প্রবন্ধ।। তিলোত্তমার কথাসাহিত্য - অবদমিত মানবসত্ত্বার বিস্ফোরণ ।। সুদীপ পাঠক
তিলোত্তমার কথাসাহিত্যঃ অবদমিত মানবসত্ত্বার বিস্ফোরণ
সুদীপ পাঠক
বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যে এই প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে তিলোত্তমা মজুমদার একজন উল্লেখযোগ্য ও অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী । নতুন ধারার গল্প রচনার ক্ষেত্রে তাঁর কলম এক উজ্জ্বল আবিষ্কার ।
তাঁর জন্ম ১৯৬৬ সালে উত্তরবঙ্গে । কালকিনি চা বাগানের ইউনিয়ন একাডেমি থেকে স্কুলের পড়াশোনার পাঠ সাঙ্গ করে চলে আসেন কলকাতায় । ১৯৮৫ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজে শুরু হয় ছাত্রাবস্থার দ্বিতীয় পর্ব স্নাতক স্তরের পাঠক্রমের মধ্য দিয়ে । লেখালিখির সূচনা ১৯৯৩ সালে । পরিবারের সদস্যরা অনেকেই সাহিত্যানুরাগী । বিশেষ ভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে এসেছেন তাঁর দাদা ।
পেশাগত পরিচয় ঃ- পুস্তক সম্পাদক । পূর্ব ভারতের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বৃহৎ প্রকাশনা সংস্থা আনন্দ পাবলিশার্সে এই কাজে যুক্ত আছেন । সঙ্গীত ও ভ্রমণকে ভালোবেসে চলেছে জীবনযাপন । ইতিমধ্যেই পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার । উল্লেখ্য : ' বসুধারা ' উপন্যাসের জন্য আনন্দ পুরস্কার এবং ' একতারা ' উপন্যাসের জন্য ডেটল - আনন্দ বাজার পত্রিকা শ্রেষ্ঠ শারদ অর্ঘ্য ইত্যাদি । তালিকায় রয়েছে ভাগলপুর শরৎস্মৃতি পুরস্কার ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ।
২০১২ সালের এপ্রিলে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে পঞ্চাশটি গল্পের সংকলন যা তিনি উৎসর্গ করেছেন যথাক্রমে : জননী , দুইকাকি , ছোটমামি ও শাশুড়িমাকে । মধ্যচল্লিশ অতিক্রম করে স্মরণ করতে ভোলেননি সেই সব নারীদের যাঁদের কাছে হয়তো তিনি আজীবন কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ , কিম্বা যাঁদের প্রভাব তাঁর জীবনে সুদূর প্রসারী । গল্প সংকলনটিতে তিলোত্তমা এই রকম অসংখ্য অনাম্নি অঙ্গনার জীবন কথা সূচীশিল্পীর দক্ষতায় বুনন করেছেন । এ এক অলৌক সমাপতন বৈকি !
আখ্যান কাহিনীর কেন্দ্রীয় ও পার্শ্ব চরিত্রের সন্ধানে লেখক মূলত মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ও সমাজকে বেছে নিয়েছেন । তবে পুরোপুরি উচ্চবিত্ত চরিত্রদের স্পর্শ না করে এড়িয়ে গেছেন তাও নয়। কখনো সখনো ব্যতিক্রমী হয়ে সমাজের ওপরতলার মানুষদের সুখের অসুখের আলেখ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে তাঁর কলমে । তবে সর্ব ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি সাধারণ (কমন) তা হলো : অবদমন , অবমাননা , নিপীড়ন , নিষ্পেষণ , বিকৃত যৌনবাসনা , যৌন ও মানসিক নির্যাতন , পারিবারিক হিংসা ও কলহ এবং এই সব কিছু থেকে উদ্ভুত ক্ষোভ , বিকার , প্রতিহিংসাপরায়নতা ইত্যাদি । যার ফলে অনেক সময় চরিত্রগুলির ভয়ঙ্কর ও বীভৎস পরিণতি ঘটে । তবে শুধুমাত্র নারী নয় ক্ষেত্র বিশেষে পুরুষের জীবনের মর্মন্তুদ , করুণ ও দুঃসহ যন্ত্রণাময় ছবি আঁকতে কার্পণ্য করেননি তিনি । একজন নির্মহ সমাজবিজ্ঞানীর অন্তরদৃষ্টি নিয়ে লেখক পরিস্থিতির স্বীকার মানুষের অসহায়তা ব্যবচ্ছেদ করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন । আলোচ্য নিবন্ধে উপরোক্ত সংকলন থেকে দুইটি গল্প বেছে নিয়ে লিঙ্গ চেতনা ও লিঙ্গ বৈষম্যের নিরিখে তুল্যমূল্য বিচারে বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে ।
গল্প
-একঃ- ননদ বৌদির রান্নাঘর
মিনতি ও কাকলি দুই স্বামী পরিত্যক্তা , স্বামী বিচ্ছিন্না নারী , যাদের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধুমাত্র ননদ-ভাজের নয় , সাপে নেউলেও বটে । ভোরের আলো ফোটা থেকে শুরু করে রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এদের ঝগড়ার চোটে উঠোনে কাক-চিল বসা দায় । কাকলির স্বামী বিজয় দাস কাজ খোঁজার নাম করে বম্বে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে আর মিনতির স্বামী বলরাম অন্যত্র সংসার পেতেছে । পাড়ার উঠতি মস্তান খোকন , যে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে আর বেশিদূর এগোয়নি । সঠিক সময়ে দল বদল করার দূরদর্শিতা দেখিয়ে নেতাদের বিশেষ আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে । ফলে তার গ্রীল কারখানার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে এবং সে এলাকায় গ্রীল খোকন নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে । সেই কারখানারই পিছনের দেওয়ালে এক চিলতে ঘর আর উঠোন নিয়ে দুই মহিলার বসত । খোকনের পরামর্শে ও বদান্যতায় কাকলি তার গলার একফালি সরু সোনার হার পুঁজি হিসেবে তুলে দেয় তার হাতে ও শুরু করে হোম ডেলিভারীর ব্যবসা । মিনতি বাজার করে আনে , কাকলি রান্না করে এবং কেরিয়ারে ভরে দেয় । মিনতি পুনরায় সেই খাবার পৌঁছে দেয় বাড়ী বাড়ী । এই ভাবেই দিনগতি পাপক্ষয় চিলতে থাকে তাদের । নেহাৎ প্রয়োজনের তাগিদে একত্রে বসবাস, নইলে একে অপরের চক্ষুশূল। পাড়ার মোড়ে ফুটপাতের ওপর অচল ঠেলাগাড়িতে অভয় নাথের চায়ের দোকান । মিনতি দিনের অধিকাংশ সময়ই সেখানে আড্ডা জমায় । তাই নিয়ে কাকলি যথেচ্ছ কটূক্তি করতে কসুর করে না । মিনতি অবশ্য সে সব গায়ে মাখে না । উল্টে সেও অশ্রাব্য গালিগালাজের বন্যা বইয়ে দেয় । পাড়ায় থাকেন অকৃতদ্বার বিমলেন্দুবাবু যিনি পেটরোগা মানুষ । কাকলি তাঁর জন্য যত্ন করে স্পেশাল রান্না করে । মিনতির মনে সন্দেহ দেখা দেয়, তবে কি কাকলি ঐ লোকটার প্রতি অনুরক্ত ? আজ সেই বিমলেন্দুর কাছ থেকেই মিনতি জানতে পারে বোম্বাইতে বম্ব ব্লাস্ট হয়েছে , প্রচুর মানুষ মারা গেছে । সেই হতাহতের তালিকায় নাম রয়েছে বিজয় দাস অর্থাৎ তার দাদার । মিনতি আঁতকে ওঠে , কি সর্বনাশ ! পরক্ষণেই সে সিদ্ধান্ত নেয় এই দুঃসংবাদ সে সম্পূর্ণ গোপন রেখে দেবে তার বৌদির কাছে ।
স্বামী পরিত্যক্তা মিনতি নিজের চেহারার কারণে বরাবর হিনমন্যতায় ভোগে । তার স্বগতোক্তির ধরন এই রকম :
" আমি সোদোর বনের গাঁয়ের মেয়ে । তা সেখানে কে কবে ফিটফর্সা দেখেছে শুনি ? তা বাদে বাকি সব কিছুই তো আমার মেয়েমানুষের মতন । "
অর্থাৎ শরীর , সরাসরি শরীর কেন্দ্রীক চিন্তাভাবনা প্রভাবিত করে সমাজের অন্তেবাসী এই অনগ্রসর শ্রেণীর নারীর মস্তিষ্ককে । সে যখন ঐ ভয়ঙ্কর সংবাদের মুখোমুখি হয় তার বোধ অন্য পথে পা বাড়ায় ।
" দাদা আবার বিয়ে করেছিল ! ওই জন্যি ঘরে আসত নাকো । কেন ? বউদির কী নেই ? আর পাঁচটা মেয়েমানুষের থেকে কম কীসে ? দাঁত ও উঁচু নয় । দাদা মরেচে । আগেই কি মরেনি ? বউদিকে বলব নি । যদি অন্য কোনও ভাবে জানে ? জানুক ! দেকা যাবে ! বলবনি ! "
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসে । রাতের রান্নার জোগাড় নিয়ে মিনতি এখনো ফেরেনি । কাকলি বিরক্তি চেপে রেখে প্রদীপ জ্বালায় , শাঁখ বজায় , গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করে । এমন সময় শ্যামল নামের যুবক এসে হাজির হয় এবং ভগ্নদূতের মতন খবর দেয় মিনতির স্বামী বলরাম গতকাল রাত্রে মারা গেছে । কাকলি পত্রপাঠ শ্যামলকে বিদায় করে এবং তৎক্ষণাৎ মিনতির কাছে এই সংবাদ গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেয় মনে মনে । সে ভাবতে লাগলো " বেধবা ! ও ধরা দশটা সোয়ামি মরলেও কেউ বেধবা হয় না তো মিনু । ও জন্মবেধবা । স্বামী নেয় না , ও - ও নোয়া শাঁখা খুলে ফেলেচে । বেশ করেচে । ওকে বলবই না । ব্যস্ত করে লাভ কী ? যদি পরে জানতে পারে ? দেকা যাবে তখন । "
তার ভাবনায় আরো যুক্ত হয় - " অভয় নাথের সঙ্গে মিনুর ভাব আচে । আচে তো আচে । মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছে । অন্তত শরীলের জন্যও তো একটা বেটাছেলে লাগে । "
বেশ কিছুটা সময় পার করে মিনতি মুরগীর মাংস নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখে মালতীর মুখ গম্ভীর হয়ে আছে । সে চিন্তান্বিত হয়ে পড়ে " বউদির মুখটা কালো কেনো ? আমার দিকে তাকাচ্চে না । কেউ কিচু বলল ? না । শুনলে তো কাঁদত । এখনও শাঁকা সিঁদুর পরে ! পরুক । যে মরেচে সে কাকলির স্বামী নয় । আচ্ছা স্বামী ছাড়া তো দিব্যি ভাল থাকা ! এই সাত আট বছর মন্দ কী গেল ! ও বিমলেন্দু বাবুর জন্য একনও রোজ কেমন যত্ন করে খাবার নিয়ে যায় । ভালবাসে বোধহয় । মানুষটা ভালই তো ! চালচলন ভাল । "
অর্থাৎ এই অশিক্ষিতা প্রান্তিক দুই নারীর অন্তর্লীন মনোজগতের গতিপ্রকৃতি অনুসন্ধান করলে কিছু চমকপ্রদ তথ্য সামনে উঠে আসে যা কিনা শহুরে শিক্ষিত মননশীলতার ভীতকে কাঁপিয়ে দেয় ও চরম বিস্ময়ের অভিঘাত সৃষ্টি করে । প্রথমতঃ একটা ক্রাইসিস বা সংকট দুইজনকে শত্রুতা দূরে সরিয়ে রেখে সংবেদনশীল , সহানুভূতিশীল ও সমব্যথী হয়ে ওঠার শিক্ষা দেয় । একে অপরের পরিপূরক ও বন্ধুর জায়গাটি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তারা । এবং এই সব কিছু হয় যেনো নিজেদের অজান্তে ।
দ্বিতীয়তঃ নোয়া , শাঁখা , সিঁদুর এই সব ধব্য চিহ্ন তাদের কাছে নেহাৎ দেখনদারি ছাড়া আর কিছুই নয় সেটা উপলব্ধি করে । সমস্ত সামাজিক ও লৌকিকতার বন্ধন বা শৃঙ্খল এক লহমায় হাস্যকর হয়ে যায় । এতকাল তারা আক্ষরিক অর্থে অথবা মনে মনে যা বয়ে বেড়াচ্ছে তা যে কতোখানি ঠুনকো , মূল্যহীন ও অর্থহীন তা প্রমাণ হতে খুব বেশি সময় লাগে না ।
তৃতীয়তঃ নারী হলো ভোগ্যপণ্য , পুরুষ ইচ্ছেমতো তার শরীর ভোগ করতে পারে । কখনো বিবাহ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সুবিধা জনক অবস্থানে থেকে । আবার কখনো সরাসরি পয়সার বিনিময় ক্রয় করে । চিরাচরিত এই ধ্যানধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজস্ব নিয়মে জীবন গড়ে নেয় কাকলি ও মিনতি । শারীরিক ও মানসিক চাহিদা পূরণ করতে ইচ্ছেমত পুরুষসঙ্গ তারাও করতে পারে পছন্দের পুরুষকে নিয়ে । তাদের কাছে পুরুষ শেষ পর্যন্ত স্পার্ম ব্যাংক ছাড়া আর কিছুই নয় । চতুর্থতঃ প্রাত্যহিক জীবনসংগ্রাম ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা পুরুষের উপস্থিতির গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস করে দেয় । লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার নির্যাতিতা মেয়ে দুটি ধীরে ধীরে অকুতভয় হয়ে ওঠে । সেই সাহস তারা সঞ্চয় করে নিজের ভিতর থেকে ।
অধিক রাত্রে খেতে বসে ননদ ভাজে । পাবদা , কাতলা , চিকেন সস্নেহে ভাগাভাগি করে খায় । মিনুর আব্দার রক্ষার্থে কাকলি সাইন বোর্ড টাঙাবার প্রস্তাব মেনে নেয় । তাদের জয়েন্ট ভেঞ্চারের নাম হবে : ননদ বৌদির রান্নাঘর । সেই নামটি আবার মিনুর প্রিয় মানুষ অভয়নাথের দেওয়া । কাকলির তাতেও কোন আপত্তি নেই । লেখক পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়েছেন এই ভাবে
" কাকলি মিনতিকে একহাতে জড়ায় । মিনতি কাছে সরে আসে । আদুরে গলায় বলে ... । "
তারপর " ঘুমে কথা জড়িয়ে এল । সাইন বোর্ডে মাথা রেখে নিবিড় ঘুম । ঘরে মশলা অনাজপাতি গ্যাস ও মেয়েলি বাস , তার সঙ্গে , যে জুঁই ফুল ফুটবে উঠোনে তার গন্ধ জড়ানো । "
পারস্পরিক বিশ্বাস , আস্থা , নির্ভরতা ও আগামীদিনের স্বপ্নে বিভোর এক নিটোল ছবি পরিস্ফুট হয় ।
গল্প : দুইঃ- তবলিয়া
কাহিনীর প্রটাগনিস্ট মণি । পোষাকি নাম মণিময় ঘোষাল বয়েস পয়ত্রিশ বছর । পেশায় তবলা বাদক । গঞ্জশহর দেশবন্ধু নগরের স্বনাম ধন্য ও গণ্যমান্য ব্যক্তি উকিল উমেশ ঘোষালের একমাত্র পুত্র । যথারীতি বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার , ইঞ্জনিয়ার , উকিল কিম্বা উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা হবে । কিন্তু মনির মা ঘোষাল গিন্নি গান বাজনা ভালো বাসতেন । তিনিই শিশু বয়সে মণির হাতে তবলা ধরিয়ে দেন । সেই থেকে মণি ধাঁই ধপাধপ তবলায় চাঁটি মেরে চলেছে । তার রাগ অভিমান আনন্দ খুশী সমস্ত অনুভূতির প্রকাশ ঘটে একমাত্র তবলার মাধ্যমে । সে নিজের উদ্যোগে উস্তাদ আল্লারাখা খাঁ সাহেবের ছবি সংগ্রহ করে নিজের ঘরে টাঙিয়ে রেখেছে । ছেলেকে তবলা শেখানোর অপরাধে মণির বাবা উমেশবাবু নিজের স্ত্রীকে দু'বেলা শত মুখে গালি পাড়তেন । তবে মণির মাকে বেশীদিন সে সব সহ্য করতে হয়নি । মণির যখন সতেরো বছর বয়েস তখন তিনি পরলোক গমন করেন । ছেলের মতিগতি বুঝে উকিলবাবু উপলব্ধি করেন তাঁকে অধিক অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতে হবে । না হলে ভবিষ্যতে সন্তানের কপালে অশেষ দুর্গতি লেখা আছে । তিনি তাই করেন । ব্যাঙ্কে ভালো পয়সাকড়ি রেখে দশ বছর আগে স্বর্গে গেছেন ।
মা ও বাবার মৃত্যুর মাঝে সময়ের বড় ব্যবধান আছে । কালক্রমে সে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে বটে কিন্তু কোথাও চাকরির চেষ্টা করেনি । তাই বলে সে বাউন্ডুলে কিম্বা নেশাখোর হয়ে যায়নি । পৈতৃক সম্পত্তি ভোগ ও বাপের জমানো টাকায় ফুর্তি করে দিন কাটানোর কথা সে ভাবে না । সে তবলা বাজানোকেই রোজগারে সাধন করে নিয়েছে । সঙ্গীতচর্চা করে যে সব মেয়েরা তাদের বাড়ীতে গিয়ে সঙ্গত করে এবং শহরের গানের স্কুলে বাজায় ।
লেখক এক চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ করেছেন । " একবার তো রীতিমতো হৈচৈ পড়ে গেল । শহরের নাম করা ক্লাব 'জাগরণী'র বার্ষিক জলসা । মান্না দে এসেছেন গাইতে । রাত্রে হুলুস্থুল । শিল্পীর সঙ্গতদার হঠাৎ অসুস্থ । মঞ্চে উঠে বাজাবার অবস্থা নেই তাঁর । শহরে কি আর তবলচি নেই ? ছেলেরা মণিকে ধরল । মণি একগাল হেসে বলল , 'এ তো আমার পরম সৌভাগ্য ।'
ছেলেরা বলল 'তোমার ভয় করছে না ?'
' মোটেও না ।' মনে মনে উস্তাদ আল্লারাখার ছবি স্মরণ করে উঠে পড়ল মঞ্চে ! জান লড়িয়ে দিল । অনুষ্ঠানের শেষে মান্না দে মহাশয়কে প্রণাম করলে তিনি মণিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন । পরের দিন সেই ছবি শহরের নিজস্ব ট্যাবলয়েড 'নির্ভীক' এর প্রথম পাতায় বেরোলো । মণি তার এক খানা ভালো প্রিন্ট সংগ্রহ করে বাঁধিয়ে রাখলো ঘরের দেওয়ালে ।
এই ঘটনার পর মণির ছাত্র সংখ্যা বেড়েছে । 'জাগরণী'র বার্ষিক অনুষ্ঠানে তবলা লহরা শোনাবার একটি সুযোগ সে পেয়ে থাকে । সব মিলিয়ে তার যা রোজগার , হেসেখেলে চলে যায় । খরচই বা কী ? পরে সুতির পাজামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি । পায়ে সাধারণ চটি । মাঝারি গড়ন । কালো গায়ের রং । উল্টে আঁচড়ানো চুল । নাক চোখ ভালোই । একেবারে গড়পড়তা বঙ্গ যুবা । "
মোটের ওপর এই হল মণিময় ঘোষালের পরিচয় । কিন্তু বিয়ের বাজারে তার তেমন দর নেই । কারণ এলিজিবল ব্যাচেলর বলতে যা বোঝায় মণি তো আর ঠিক তা নয় । ভালো মানুষ আর ভালো পাত্র এই দুই কি এক জিনিস হলো ? শহরগঞ্জে তবলচির ভাব মূর্তি তেমন উজ্জ্বল নয় । লোকে মনে করে কেবল অকম্মার ধাড়িরাই তবলা বাজিয়ে থাকে । তবুও এতো কিছুর পরেও তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এলো । সে নিজের সম্পর্কে যতই উদাসীন হোক না কেনো তার ভদ্র সংযত স্বভাব যা কিনা দুর্বলতার নামান্তর মাত্র সে সম্পর্কে প্রতিবেশীরা যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল তার প্রমাণ পাওয়া গেলো । পাড়াতুত পিসি খেটুর মা যখন মণির কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো তখন সে বলে ভনিতা না করে সরাসরি বলতে কার হয়ে ঘটকালি করা হচ্ছে ? খেটুর মা হলো বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসি । জানা যায় পাত্রী হলো তারক চক্রবর্তীর মেয়ে রূপালি । এবার সেই পাত্রী সম্পর্কে কিছু জরুরী তথ্য জেনে নেওয়া যাক । বাজারের পাশে তারক চক্রবর্তীর চায়ের দোকান । কায়ক্লেশে সংসার চলে । গামলা গামলা চা বানিয়ে চেহারা শুকিয়ে গেছে । তা সত্বেও বাড়তি রোজগারের আশায় পুরুত বামুনের কাজও করতে হয় । তবে সে সব বড়সড় কিছু নয় । গৃহস্থ বাড়ীতে ছোটখাটো পূজা অর্চনা । তাঁর স্ত্রী দীপালীর মতে "নেহাত পৈতৃক ভিটেখান ছিল । নইলে পেটে গামছা বেঁধে থাকতে হতো গো ।" এঁদেরই একমাত্র সন্তান রূপালি । তিনবারের চেষ্টাতেও উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি টপকাতে পারেনি । স্কুলের পরীক্ষাতেও আগে একাধিকবার হোঁচট খেয়েছে । ফলে এখন তার বয়েস তেইশ বছর । যদিও তার মা সেটা উনিশের ঘরে আটকে রাখতে মরিয়া চেষ্টা করেন । গুণের মধ্যে রূপালি রূপবতী কন্যা । এই কথাটা সে নিজে বুঝেছে অতি অল্প বয়েসেই । বারো বছর বয়েস থেকে আজ পর্যন্ত সে বহু জনের সঙ্গে প্রেম করেছে । এখন তার একাধিক ছেলে বন্ধু রয়েছে । যিনি সম্বন্ধ করেছেন সেই খেটুর মায়ের কথায় "এই যে গেল শীতে ফাংশন হল , ঊষা থুপথুপ এল গাইতে ... দেখি রুপুলি গাদাগুচ্ছের ছেলেপুলের সঙ্গে বসে টুইটুই সিটি মারছে । এক সময় দেখি , কোমর দুলিয়ে নাচতেও লাগলো ।" এ থেকে রূপালির স্বভাব , রুচি বোধবুদ্ধি সম্পর্কে একটা আন্দাজ পাওয়া যায় । কিন্তু যখন বিয়ের কথা উঠলো তখন সে প্রথমে বেঁকে বসলো । কারণ হিন্দি সিনেমা দেখে তার মনে স্বপ্ন জেগেছিল তার বর হবে ম্যাচো হিরো সঞ্জয় দত্তের মতন । সে জায়গায় কিনা সাদামাটা নিঃশত্রু সদাহাস্যময় তবলচি মণি ঘোষাল ! ছিঃ । সে প্রবল আপত্তি তুলে ঘাড় গোঁজ করে বসে রইল । কিন্তু তারক চক্রবর্তী হাতে চাঁদ পেল । সারা গঞ্জে সন্ধান করে মণিময় সম্পর্কে কোনো নিন্দেমন্দর কথা শোনা যায় না । কচি কচি মেয়েদের সঙ্গে তবলা বজায় । কিন্তু কেউ কখনো বলেনি মণি তাদের দিকে কু নজরে দেখেছে । কত তরুণী মণির সঙ্গতে গান গেয়ে বিয়ের তরী পার করে দিলো । সব চাইতে বড় কথা মণির কোনো দাবিদাবা নেই । অন্য পাত্রদের যা কিনা আকাশ ছোঁয়া । দীপালি বোঝালেন "বাপে প্রচুর টাকা রেখে গেছে । অত বড় বাড়ীর একমাত্র অধিকারী । আমার মতো টেনেটুনে সংসার চালাতে হবে না । "
অগত্যা রূপালি কনের সাজে সজ্জিত হলো । কিন্তু তার সব রাগ গিয়ে পড়লো মণির ওপর । কারণ মণি অসন্মত হলে তার বাবা অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করতো নিশ্চিত । মণি সেই পথ বন্ধ করে দিলো । লেখক বলেছেন "শুভ দৃষ্টির সময় মণি হাসি - হাসি মুখ করে পরম প্রেমিকের চোখে তাকিয়েই রইল রূপালির দিকে , রূপালি একবারও সে চোখে চোখ রাখলো না । ... ফুলশয্যার রাতে রূপালির বাঁ হাতের অনামিকায় যখন আংটি পরাচ্ছে মণি , তার গলা শুকিয়ে কাঠ , বুক কাঁপছে , সে কোনক্রমে বলল , রূ রূপালি , দেখো তো আ আংটিটা পছন্দ ?
রূপালি মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে লম্বা হাই তুলে বলল , " আদিখ্যেতা করো না তো ! শুতে দাও । আজ আবার ওসব করতে টরতে চেয়ো না । বড্ড ঘুম পাচ্ছে ।
মণি কাঠ হয়ে শুয়ে রইল সারা রাত । ভাল ঘুমোতে পারলো না । পাছে ঘুমের ঘোরে রূপালির গায়ে হাত লেগে যায় । পাছে সে ভেবে বসে , মণি ঘুমের ছলে সুযোগ নিচ্ছে ! ছি ছি ! সে শুয়ে শুয়ে রূপালির চন্দন পরা তাজা মিঠে মুখ খানি ভাবে । ভাবতে ভাবতে তার বুক টনটন করে ! মায়ের কথা মনে হয় । মা থাকলে কত খুশি হত ! "
অর্থাৎ একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিন থেকে রূপালি তার স্বামীর আশাতীত নম্র ভদ্র সরল স্বভাবের সুযোগ নিয়ে যে রুক্ষ ব্যবহার শুরু করে তা এক প্রকার মানসিক নির্যাতনের নামান্তর । রূপালির ইচ্ছে ছিল উটি কিম্বা কুলুমানালিতে গিয়ে হানিমুন করে । কিন্তু মণি তাকে নিয়ে গেলো বেথুয়াডহরি । সঙ্গে তবলা , উদ্দেশ্য নির্জনে সাধনা করা । রূপালির কাছে পুরো ব্যাপারটা ন্যাকামো ছাড়া আর কিছুই নয় । রাতে মণি আদর করে গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে সে খেঁকিয়ে ওঠে
" যাও তো ! হাত নয় তো ! পোড়া কাঠ !
মধু চন্দ্রিমায় এক দিনও তারা মিলিত হয়নি । মণি রাগ করেনি । ভেবেছে , আহা ছেলেমানুষ ! ওর তো শখ থাকবেই ভাল ভাল জায়গা দেখবার ! " স্বামীকে যৌণ উপবাসী করে রাখার মধ্যে এক ধরনের মর্বিড সুখ অনুভব করতে থাকে সে । বাড়ী ফিরে মণির মনোযোগ আকর্ষণ করতে নতুন পন্থা অবলম্বন করে । কোনো প্রকারে বেগার ঠেলায় সংসারের কাজ সারে ও মুখ গোমড়া করে থাকে । মণি অধৈর্য হয়ে উঠে কারণ জানতে চায় । সে এই সুযোগটাই খুঁজছিল । ইনিয়ে বিনিয়ে বলে যে সাড়ম্বরে নিজের জন্মদিন পালন করতে চায় । সমস্ত বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করতে চায় । মণি এক কথায় রাজি হয়ে যায় । রূপালি আরো এক ধাপ লাভের পসরা সাজিয়ে তুলল । দশ হাজার টাকার বেশী মূল্যের সোনা ও মুক্তোর দানার হার চেয়ে নিল । কিন্তু মা ও পাড়ার মাসি খেটুর মাকে বলল মণি নিজে থেকে দেইনি সে অনেক জোর করে আদায় করেছে । সে যাই হোক সন্ধ্যা বেলায় মহা সমারোহে জন্মদিনের পার্টি শুরু হল । অন্যান্য আমন্ত্রিতদের সঙ্গে কমলেশ ও বাবুয়াও উপস্থিত ছিল । মণির বাবা বেঁচে থাকতে যারা এই বাড়ীতে পা রাখার সাহস করতো না তারাই এবার মাথায় চড়ে বসলো । মণি নিজের অজান্তে বংশ কৌলীন্য খুইয়ে বসলো । এর পর থেকে রূপালির বন্ধুরা প্রায়শই বাড়ীতে আসতে লাগলো । বিশেষতঃ মণির অনুপস্থিতিতে কমলেশ ও বাবুয়া । মণি শিশুর ন্যায় সরল তাই হঠাৎ কোনো দিন দুপুরে বাড়ী ফিরে স্ত্রীকে আলুথালু অবস্থায় দেখে কিম্বা নিজের শয়নকক্ষে নিজের বিছানায় পরপুরুষকে দেখেও তার মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি । সে ভেবেছিল তার স্ত্রী নিঃসঙ্গতা দূর করতে বুঝি বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছে । তবে খেটুর মায়ের অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়লো সব । কথা কানে হেঁটে পৌঁছলো রূপালির মায়ের কাছে । তিনি জামাইকে ডেকে বললেন
"বাবা স্ত্রীর কোল খালি রেখো না । এবার আমাদের নাতি নাতনী আসুক ।" রাত্রে স্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়ে সেই প্রস্তাব দিতে সে ছিটকে দূরে সরে গিয়ে বলল " বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমাকে ফাঁসানোর মতলব না?
মণি অবাক গলায় বলল , তুমি মা হতে চাও না ?
বোকা বোকা কথা বোলো না । মা হতে সব মেয়েই চায় । তার আগে জীবনটা একটু ভোগ করবো না ? এখুনি আমায় কাঁথা কাচতে হবে ?" মণি কয়েক বার বৌকে কাছে টানার চেষ্টা করেছিল । উত্তর এলো এই রকম "পোড়া কাঠের আঙ্গুল দিয়ে টেনো না । আমার লাগে । নিজে বুড়ো বয়সে বিয়ে করে আমার কচি শরীরটা ধামসাচ্ছ , তাতে শখ মিটছে না , আবার এক্ষুনি বাচ্চা চাই !"
এর থেকে চরম অবমাননা ও লাঞ্ছনা একজন মানুষের জীবনে আর কি হতে পারে ? তবলিয়ার বৈবাহিক সম্পর্কের আরো কিছু অনভিপ্রেত দিক উদঘাটিত হতে বাকী ছিল । ইদানিং রূপালির বন্ধুদের আর আসতে দেখা যায় না । বেশী আসতো বাবুয়া আর কমলেশ , তারাও আসে না ! কিন্তু কেনো ? লেখকের কাছ থেকে আমরা জানতে পারছি "বিবাহের আগে প্রেমিকদের চুমু-টুমু , স্তনপীড়ন সে উপভোগ করেছে । বিবাহের পরে পূর্ণ যৌণ জীবনের আস্বাদে পাগল সে বাবুয়াকে নিচ্ছিল , কমলেশকেও । দু'জনকেই সে বলত আচ্ছা স্বামী ছাড়া আর একজনকে ভালোবাসা কি পাপ ? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি । দু জনেই সেটা বিশ্বাস করেছিল । কিন্তু একদিন বাবুয়াকে দেখে ফেলল কমলেশ , কমলেশকে আর একদিন দেখে ফেলল বাবুয়া । এতো কাল তারা ছিল এক আড্ডার বান্ধব । এবার পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী হল ।" নিজের ছলনাময়ী চরিত্রের দিকটা স্বামীর কাছে আড়াল করতে বিশেষ চেষ্টা করতে হয় নি । কিন্তু বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত দুই পুরুষের কাছে সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গেল । কোনো কৌশল কাজে লাগে না । দুই প্রেমিক তুমুল লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে এই সিদ্ধান্তে এলো যে মেয়েরা হলো সাপের জাত । অভিমানে আহত হয়ে তারা আসা বন্ধ করলো । রূপালির মুখে ম্লান ছায়া , তাই দেখে মণির বুক ফেটে যায় । প্রশ্ন করে জানতে পারে বন্ধুরা একে অপরকে হিংসা করে তাই আসে না । স্ত্রীর দুঃখে কাতর মণি রাস্তায় বেরিয়ে তার পুরুষ বন্ধুদের খোঁজ করতে লাগলো । বাবুয়াকে না পেয়ে কমলেশকে পাকড়াও করে নিয়ে আসে । রূপালির হাতে তাকে সমর্পণ করে তবলার সাধনায় বসে ঘরের দরজা বন্ধ করে ।
লেখক যে ভাবে কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন তা সরাসরি তাঁর কাছ থেকেই জেনে নেওয়া যাক। " রূপালি কমলেশের হাত টেনে শোবার ঘরে এল । মুখের কাছে মুখ এনে বলল 'এতো দিন না এসে থাকতে পারলে ?' মণির তবলা বাজানোর শব্দ আসছে । কমলেশ বলল ,
'ও ঘরে মণি দা ! হঠাৎ যদি এসে পড়ে ?
রূপালি এক ধাক্কায় কমলেশকে বিছানায় বসিয়ে দিল । দু'হাতে তাকে জড়িয়ে বুকে মাথা চেপে নিয়ে বলতে লাগলো , 'ও এখন আসবেই না । বদ্ধ পাগল । তবলা ছাড়া কিছু জানে নাকি ? বলে , ওসব করার সময় নাকি বিশেষ বিশেষ তালের ছন্দ পায় । হি হি হি !'
ধকধক করে উঠল কমলেশের বুক ।তার মনে হল , যে শব্দ আসছে তা তবলা বাদনের নয় । কোনোও প্রেমিক পুরুষের বেদনাময় হৃদয়ধ্বনি ! কান্না ! এ কান্না সবার থেকে আলাদা !
সে ঠেলে রূপালিকে সরিয়ে দিল । দাঁতে দাঁত চেপে ভাঙ্গা গলায় বলল , 'ছিঃ ছিঃ রূপালি ! আমাকে আর পাপের ভাগী কোরো না । "
স্বৈরিনী নারী নিজের রূপ যৌবন ও যৌণ আকর্ষণের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে বহুগামিতায় লিপ্ত হয়ে শরীরী সুখ অনুভব করে । মণির তুলনায় রূপালি সব দিক থেকেই অধঃস্তন ও অসমমানের । দুজনের মধ্যে মিলের চাইতে অমিল বেশী । মানুষ হিসাবে মণি উত্তম ও রূপালি অধম তা অনস্বীকার্য । যার যতটুকু প্রাপ্য তার চাইতে বেশী পেলে সে তার মূল্য বোঝে না , বরং অমর্যাদা করে । অন্যদিকে সর্বগুণান্বিত হয়েও হিনমন্যতা ও ভীরু স্বভাবের কারণে মানুষ আজীবন অন্তরদাহে পুড়ে ছাই হয়ে যায় । এই কাহিনী তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । পুরুষ কিভাবে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হবে ? তাও কি সম্ভব ! আবহমান কালের জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকা ধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় ।
তিলোত্তমার লেখনী কখনই শৌখিন ও পোষাকি নারীবাদের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না । তিনি প্রথম থেকেই নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী , তাঁর সৃষ্ট চরিত্র গুলিই এর সাক্ষ্য দেয় । সমাজের নিগড়ে আটকে পড়া শৃঙ্খলিত মানুষ , যাদের অধিকাংশই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কিম্বা আর্থ সামাজিক ও পারিবারিক স্তরে পিছিয়ে থাকা মানুষ যারা কখনো সুবিচার পায়নি তাদের জন্য তাঁর কলম বারংবার সোচ্চার হয়েছে । সেই সঙ্গে মানব হৃদের অন্তর্লীন জগতের গুঢ় রহস্যের সন্ধান করেছেন লেখক । সেখানে জমাট বাঁধা অন্ধকারের মতন যন্ত্রণা ও দুঃখবোধকে উপলব্ধি এবং বিশ্লেষণ করে এক ভিন্নতর চেতনার স্তর স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছেন ।
বিবলিওগ্রাফি :
গ্রন্থ : পঞ্চাশটি গল্প
লেখক : তিলোত্তমা মজুমদার
প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স
প্রথম সংস্করণ : ২০১২
ননদ - বউদির রান্নাঘর
রচনাকাল : ডিসেম্বর ২০০৮
প্রকাশ : আনন্দ বাজার পত্রিকা রবিবাসরীয় , ২৮ ডিসেম্বর ২০০৮ ।
তবলিয়া
রচনাকাল : সেপ্টেম্বর ২০১০
প্রকাশ : শারদীয়া আনন্দউৎসব .কম , ২০১০
------------------------------
শব্দ সংখ্যা আনুমানিক : ৩৩৬০
SUDIP PATHAK
Swapno Neer Apartment ,
3rd floor , flat no: 3 ,
321 , Purba Sinthee Road ,
Madhugarh , DumDum ,
Kolkata - 700030 .
Phone & what's app number :
9874919948