একটি অন্তহীন জার্নি
দেবব্রত রায়
মনোতোষবাবু চেন্নাইগামী সুপার এক্সপ্রেসের ফার্স্ট এসি-কেবিনের করিডরে খুবই দ্রুত অথচ, অবিন্যস্তভাবে পায়চারি করছিলেন। গতকাল রাত্রে সেই ভয়ংকর খবরটা আসার পর থেকে তিনি কিছুতেই আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলেন না ! প্রথমে ঠিক করেছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে প্লেনেই চেন্নাইয়ে যাবেন কিন্তু,ওর স্ত্রী বিদিশা-র এয়ার-ফোবিয়া থাকায় মনোতোষবাবু আর সে রিস্ক নেননি । গতবার প্লেন আকাশে ওঠার আধঘন্টা পরেই বিদিশা-র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছিল তাই,এবার তিনি এই এসি কেবিনের দুটো তৎকাল টিকিটই কেটেছিলেন ! কাল রাত বারোটার পর থেকে অনেক চেষ্টা করেও,ওদের একমাত্র ছেলে বুম্বা,মানে মনোসিজের কোনো কলিগের সঙ্গেই আর যোগাযোগ করতে পারেননি মনোতোষবাবু ! ফোনটা যতবারই কেটে যাচ্ছিল মনোতোষবাবুও ভিতরে ভিতরে ততই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন ! মনোসিজ চেন্নাইয়ের একটি নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালে কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে আজ দু-বছর হলো জয়েন করেছে । গতবছর করোনা যখন প্রথম ওয়েভটা মাথাচাড়া দিয়েছিল তখনই মনোতোষ-বাবু আর,তার স্ত্রী ভয় পেয়েছিলেন ! মনোসিজ অবশ্য জানিয়েছিল ওদের হাসপাতালে করোনা-পেসেন্ট একদমই অ্যালাও নয় কিন্তু,সেকেন্ড ওয়েভে মনোসিজদের হাসপাতালেরই বেশ কয়েকজন ডাক্তার-স্টাফ করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন এবং তাদের মধ্যে মনোসিজের অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল ! গতকাল ওর অক্সিজেন স্যাচুরেশন ভীষণ কমে গিয়েছিল,সেই সঙ্গে কিডনি-ফাংশনেও প্রোবলেম দেখা দিয়েছে ! মনোতোষ-বাবু ফোনে এইসব খবর শোনার পর থেকেই, মনে মনে ভাবছিলেন,ওদের একমাত্র সন্তান মৃত্যু-র সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে,এই দুঃসংবাদটা তিনি স্ত্রী-র কাছে এতটা পথ গোপন রাখবেন কীভাবে কিংবা,তিনি নিজেকেই বা এতটা সময় কীভাবে সামলাবেন ! এইসব ভাবতে ভাবতে হটাৎ-ই, মনোতোষ-বাবু ভীষণ অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে উঠলেন,ট্রেনটা এত শ্লো রান করছে কেন ! ওর চিৎকার শুনে পাশের কেবিন থেকে বেশ কয়েকজন সহযাত্রী বেরিয়ে এসে মনোতোষ -বাবুদের কেবিনে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন। বিদিশা স্বামীর বুকে-পিঠে হাত হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোমার,এরকম করছ কেন !
মনোতোষ-বাবু স্ত্রীকে কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেননা।মাত্র কয়েক ঘন্টার জার্নিও যেন আজ তার কাছে একেবারে অসহ্য হয়ে উঠছে ! ক্রমশ একটা আতঙ্ক মনোতোষবাবু-র বুকের ভিতরে ধীরে ধীরে চেপে বসছিল ! ওর মনে হচ্ছিল,ছেলেকে জীবিত অবস্থায় তিনি বোধহয়,আর কোনোদিনই দেখতে পাবেন না !
ছুটন্ত ট্রেনের চাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মনোতোষ-বাবু হিস হিস শব্দে পাগলের মতো খুব নীচু গলায় বলতে লাগলেন, জোরে চল,জোরে চল, আরও জোরে.....
----------------------------------
[]Debabrata Roy.Hajrapara. P.O. Bishnupur. Dt.Bankura.