রেন থেকে নেমে অতি ব্যস্ত হয়ে হাঁটতে শুরু করল। রাত গভীর না হলেও, রাস্তায় লোকজন বেশ কম। যে দু একজনের দেখা মিলল সবাই অদ্ভূত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে। নির্বাক থেকেও সেই সকল ব্যাক্তি মনামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঘোষণা করেছে। কিন্তু কিসের জন্য? ও তো জনসেবায় নিয়োজিত। সাহসী এই নারীকে সম্মান না জানিয়ে, এই বিরূপ চিন্তা মধ্যযুগীয়। মনামীর মতো নারীরা আছে বলেই হয়তো মারণ ভাইরাসের সব কটা দাঁত আমাদের বিদ্ধ করতে পারেনি। এই স্বঘোষিত বুদ্ধিমান গুলো সেকথা বোঝে না। এর পরিবর্তন কাঙ্খিত, যদিও সম্ভব নয়।
মনামী বাড়ি পৌঁছালো। আশেপাশে লোকজন নেই, নিস্তব্ধ পাড়া। এই শান্ত পরিবেশ কি ঝড়ের ইঙ্গিত? বুঝতে পারল না। ওদের ঘরের দরজা বন্ধ, যদিও ভিতর থেকে শিকল দেওয়া নেই। একটু ঠেলাতেই সেটা খুলে গেল। ঘরে আলো জ্বলছে। দোতলা যদিও অন্ধকার। মনামী সরাসরি ঘরে ঢুকে পড়ল। যদিও এমনটা সে করে না। বাইরে থেকে এসে স্নান করে তবেই ঘরে প্রবেশ করে এখন। আজ পরিস্থিতি আলাদা। চোখেমুখে গভীর উদ্বেগ, মাকে কাছে পাওয়ার করুণ আকুতি।
মনামী চিৎকার করে মাকে ডাকতে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শূন্য ঘরে ধীরেধীরে চুরির শব্দ কানে এল। মাতৃত্বের সুতীব্র গন্ধ একটু একটু করে অনুভব করতে লাগল মনামী। মা সুস্থ আছে। শক্ত সমর্থ মানুষটি স্বশরীরে ওর সামনে উপস্থিত হল। মনামীর দুশ্চিন্তা মুহূর্তে উবে গেল। করোনায় আত্ম নিয়োজিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন মায়ের স্নেহ, আদর পায়নি। দূর থেকেই মেয়ের দেখভাল করছেন উনি। আজ মনামীর মাকে জড়িয়ে ধরতে ভীষণ ইচ্ছা হল। কিন্তু সে বাস্তববাদী, পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন। আবেগ প্রশমিত করে অভিমানের সুরে বলল, "ফোনটা কোথায় রাখো? কতবার করেছি জানো?"
তিনি বললেন, "কোথায় আবার থাকবে, ওপরে আছে"।
"ওটা সুইচড অফ কেন?"
"আজ সারাদিন ফোনের কাছেই যায়নি"
"তাই বলে একবারও দেখবে না? কতবার ফোন করেছি দুশ্চিন্তা হয়না আমার"
মেয়ের প্রতি রাগ এখনো কমেনি। থাকাও স্বাভাবিক। বললেন, "তুই আমার জন্য ভাবিস!"
"কেন ভাবব না?"
"ওই জন্যই এখন মুখে বলে প্রমাণ করতে হচ্ছে কতো ভাবিস!"
মনামী এর প্রতিবাদে কিছু বলার পূর্বেই তিনি বললেন, "ছাড় এসব, নীচে নাম। হঠাৎ করে ওপরে উঠলি কেন? ফ্রেশ হয়ে উঠবি"।
মনামী বলল, "ঠিক আছে, কিন্তু ফোনটা অফ কেন? পাড়ার লোক আবার কোনো হুমকি টুমকি দিল না তো?"
"না না, আজ আর কেউ আসেনি"
"যাক নিশ্চিন্ত হলাম"
"তোর কাজের গুরত্ব ওরা বোধহয় বুঝেছে"
মনামী বলল, "হয়তো হবে। যায় হোক, তুমি গিয়ে আগে ফোনটা দেখো। এরকম দুশ্চিন্তায় আর ফেলো না"।
তিনি বললেন, "হয়েছে, হয়েছে। আমার জন্য অনেক ভেবেছিস। আগে ফ্রেশ হয়ে নে। খাবার রেডী করছি"।
মনামী জোর গলায় বলল, "না, আগে ফোনটা দেখ"।
মেয়ের ঝাঁজালো নির্দেশে তিনি বললেন, "ঠিক আছে। দেখছি..."
তারপর মনামীর উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি ওপরে চলে গেলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওপর থেকে মায়ের আওয়াজ কানে এল- ফোন সুইচড অফ হয়ে গেছিল। ভাই গেম খেলে চার্জড শেষ করে দিয়েছে। বেয়াদবটা তারপর আর চার্জ দেয়নি। এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। গেম খেলছিল বলেই বোধহয় ফোন ধরেনি বদমাশটা। তুই ফ্রেশ হয়ে নে মনামী, দেরি করিস না"।
মনামী কিছু বলল না। কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে বাইরের বারান্দায় বসল। মায়ের অভিমানে ও আহত নয়। মায়েরা সন্তানের ভালোবাসার দাবীদার। দাবী বললে ভুল হবে, এটা তাদের অধিকার। মনামীর উপলব্ধি, ও হয়তো সেই অঙ্গীকারের কথা ভুলতে বসেছিল। গত কয়েক ঘন্টার তীব্র উৎকন্ঠা ওকে আরও পরিণত করে তুলেছে। বুঝিয়েছে, কাজের সাথে পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার গভীর মর্ম। নিজের কর্মের প্রতি এখনও ও দায়বদ্ধ, আগামীতেও থাকবে। একই সঙ্গে আরও সচেতন হবে পরিবারের প্রতি। দূর থেকেই ছোঁয়ার চেষ্ঠা করবে মায়ের মমতা।
-----------------------------------------
লেখক পরিচিতি ঃ
নাম- সেখ মেহেবুব রহমান
গ্রাম- বড়মশাগড়িয়া
ডাকঘর- রসুলপুর
থানা- মেমারী
জেলা- পূর্ব বর্ধমান
রাজ্য- পশ্চিমবঙ্গ
ডাকঘর সংখ্যা- ৭১৩১৫১