ধারাবাহিক উপন্যাস ।। সোনালী দিনের উপাখ্যান - পর্ব ২৩ ।। দেবব্রত ঘোষ মলয়
পূর্বকথন
মনন মায়ের অস্বাভাবিক আচরণে উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করে বাল্যবন্ধু সুমনকে। কলকাতার নামকরা সাইক্রিয়াটিস্ট বাল্যবন্ধু মনন তাকে আসতে বলে নিউ টাউন এর অভিজাত আবাসন গ্রীন ভিউ-এর চোদ্দতলার আপ্যার্টমেন্ট-এ। এরপর ...
পর্ব ২৩
নিউ টাউনের পরিচ্ছন্ন প্রশস্ত রাস্তায় ট্যাক্সি থেকে নামে সুমন। এই জায়গাটায় বেশ কয়েকটি নামি কর্পোরেট হসপিটাল। সামনেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গ্রীণ ভিউ এর ৩২ তলা টাওয়ার। অনেকখানি জায়গা জুড়ে পাঁচিল ঘেরা প্রশস্ত বাগান ও সুইমিং পুল। তার মাঝখান দিয়ে সাজানো পথ। সে পথ পেরিয়ে সুমন পৌঁছে যায় লিফটের সামনে। চোদ্দতলায় পৌঁছে লক্ষ্য করে লিফটের সামনের ফ্ল্যাটের দরজাতেই পিতলের নেমপ্লেট "ড. সুমন মৈত্র"। ডোরবেল-এ আঙ্গুল ছোঁয়ায় সে।
দরজা খোলে ভৃত্যস্থানীয় একটি যুবক। সুমন পরিচয় দিতেই সে হেসে ভিতরে ডাকে সে। ভিতরে প্রশস্ত সাজানো ড্রইং রুমের সোফায় বসতেই ডানদিকের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সুমন। চেহারায় খুব একটা পরিবর্তন হয় নি, শুধু মুখে চোখে মেধা ও আভিজাত্যের ছাপ।
"ওয়েলকাম মাই ফ্রেন্ড। উফঃ, কতদিন পরে দেখা। এই ওয়ার্কহলিক লাইফে অস্থির হয়ে গেছি রে, আজ খুব ভালো লাগছে তোকে দেখে। কাকলি, কাকলি, একবার এসো তো এখানে।
এবার বাঁদিকের ঘরটি থেকে খুবই সুন্দরী এক মহিলা ছোট্ট একটি ফুটফুটে মেয়ের হাত ধরে ড্রইং রুমে প্রবেশ করে। তাঁর পিছনেই সেই কাজের ছেলেটি দুহাতে কফির সরঞ্জাম নিয়ে প্রবেশ করে।
মিষ্টি হেসে দু হাত জোড় করে নমস্কার করে বলে মেয়েটি - নমস্কার সুমনবাবু, আমি বিদিশা, সুমনের ঘরণী আর আমার মেয়ে পিউ। আপনার কথা ওর কাছে শুনেছি।
মনন প্রতিনমস্কার করে। নিজের ব্যাগ থেকে ভীম নাগের একটা মিষ্টির বাক্স আর বড় ক্যাডবেরি সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে কাছে টেনে নেয় পিউকে। ওর হাতে ক্যাডবেরি দিয়ে কল স্কুলে পড়ে জানতে চায় সে। পিউ রিনরিনে মিষ্টি গলায় বলে - স্ট্যান্ডার্ড ফোর, লোরেটো ডে স্কুল।
কফির কাপ হাতে ওদের আড্ডা জমে ওঠে। ছোটবেলার গল্প, স্কুল জীবনের কথা আলোচনা করতে করতে কত সময় কেটে যায়। এর মধ্যেই বিদিশার ডাক আসে, সবাই এসো খাবার টেবিলে। আবার আড্ডা হবে খেয়ে।
খাবার পর সুমন বলে - এবার বল তোর মায়ের কথা। তবে তার আগে বলি, এবার বিয়েটা সেরে ফেল।
মনন বলে - তুই নিজে চোদ্দ বছর থেকে প্রেম করে বাল্যবিবাহ করলি বলে সবাইকেই তাই করতে হবে নাকি।
সুমন হাসতে হাসতে বলে - মানছি, তখন এই বনলতা সেন এর আকর্ষণ এড়ানোর ক্ষমতা আমার ছিল না।
মনন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে আসল কথায় আসে। বাবার অকালমৃত্যু থেকে শুরু করে মায়ের এই সকালের চা খাবার কথা, সবই সবিস্তারে জানায় সে।
সব শুনে কিছুক্ষন চুপ করে থাকে সুমন। তারপর বলে - মানুষ যদি আচমকা তার খুব ভালবাসার মানুষকে হারায়, তখন মানুষের মনের মধ্যে তোলপাড় হয়ে যায়, খুব বড় আঘাত লাগে মনে। অতীতের কোনরকম মানসিক রোগের ইতিহাস না থাকলেও শুরু হতে পারে মনের রোগ লক্ষণ। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে পোস্ট ট্রমাটিক সিম্পটম। কারোর কারোর ক্ষেত্রে এটি নানারকম ম্যানিয়ার সৃষ্টি করে, কেউ কেউ গুম হয়ে যায়, অনেকে মাঝরাতে উঠে পড়ে। অনেক রুগী হ্যালুসিনেশন-এর শিকার হয়, সে মাঝে মাঝে দেখে ফেলে তার প্রিয়জনকে। এটা তখনই সিরিয়াস রোগলক্ষন হিসেবে বিবেচিত হয়, যখন নিয়মিত ঘটে এটি। মাসীমার ক্ষেত্রে রোজ ঘুম থেকে উঠে এটি ঘটছে, তখন উনি মেসোমশাইকে মানস চক্ষে শুধু দেখছেনই না, তাঁর সঙ্গে চা খাচ্ছেন এবং হয়ত কথাও বলছেন।
মনন প্রশ্ন করে - এর কি কোন চিকিৎসা হয়?
সুমন বলে - এ ক্ষেত্রে প্রথম চিকিৎসা কাউন্সেলিং। তারপর কিছু থেরাপি আছে। শোন, আমাকে একবার দেখতে হবে রোগীকে। আমি মাসীমার সকালের ওই চা খাবার ব্যাপারটা নিজে দেখতে চাই। তারপর কথা বলতে চাই ওনার সঙ্গে।
মনন সোৎসাহে বলে - তাহলে আগামী রোববার তুই চলে আয় আমাদের বাড়ি। দুপুরে ওখানেই খাবি আর বিদিশা আর পিউকেও নিয়ে আসিস।
সুমন হাসতে হাসতে বলে - রবিবার ভোরে আমি তোর বাড়ি যাব কিন্তু দুপুর অবধি থাকা যাবে না। আমার কনফারেন্স আছে দুপুরে। আর ওদের অন্য সময়ে নিয়ে যাব, রোববার পিউএর সকাল থেকেই এক্সট্রা কারিকুলাম ক্লাস থাকে দুটো।
মনন উঠে পড়ে। বলে, ঠিক আছে। তাই হবে। আজ আমি উঠি। রোববার দেখা হবে।
লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দেয় সুমন। হাত নেড়ে বিদায় জানায় বিদিশা, বলে আবার আসতে হবে কিন্তু। টা টা করে পিউ।
লিফটের দরজা বন্ধ হয়।
ক্রমশঃ