শুভ জন্মদিন
জয়শ্রী ব্যানার্জী চক্রবর্তী
কিছুক্ষন মাথার রগটা চেপে ধরলেন বিধায়ক দিব্যেন্দু মিত্র ।উফ! তোরা যে কি করিস না ! বলে সামনে তাকালেন ঘরের উল্টো দিকের চেয়ারে বসা , বিকাশ, সুমিত , রফিক আর সাকিব-এর দিকে । বিকাশ বললো কি করবো দাদা মালটার হেভী বাড় বেড়েছিল, ওখানে হিন্দুত্ব বাদী সংগঠন চালাচ্ছিল । এখান থেকে সাকিবের কাছ থেকে নিয়মিত ইনফরমেশন পাচ্ছিলাম । তাই তো যেতে হয়েছিল ! সাকিব বলে হ্যাঁ দাদা বড্ড জেদী । বারণ তো শোনে নি উল্টে আমাদের অপমান করেছিল, আমাদের রাগ উঠে গেছিলো , আর দাদা সত্যি বলতে দারুন দেখতে, কন্ট্রোল হয়নি । ব্যক্তিত্বের সাথে রূপের বড্ড আকর্ষণ । চুপ কর ! খিঁচিয়ে উঠলেন দিব্যেন্দু মিত্র । তোদের জন্য এখন আমায় ছুটতে হবে এখানে ওখানে ,সামনে পঞ্চায়েতের ইলেকশন আছে ; তোদের জন্য কি আসনটা হারবো? চল ফোট এখন । আমি কিছু দরকারি কথা বলবো । দুদিন কলকাতা থেকে গা ঢাকা দিবি ।আর সাকিব তুইও এখন তোদের গ্রামে যাবি না । গাড়ীর ব্যবস্থা করে দেব । পুরুলিয়ার একটা হোটেলে কথা বলে রাখব ওখানে কদিন ঘুরে আসবি । বলে একটু থেমে প্রশ্ন করলেন ক'জন ছিলি তোরা ? সুমিত বলে দাদা আমরা চার জন । মেয়েটা কি বেঁচে আছে ? প্রশ্ন করেন দিব্যেন্দু মিত্র । জানিনা রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছিলাম । মার্ডার এর সময় পায়নি- রফিক উত্তর করে । দিব্যেন্দু মুখ তুললেন কেস টা রায়না থানার আন্ডারে পড়ছে । সেক্রেটারী দীপকের দিকে তাকালেন ওখানে ওসি কে ? খোঁজ নে তো ? ওখানকার বিধায়ক নিখিল দাস কে ফোন লাগা ! দীপক বললো ওকে! তার পর ফোনে কথা বলতে লাগল । কথা শেষে বললো ,দাদা কে এক অর্চিষ্মান গোস্বামী রায়নার থানার ওসি এখন । নিখিল দা বলছেন বামুনের ব্যাটা বড্ড ত্যাঁদর । অল্প বয়সী ,মাথায় এখন সমাজ সেবার ভূত ! নিখিল দার সাথে বেশ কবার সংঘর্ষ হয়েছে । একটু ওয়েট করতে বললেন সব ঠিকুজি দেবেন । দেখছি ব্যাটাকে । আর কি বললো ? আচ্ছা তোরা সব যা ।আমায় একটু ভাবতে দে আর দীপক একটু কফি পাঠিয়ে দে । বলে দিব্যেন্দু ঘড়ি দেখলেন রাত ১২ টা প্রায় ।
পরদিন নিউজ টা পেলেন প্রথম সারির বাংলা সংবাদপত্রে। রাত প্রায় ৮ টায় একটি মেয়েকে রক্তাত্ব অবস্থায় উদ্ধার করে এক পথচারী। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি । অবস্থা সিরিয়াস । পুলিশের অনুমান গ্যাং রেপ । মেয়েটি মেধাবী বলে পরিচিত এলাকাতে । ইউনিভার্সিটির ছাত্রী । ইদানিং হিন্দু সংগঠনের কাজের সাথে যুক্ত হয়েছিল । সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছিল ।পুলিশ অপরাধী দের খুঁজছে । রেখে দিলেন কাগজ দিব্যেন্দু মিত্র । ইদানিং ওই এলাকায় হিন্দুত্ব বাদী সংগঠন গুলো বড্ড মাথা চাড়া দিচ্ছে । সমূলে উৎপাটিত করতে হবে । কিছু মাস আগে গলসী এলাকায় প্রান্তিক বসু নামে একটা ছেলের লাশ পড়েছিল । ব্যাপার টা খুব হৈ চৈ হয়েছিল ।খুব হ্যাপা পোহাতে হয়েছিল সামলাতে ওদের । ছেলেটি বোধহয় মা বাবার এক মাত্র সন্তান ছিল । আহা বেচারা! কেনো যে সব এসব কাজে আসে ! খাবি দাবি চাকরি, ব্যবসা করবি , বাচ্চার জন্ম দিবি একটু হৈ হুল্লোড় করবি ব্যাস ওপর থেকে ডাক এলে চলে যাবি ! তা না যত সব রিস্কি কাজ !না তিনি অবশ্য এর মধ্যে নেই ওসব ওখানকার বিধায়ক সাংসদরা সামলান । খুন- খারাপি তিনি চান না । ইয়ং ছেলে মেয়ে সব এখন, অনেক স্বপ্ন চোখে দেশ গড়ার ! একটু কড়কে দিলেই হবে ! একটু বাড়াবাড়ি করছে দলের কর্মী ছেলে গুলো । বোঝাতে হবে ,কোনো মতেই তাঁরা পঞ্চায়েতের সিট গুলো খোয়াতে চান না ।
একটু শরীর চর্চা করে বসলেন তিনি । মেদহীন সুঠাম চেহারা । তিনি লম্বা । মাঝারি গায়ের রঙ । চা সিগারেট ছাড়া কোনো নেশা নেই তাঁর ।মহিলা তো দূর ! ৫০ এর ওপরে বয়স তাঁর । লোকে বলে তিনি এখনও সুপুরুষ । বাটিতে ছোলা ভেজানো থেকে মুখে ছোলা ফেললেন তিনি । রায়না থানা তাঁকে কিছু স্মৃতি তে ফেরায় ।কলকাতায় একটি অঞ্চলের তিনি তিনবারের বিধায়ক । ব্যক্তিত্ব , রাজনৈতিক দক্ষতা , সুবক্তা এসবের জন্য ওপর মহলে তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে । কীভাবে ভোটে দল কে জেতাতে হয় তাঁর জানা । অনেক কিছু তাঁর ইশারায় চলে ! অনেকের কাজ কারবার তাঁর জানা । সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে ঘি গরম করতে জানেন তিনি ।একাই থাকেন কাজের লোক দের নিয়ে ।সংসার তাঁর টেকেনি । টিকবে না জানা ছিল । পার্টির কাজের জন্য বিয়ে করতে চাননি তিনি ,কিন্তু তাঁর একটা ভুলের জন্য একমাসের অন্তঃস্বত্তা শ্রীরূপা কে বিয়ে করতে হয় তাঁকে । শ্রীরূপা কে তিনি ভালোবাসতেন । এখনো ..!
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি । সমীর মিশ্র বলে বন্ধুর আত্মীয়া শ্রীরূপা । শান্ত , স্নিগ্ধ , শ্যামলা সুন্দরী মেয়েটিকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেছিলো ।ওই রায়না থানার আন্ডারেই পড়ে ওদের গ্রাম ।এক বিয়ে বাড়ীতে আলাপ ।আর তা থেকে প্রেম । সে তখন বর্ধমান ইউনিভার্সিটির বাংলার ছাত্রী । তাঁর ছিল ইকোনমিক্স। কলকাতা ইউনিভার্সিটি । মাঝে মাঝে বর্ধমান এসে দেখা করতেন দুজনে ।
তিনি জানতেন তাঁর দ্বারা সংসার হবে না ।কিন্তু শ্রীরূপার সাথে বিশ্বাসঘতকতা করেন নি , নিজের ভুল কে স্বীকৃতি দিয়ে রেজিষ্ট্রি করেছিলেন তিনি । সেই সময় তিনি কিছু করতেন না পার্টি ছাড়া তার ওপরে শ্রীরূপা ছিল ব্রাহ্মণ ঘোষাল পরিবারের । স্বাভাবিক সেই সময়ে ওদের বাড়ী থেকে ঘোর আপত্তি ছিল । সংসারে তিনি সংসারী স্বামী হিসাবে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন ।পারেননি তিনি ।জানতেন পারবেন না এই ভাবে ধরা বাঁধার মধ্যে থাকতে !দু বছরের দাম্পত্য জীবনে তাঁদের কোলে আসে অদ্বিতীয়া । ডাক নাম দিয়া । বাপের বাড়ীর ওদিকে হাই স্কুলে জব পেলে শ্রীরূপা মেয়ে নিয়ে চলে যায়। তিনি মেয়ের নামে কিছু সম্পত্তি টাকা দিয়েছেন । শ্রীরূপা নিজের জন্য কিছু চায়নি শুধু মুক্তি চেয়েছিল। আইনত তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে । তিনি আর বিয়ে করেননি । শ্রীরূপা দের খবর তিনি জানেন না । রাখেন নি ইচ্ছা করে । বুকের ভিতর সেই শুন্যতা সৃষ্টি হবে ! তাঁর চেয়ে তিনি কাজ নিয়ে ভালো আছেন । চমক ভাঙলো তাঁর । স্নানে গিয়ে তাঁকে ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেরোতে হবে । অনেক কাজ ।কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে তিনি ভালো বাসেন । ছেলেগুলো এখনও ফোন করলো না । কোথায় কতদূরে ! ভোর রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি ।সাথে আছে চেনা বিশ্বাসী ড্রাইভার রাজিবুল । অস্থির হয়ে ফোন করলেন তিনি বিকাশ কে । পথে আছে ,ঠিক ঠাক আছে । যাক ! পুরুলিয়া ঢুকে গেলে চিন্তা নেই ।ম্যানেজার কে সব বলা আছে । এন্ট্রি ডেট কবে লিখবে ! স্নানে গেলেন তিনি । হালকা শীতের আমেজ । কুসুম কুসুম গরম জলে শরীর ভেজালেন তিনি । শুনতে পেলেন ফোন টা বার চারেক বাজলো ।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে পোশাক বদলে ফোন টা হাতে নিলেন তিনি । অচেনা নাম্বার । রেখে দিয়ে ধূপ ধরালেন তিনি ।পূজো টুজো তিনি করেন না । কিছুটা নাস্তিক ,তবে উগ্র না । কিন্তু ভোট ব্যাংকের জন্য মন্দির মসজিদ ঘুরতে হয় । তবে স্নান সেরে ধূপ দেখান রোজ ।গন্ধ টা খুব প্রিয় তাঁর । ছোট বেলার অভ্যাসে দরজার বাইরে দিকে ধূপ দেখিয়ে চোখ বুজে একবার হাত জোড় করেন । কপালে ঠেকান । ব্যাস ! ধূপ রেখে ওই নাম্বারে রিং ব্যাক করলেন । বহুদিন পর সমীরের গলা শুনলেন তিনি । বল কি খবর ? সমীরের নাম্বার ইচ্ছা করেই তিনি সেভ রাখেননি । মাঝে একবার দেখা হওয়া তে সমীর তাঁর নতুন নাম্বার টা নিয়েছিলেন । হয়তো সেভ আছে । শুনেছিস ? ওদিক থেকে সমীরের উৎকণ্ঠা মেশানো গলা ভেসে আসে ।কি ? দিব্যেন্দু মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন । আরে রায়না থানার কেস সমীর উত্তর দেন । হুঁ কাগজে দেখলাম । গম্ভীর স্বরে বলেন দিব্যেন্দু। তোকে রূপা ফোন করেছিল ? সমীর মিশ্র প্রশ্ন করেন । আমায় ? দিব্যেন্দু মিত্র অবাক একটু , না তো ! কেনো কি হয়েছে ? দিব্যেন্দু সোজা হয়ে উঠলেন একটু । সমীর মৃদু স্বরে বললেন কাল রাতে কে বা কারা দিয়াকে জোড় করে ... শীত আসছে , তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে যাচ্ছে ,গ্রামের রাস্তা বুঝতেই পারছিস শহরের মতো আলো নেই রাস্তায় । ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতে পাঁচটা , পাঁচটা ত্রিশ বেজে যায় ওর । সাইকেলে ফেরে ।কোনো কারণে হয়তো লেট হয়েছিল একটু আসতে কাল ! মনে হচ্ছে গ্যাং রেপ । কেস টা রায়না থানার আন্ডারে । ওকে কলকাতা নিয়ে আসা হচ্ছে । প্লিজ তোর চেনা জানা কোনো নার্সিংহোমে , যেনো সুচিকিৎসা পায় দ্যাখ !আর পুলিশ কে বল কেস টা যেনো খুব কেয়ার নেয় । রূপা এসব আমায় বলেনি কিছু আমি তোকে পার্সোনালি বলছি । আমি তো এখানে কোলকাতায় । মাসী কে ফোনে করেছিলাম শুনলাম রূপার পাগল পাগল অবস্থা দিয়ার জন্য কাল থেকে । হ্যালো! আর ইউ দেয়ার ? দিব্যেন্দু মিত্রর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না । পাথরের মত শুনছিলেন । নিজের বুকের ধুকপুক শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি । সমীরের বার কয়েক ডাকার পর সম্বিত ফিরে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন , দিয়া কি পড়ছিল জানিস ? সমীর বলেন ওতো বর্ধমান ইউনিভার্সিটি তে ইতিহাস নিয়ে এম এ করছে । তবে ইদানিং রাজনীতি করছিল খুব দাপটে । তোরই তো জিন আছে । হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্য সংস্কৃতির হারানো গৌরব নিয়ে পড়েছে খুব । ওই প্রাচীন ইতিহাস নিয়েই রিসার্চ করার ইচ্ছা তার । দারুন রেজাল্ট বি এ তে । জানি না রাজনীতির ফল কিনা ! জানিস রূপার কাছে শুনেছি দিয়া আকাশ দেখতেও খুব ভালোবাসত ,অনেক অজানা তারা , গ্রহ , উপগ্রহ বিষয়ে ওর আগ্রহ ছিল । ওর মাকে বলতো যদি সে অন্য গ্রহে চলে যায় কোনোদিন ! তুই দ্যাখ রে ! ফোন টা রেখে দিলেন দিব্যেন্দু মিত্র । ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন তিনি । এ কি হয়ে গেল ! কি করলেন তিনি ! হঠাৎ দেওয়ালে ঝোলানো একটি ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়লো তাঁর । আজকের তারিখ টা কেমন যেনো জ্বলজ্বল করে উঠলো । হ্যাঁ আজই তো ! কতদিন তিনি ভুলে থেকেছেন এই তারিখ ! মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো তাঁর ।
ভেসে উঠলো বাইশ বছর আগের একটা তারিখ । ডেলিভারি রুমের বাইরে অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন তিনি । হঠাৎ একটা কান্নার আওয়াজ । একটু পরেই সিস্টার আর ডাক্তারের হাসি মুখ । আপনার ঘরে লক্ষ্মী এসেছে । আজ তার প্রথম শুভ জন্মদিন । সিস্টার কোলে করে নিয়ে এলেন, মায়ের মতো শ্যামলা, মিষ্টি, ভীষণ আদুরে মুখখানি । মায়ের মতো কোঁকড়া চুলের বাহার ! নিঃশব্দে জল ঝরতে লাগল তাঁর গাল বেয়ে ।
দীপককে ফোন করলেন তিনি , অর্চিষ্মান গোস্বামীর নাম্বারটা দে তো!
----------------------------
জয়শ্রী ব্যানার্জী চক্রবর্তী
পূর্ব বর্ধমান