ছবিঋণ- ইন্টারনেট
দোল উৎসব
অর্পিতা ঘোষ
আজ প্রতি বছরের সেই কাঙ্খিত দোল উৎসবের শুভক্ষণ| ফাল্গুনী পূর্ণিমায় বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমময় দোল উৎসব সর্বজন বিদীত | আজ আবীরের মন মাতানো গন্ধে আকাশ, বাতাস ভরে উঠেছে |ছোট থেকে বড়ো সকলে মেতে উঠেছে দোল উৎসবের আনন্দে |কোথাও লাল, নীল, সবুজ রঙ আবার কোথাও শুধুই আবীর | প্রতিবারের মতো এবারেও সান্যাল বাড়িতেও দোলের বিশাল আয়োজন হয়েছে | গতকাল নেড়াপোড়া ও হয়েছে আর আজ সারাদিন চলবে আবীর খেলা | সান্যালরা এ পাড়ার সবচেয়ে ধনী পরিবার| স্বর্ণ ব্যবসায়ী সান্যাল বাড়ির বড়োকর্তা নিখিল সান্যালের বাবা প্রথম একটি সোনার দোকান স্থাপন করেন|তারপর বাবার হাত ধরেই নিখিলবাবুর এই ব্যবসায় আসা এবং নিজের যোগ্যতা ও কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা গড়ে তোলেন আরও কয়েকটি দোকান| স্ত্রী বিনীতা,দুই ছেলে নিতিন ও বিশাল, দুই বৌমা অন্তরা ও শ্রেয়া এবং দুই নাতি সুরজ, সাগ্নিক ও এক নাতনি সীমন্তিনীকে নিয়ে ওনার সংসার। এক মেয়ে ও আছে নীলিমা, বিয়ের পর আপাতত বিদেশে।
আজ সান্যাল বাড়িতে বেশ বড়ো করে সব কিছু আয়োজন করা হয়েছে | বাড়ির বাইরে লনে টেবিল-চেয়ার দিয়ে ছোট ছোট ছাতা লাগানো হয়েছে, অনেক রকম খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, নানা রঙের আবীরের ব্যবস্থা রয়েছে, নাচ-গান সব মিলিয়ে এক জমজমাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে | আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই আসবে আবিরের রঙে নিজেদের মাতিয়ে নিতে | এবারেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি | আয়োজন পুরোপুরি শেষ, লোকজনও প্রায় এসে পড়েছে আর আবীর খেলাও শুরু হয়ে গেছে | সাদা পোশাকে সকলকে যেন অপূর্ব লাগছে আজ | বাড়ির বাচ্চারা মিলে একটা দিকে মেতে উঠেছে নিজেদের মধ্যে|অন্যদিকে রয়েছে সব পুরুষরা আর আরেকদিকে সব মহিলারা| চলছে দেদার খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা,সে এক হই হই কান্ড| হঠাৎ এমন সময় বাড়ির ছোট্ট মেয়ে সীমন্তিনীর চোখ পড়ে তাদের বাড়ির অব্যাবহৃত গেটটার দিকে |সে দেখে গেটের বাইরে তার মতো কতগুলো কচি মুখ বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে |সে তখনই ছুটে গিয়ে তার মাকে ডেকে এনে দেখায়|শ্রেয়া বুঝতে পারে বাইরে দাঁড়ানো করুন মুখে তাকিয়ে থাকা বাচ্চাগুলো পিছনের দিকের বস্তিতে থাকা বাচ্চারা, যে বস্তিটা কিছুদিন আগেই আগুন লেগে একেবারে পুড়ে ছাই হয়ে গেছিলো |হতদরিদ্র মানুষগুলো তাদের কষ্টের সম্বলটুকু বাঁচাতেও পারেনি, আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে ন্যায় তাদের দিন আনা দিন খাওয়া রোজগারের সবটুকু |একেবারে নিঃস্ব হয়ে পথে এসে দাঁড়ায় তারা|নেহাত আগুনটা দিনের বেলায় লেগেছিলো বলে মানুষগুলো প্রাণে বেঁচে যায় নাহলে সব শেষ হয়ে যেত| তারপর সরকারের তরফ থেকে ঐ মাথা গোঁজার জায়গাটুকু করে দেওয়া হয়েছে কিন্তু বাকি সব আবার নতুন করে শুরু করার লড়াই করে চলেছে মানুষগুলো | শ্রেয়ার বড্ডো মায়া হয় ওদের দেখে| বস্তিটা পুড়ে যাওয়ার সাথে সাথে এই বাচ্চাগুলোর আনন্দটাও পুড়ে শেষ হয়ে গেছে | নাহলে কোনো বছরই তো ওদের এদিকে দেখা যায় না, নিশ্চই এই বার অসহায় মা বাবা ওদের হাতে রঙ, পিচকারি কিছুই দিতে পারেনি অভাবে আর সেই কষ্টে ওরাও করুন চোখে তাকিয়ে আছে এই বাড়িটার আনন্দের দিকে| মনে মনে হয়তভাবছে যদি একটু আনন্দ ওদের ঝুলিতেও কেউ দিতো!
"এই তোরা ভেতরে আসবি? রঙ খেলবি? "-শ্রেয়া ঐ বাচ্চাগুলোকে জিজ্ঞাসা করে|
শ্রেয়ার কথা শুনে বাচ্চাগুলো হকচকিয়ে যায় আর পিছন ফিরে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় |
"এই যাচ্ছিস কোথায়? দাঁড়া দাঁড়া ভেতরে আয়|"
বাচ্চাগুলো প্রথমে ভয়ে একে ওপরের দিকে চেয়ে থাকে কিন্তু শ্রেয়ার হাসিমাখা মায়ের মতো মুখটা দেখে ওরা সাহস পায় আর ভেতরে আসতেও রাজি হয় | শ্রেয়া তখন দারোয়ানকে দিয়ে ঐ অব্যবহৃত দরজাটা খুলিয়ে বাচ্চাগুলোকে ভেতরে নিয়ে আসে |
"এ কাদের নিয়ে এসেছো বৌমা? "-নিখিল বাবু জিজ্ঞাসা করেন|
" এই নোংরা জামাকাপড় পড়া বাচ্চাগুলো এখানে কি করবে ছোট বৌমা? "-শ্রেয়ার শাশুড়ি বিনীতা দেবী জানতে চান|
চারিদিকে তাকিয়ে শ্রেয়া বুঝতে পারে উপস্থিত সকলের মনেই নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে|তাই বিলম্ব না করে সে সোজাসুজি সব কথা খুলে বলে আর এটাও বলে যে, "আজ দোল উৎসব, আজ আমরা কত আনন্দ করছি সবাই |ওদের সব গেছে, আগুনের শিখা ওদের সব গ্রাস করেছে | কিন্তু আমরা যদি ঐ বাচ্চাগুলোর মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারি তাহলে ক্ষতি কি আর নিশ্চই ভগবানও এটাই চান নাহলে ঐ বাচ্চাগুলো এখানেই বা আসবে কেন!সব শিশুর মধ্যেই তো ভগবান নিজে বিরাজমান তাই এদের এটুকু আনন্দ কি আমরা দিতে পারিনা? "
উপস্থিত অনেকেই শ্রেয়ার এই ব্যাপারটা আদিখ্যেতা বা পাগলামি বলে হাসাহাসি করতে থাকে | তখনই নিখিলবাবু হাত জোড় করে বলে ওঠেন,
"আমার বৌমারা আমার বাড়ির লক্ষী, তাই বৌমারা কিছু সিদ্ধান্ত নেবে আর সেটা নিয়ে কেউ হাসাহাসি করুক তা আমি চাইনা,তাই যদি কারোর এখানে থাকতে অসুবিধা হয় তাহলে তারা বাইরের পথ দেখতে পারেন অবশ্যই|"
নিখিলবাবুর কথাটা শুনে অনেকেই যারা এতক্ষন হাসাহাসি করছিলেন তারা চুপ হয়ে যায়, অনেকে আবার উৎসব প্রাঙ্গন ছেড়ে বেড়িয়েও যায়| শশুর মশাইকে এতদিন একরকম রূপে দেখেছে দুই বৌ, আজ যেন আরেক রূপে দেখতে পেলো|একজন স্বর্ণকার নয়, যে দাঁড়িয়ে আছে সে যেন একজন প্রকৃত পিতা যার মন সকল মানুষের জন্য কাতর হয়| দুই ছেলে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো |এই তো তাদের পথপ্রদর্শক, তাদের শ্রদ্ধেয়|
"এসো, সবাই মিলে একসাথে রঙ খেলো আর খুব আনন্দ করো| সুরজ, সাগ্নিক তোমরাও নতুন বন্ধুদের সাথে রঙ খেলবে তো? "-শ্রেয়ার বড়ো জা অন্তরা বলে ওঠে |
"হ্যা, মা খেলবো |ওরাও আমাদের বন্ধু আজ থেকে |এসো তোমরা, সবাই একসাথে আজ মজা করি|"
বাকিরা সবাই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখে যে, সত্যিই তো ওদের মধ্যে তো কোনো ভেদাভেদ নেই, ভেদাভেদ তৈরী করি আমরা বড়োরাই আর সেই ভেদাভেদের কুপ্রভাব পরে শিশুমনে| এই কুপ্রভাবের ফলে পরবর্তীতে ওরাও সকলকে আপন করে নিতে চায় না | উপস্থিত সকলে শ্রেয়াকে প্রাণ ভরে শুভেচ্ছা জানালো এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য |
এরপর সান্যাল বাড়ির প্রাঙ্গন দ্বিগুন খুশিতে ভরে ওঠে কারণ সেখানে শুধু নিজেদের আনন্দ নয়, ছড়িয়ে পড়েছে কিছু সব হারানো শিশুদের খুশি মাখা কলতান| বাসন্তী বাতাসে ভাসছে ভালোবাসার গন্ধ, উপস্থিত সকলের চোখে লেগে রইলো কিছু মন ভালো করে দেওয়া মুহূর্ত| ওদিকে গান বেজে চলেছে,
"ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল
স্থলে, জলে, বনতলে লাগলো যে দোল|
দ্বার খোল, দ্বার খোল||"
-------------------------------------------------------------
অর্পিতা ঘোষ ,
১৭৬/৩, নৃপেন সরকার রোড,
কাঁচরাপাড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা,
পিন-৭৪৩১৪৫