হঠাৎই বেড়ানোর প্রস্তাব এল। আমরা প্রথমত জায়গার নাম শুনেই আরও আগ্রহী হয়ে উঠলাম। "মনচাষা"!এরকম একটা মিষ্টি নাম, তার ওপর eco _ tourism এর আকর্ষণ!
তড়িঘড়ি সব গোছগাছ করে আমরা ready।
পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁউশী গ্রামে এই ''মনচাষা", যার নামকরণের মধ্যেই বেশ একটা মাদকতা আছে।
শহুরে যান্ত্রিক সভ্যতার থেকে বেশ কিছুটা দূরে একেবারে গ্রামের মধ্যে চারটি বাঁশের তৈরি থাকার ঘর, সঙ্গে একটু দূরে আছে খাবার ঘর ,বসার ঘর, রান্নাঘর ,আর আছে বাগান, পুকুর ,ক্ষেত, একটি ক্ষুদ্রাকৃতি সংগ্রহ শালা, গোশালা, মন্দির, তুলশীমনচো ইত্যাদি।
বহু ফাইভ স্টার হোটেলের ক্লিশে এবং কৃত্রিম আতিথেয়তার পরে এখানকার তথাকথিত ম্যানেজমেন্ট ছিল একেবারেই গ্রাম্য, কিন্ত অসম্ভব অকৃত্রিম এবং আন্তরিক।
এই উদ্যোগের আসল উদ্দেশ্য ই হল শহুরে অতিথিশালা বা পর্যটনের বিপরীত একটা ধারনা তৈরী করা। যেটা আমাদের গ্রামীন সংস্কৃতির মূল অতিথি আপ্যায়নের ধারনার সঙ্গে জড়িত।
পর্যটন যে সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, বা জঙ্গল ছাড়াও নিছক গ্রামীন পরিবেশেও হতে পারে,"মনচাষা " তার উদাহরণ।
বিপুল খরচার বদলে যে বিলাসিতার আরাম পাওয়া যায়, তার থেকে স্বল্প খরচে এইসব জায়গায় যে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়, তার দাম অনেক বেশী।
আমাদের শহরের জীবনযাত্রা জনিত অসুখ গুলি বোধহয় এই ধরনের পর্যটনে একেবারেই উধাও হয়ে যায়।
আমরা দুজনে আমাদের গাড়ীতেই গেলাম। আমাদের বন্ধুরা ওদের গাড়ীতে। অধিকাংশ রাস্তা ভাল। তবে কিছু কিছু অংশ যথেষ্ট খারাপ। আমার husband ড্রাইভ করতে ভাল বাসে তাই এসবে আমল দেয়না।
করোনা র করুনা য় বেড়ানোর উপায় ছিল না গত এক বছর।
কলকাতা থেকে 150 কিলোমিটার দূরত্ব। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম। কোনা এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে যেতে হল।
একটা জায়গায় একটু চা বিরতির জন্য আমরা দাঁড়ালাম।
কালীনগর পর্যন্ত রাস্তা বেশ ভাল তবে তার পর এত সরু যে driving skill পর্যাপ্ত না হলে অবস্হা সঙগীন হতে পারে।
আর পাঁউশীতে পৌঁছনোর পর যে রাস্তা দেখলাম তা তাবড় তাবড় expert driver এর ঘাম ছুটিয়ে দেবে।
আমাদের বন্ধুদের গাড়ী একজন ড্রাইভার চালিয়ে ছিল।সে কোনোমতে ওদের গাড়ী নিয়ে গেল, আর তারপর দেবাশিস কে ও একটু গাইড করাতে বেশ কসরত করে তবে, 'মনচাষা'য় পৌঁছনো গেল।
একজন মহিলা দেখলাম আমাদের জিনিস পত্র নিয়ে যাবে বলে একটা ঠেলাগাড়ী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পরে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। দুদিন ধরে তার হাতের অসাধারণ রান্না খেয়ে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম।
আর একজন অল্প বয়সী বউ ছিল, এরা দুজনেই সব কাজ করে দিচ্ছিল। রাতে মশারী টাঙিয়ে দেওয়া থেকে চার বার করে প্রস্থে প্রস্থে খাবার দেওয়া ,সবই এরা দুজন।
ঘর গুলি র অভিনব, construction আর architecture দেখে আমরা অবাক। interior ও খুব রুচিসম্মত ভাবে সজ্জিত।
ঘরের আলো গুলো অবশ্য সন্ধে র পরে পর্যাপ্ত নয়।আর ইঁদুরের উৎপাত ভাল ই ছিল।
আমার সাধ করে কেনা কেক দেখি, অর্ধেকটা ইঁদুর বাবাজী নিয়ে গেছে।
সকালের নিষ্পাপ সূর্যোদয় দেখি বহুদিন পর। অপূর্ব মহিমান্বিত সূর্যাস্ত বিকেল টা কে স্মরনীয় করে তোলে।
'অন্ত্যদয়' অনাথ আশ্রম টি মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে।এদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আগেই ছিল।বহুদিন ধরেই ইচছা ছিল ওদের আশ্রম দেখার। এই সুযোগে সেটাও হয়ে গেল।
ভরপুর আনন্দের স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম, কখোনো আবার যাবার ইচছে রইল।
বলা হয়নি, ওখানে আবার ছোট্ট একটা দোকান ও আছে, যেখানে আঞ্চলিক হস্তশিল্প বিক্রি হয়।বেশ কেনাকাটা ও করতে পেরে মনের সন্তুস্টি বেড়ে গেছিল।
তার ওপর, সদ্য পাড়া খেজুরের রস, খেজুরের খাঁটি গুড়, গ্রামের কোনও বাড়ি তে তৈরী খাঁটি গাওয়া ঘি, এইসব exclusive জিনিস আনতে পেরে ,আমরা দুই বন্ধু খুব খুশী।
একদম পাড়াঁগা দেখার অভিজ্ঞতা হলো। মেদিনীপুরের মানুষ এর শিক্ষার হার অন্য জেলার থেকে বেশী,তাই দেখলাম বাচ্চারা সবাই স্কুলে যাচ্ছে।মহিলারা যথারীতি বাড়ীর কাজে সারাদিন পরিশ্রম করছে।পুরুষ রা ও কেউ বসে থাকে বলে মনে হল না।বেশীরভাগ ই চাষের কাজের সঙ্গে যুক্ত। প্রত্যেকের কথাবার্তা খুব বুদ্ধিদীপ্ত যদিও তারা হয়ত কেউই উচ্চ শিক্ষিত নয়।
গ্রামীন সভ্যতা ,সংস্কৃতি , পরিবেশ এখনো অনেক অংশে খাঁটি, যদিও শহরের ভেজাল, দূষন সবই ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে। প্রচুর মানুষের হাতে smartphone চোখে পড়ল।তাতে সুবিধার কথা তো বলাই বাহুল্য! তবে সংস্কৃতির দূষন রক্ষা করা যায় না।
--------------------------