ছবিঋণ- ইন্টারনেট
লাঞ্ছিত বাসর
সায়ন্তী চৌধুরী
আকাশে মেঘ জমেছে , চাঁদটাকে অল্প বিস্তর আবছা দেখাচ্ছে , ঝিকিমিকি তারার দল বুঝি মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলতেই ব্যস্ত । ঠান্ডা বাতাসে ভেসে আসছে সোঁদা মাটির সুবাস আর জুঁই-বেলী-রজনীগন্ধার স্নিগ্ধ সৌরভ ।
আমি হেমনলিনী , ঠিকই ধরেছেন - একেবারে রাবিন্দ্রীক নায়িকার নামেই আমার নাম , ঠাকুরদা রেখেছিলেন । এখন আমার বয়স মধ্য-চল্লিশে , স্বামী-সন্তান নিয়ে বাঘাযতীনে একটা ফ্ল্যাটে বাসরতা ।
আজ এসেছি বাপের বাড়িতে , কাল আমার ভাইঝির বিয়ে । একান্নবর্তী পরিবার আমাদের , বিরাট বড়ো বাড়ি - ঠাকুরদার বাবার আমলে বানানো । ছাদের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে হেঁটে যেতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায় । ছাদে উঠে - প্রকৃতির কোলে নিজেকে এলিয়ে দিতে বেশ ভালো লাগে ।
সানাই বাজছে । এই আওয়াজটা শুনলেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে ওঠে , পুরোনো কথাটা বারবার মনে পড়ে যায় । না না আমার বিয়ের কথা নয়, আমার ছোটো পিসি আলোকলতার বিয়ের কথা।
তখন আমি ষোলো বছরের কিশোরী , ঠাকুমা-ঠাকুরদা ততদিনে গত হয়েছেন । ঠাকুরদাকে কখনও পুত্র কন্যাৱ মধ্যে ভেদাভেদ করতে দেখিনি , বরং তিনি মেয়েদের লেখাপড়া , সংস্কৃতি নিয়ে একটু বেশীই উদগ্ৰীব থাকতেন , তাই লেখাপড়া শেষ করে একটু বেশী বয়সেই ছোটো পিসির বিয়ে হয়েছিল। এলাহী ব্যবস্থা , অনেক আত্মীয় বন্ধু নিমন্ত্রিত । বাড়ির প্রত্যেকে নিজের নিজের সাধ্য মতো বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত। আমার ভাগ্যে পড়ল আমার সাহিত্য অনুরাগী ঠাকুরদার লেখালেখির ঘরটা গোছানোর
গুরু দায়িত্ব - আসলে বাবা-জেঠুরা মনে করতেন সাহিত্য প্রেমের বিষয়ে আমি আমার ঠাকুরদার যোগ্য উত্তরাধিকারিণী , অতএব এ দায়িত্ব আমারই প্রাপ্য ।
ঠাকুরদার লেখার টেবিলের ঠিক সামনের দেওয়ালে রাখা এক অপরূপার ছবি । পটলচেড়া চোখ দুটিতে কি অসম্ভব মায়া , ভুবন মোহিনী এক চিলতে হাসি , এলোকেশী , গৌরবর্ণা । সবাই বলে উনি আমার বড়ো পিসি- চারুলতা । রূপে গুণে আমি নাকি তারই মতন । গুণের কথা বলতে পারব না , তবে হ্যাঁ , রূপের কথা আমার বিশ্বাস হয় না । উনি হলেন স্বর্গের পারিজাত - কতবার আনমনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বড়োপিসির মতো সেজেছি , কিন্তু কই কখনও তো সেই রূপ ধরা দেয়নি ।
শৈশবে কৈশোরে আমার অনন্ত কৌতূহল ছিল এই চারুলতা দেবীকে নিয়ে । তাকে কখনও দেখিনি , কোথায় থাকেন , জীবিত না মৃত , কিছুই জানতাম না । কেবল শুনেছিলাম তিনি ছিলেন এই বাড়ির প্রাণ , আমার ঠাকুরদার হৃদ্-স্পন্দন । কিন্তু সেইদিন ঠাকুরদার ডায়েরী গোছাতে গোছাতে চারুলতাকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম । সব সত্যিটা জানতে পারলাম , জানলাম আমাৱ সৃষ্টির সত্য , জানলাম উনি আমার পিসি নন, অন্য এক সম্পর্ক আমার সাথে চারুলতার ।
ঠাকুরদা জ্যেষ্ঠাকন্যাকে নিয়ে অনেক কিছু লিখেছিলেন , লুকিয়ে লুকিয়ে পড়লাম ।
চারুলতা রূপে গুণে অতুলনীয়া , ঠাকুরদার মতোই সাহিত্য প্রেমী । বাংলায় এম.এ করে তখন পি.এইচ.ডির স্বপ্ন দেখছেন । তখনকার হিসেবে ততদিনে তার বিয়ের বয়স অতিক্রান্ত । ঠাকুমা পাত্র দেখতে বললেও , ঠাকুরদা বলেন " আগে ও নিজের স্বপ্নপূরণ করুক , তারপর বিয়ে নিয়ে ভাববো ।" চারুলতার প্রেমে অনেকেই তখন স্বপ্নজাল বুনছে , কিন্তু চারুলতা প্রথম প্রেমে পড়ল এক প্রফেসরের । পি.এইচ.ডি করা তখনও শেষ হয়নি , বাবা মাকে সব কথা জানালো চারু। বাবা রাজি হলেও , মা কিন্তু কিন্তু করছিলেন কারণ প্রফেসরটি বিপত্নীক , সাত কূলে কেউ নেই তার । তবুও বিবাহ স্থির হলো । বরযাত্রী বলতে কেবল তার সাতজন বন্ধু । কথায় আছে না " অতি বড়ো সুন্দরী পায় না কো বর।" চারুলতারও তাই হলো । বাসরঘরে তখন কেবল তারা নবদম্পতি ও তার স্বামীর সাত মদ্যপ বন্ধু । স্বামীর ভরসায় বাড়ির লোকজন চারুকে বিবাহ বাসরে রেখে গেল । কিন্তু মধ্যরাত্রেই ঘটল সর্বনাশ । চারুলতার পবিত্র কোমল দেহটাকে ছিঁড়ে খেল তার স্বামী ও স্বামীর তথাকথিত শিক্ষিত রুচিশীল বন্ধুরা । জানিনা চারুলতা কেন সেইদিন নিঃশব্দে সব অত্যাচার সহ্য করেছিল , কার সম্মান রক্ষার্থে , পিতার না স্বামীর ? চারুলতার শরীরের প্রত্যেক যন্ত্রণা-লান্ছনার কথা আমার ঠাকুরদা জীবন্ত অক্ষরে লিখে রেখেছিলেন । পরের দিন অর্ধনগ্ন , অচেতন চারুকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ধর্ষকেরা ততক্ষণে পলাতক । চারুলতা মানসিক ভারসাম্য হারালো , চিকিৎসা চলাকালীন জানা গেল চারু অন্তঃসত্ত্বা । কিন্তু ঠাকুরদা চারুর গর্ভের নিষ্পাপ সন্তানটিকে নষ্ট করতে দিলেন না । ন'মাস পর চারু কন্যা সন্তানের জন্ম দিল । ঠাকুরদা নাতনিকে নিজে মানুষ করবেন বলে স্থির করলেন । চারুলতার দাদা বৌদি চারু-কন্যাকে দিল তাদের পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব । কিন্তু চারুলতাকে আর ঘরে রাখা গেল না , চারু রাতের অন্ধকারে একাধিক বার ঘর ছাড়ল , অনেক কষ্টে যদিও খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল । কিন্তু পুরুষ মানুষ দেখলেই চারু অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল , আত্মহত্যার চেষ্টাও করল । অবশেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঠাকুরদা বুকে পাথৱ চাপিয়ে চারুলতাকে পাগলা গারদে পাঠালো । সেদিনও কেবল নির্দোষ ধর্ষিতাই সমাজের আলো হারিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো । আর ধর্ষকেরা ? তারা তো আজও আলোকিত সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে , আর অন্ধকারে আবার হয়তো কোনো মেয়ের সর্বনাশ করছে।
প্রথমে আমি চারু কন্যাকে খুঁজতাম , কিন্তু বয়সের সাথে সাথে বুঝলাম যে সে আর অন্য কেউ নয় , সে আমিই - 'হেমনলিনী' , কারণ আমাদের বাড়িতে আর অন্য কারো কন্যা সন্তান ছিল না , আমিই আমার ঠাকুরদার একমাত্র নাতনি , তাছাড়া আমার জন্মের তারিখ আর চারুলতার সর্বনাশের তারিখের মধ্যে কেবল ন'মাসের তফাৎ । সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম এই ভেবে যে আমি এক ধর্ষক আর এক ধর্ষিতার কন্যা , কেঁদেছিলাম চারুলতার জন্য , কেঁদেছিলাম এই ভেবে যে যাকে এতকাল মা বলে জানলাম , যার বুকে মুখ গুঁজে হাসলাম-কাঁদলাম তিনি আমায় গর্ভে ধারণ করেননি ।
আমার বিয়ের সময় মনে আছে , খানিকটা জোর করেই বাবা চারুলতা দেবীকে নিয়ে এসেছিলেন । শান্ত , সজল নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি । সেই অপরূপা পাগলিনীকে দেখে আমি চোখের জল আটকাতে পারিনি । বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন , " হেম , দেখ্ তো মা , এনাকে চিনতে পারছিস ? ছবিতে দেখেছিস । "
আমি মুখে বলেছিলাম ," বড়ো পিসিমণি " আর মনে মনে বলেছিলাম , " গর্ভধারিণী "।
-সমাপ্ত-