ফ্রাস্ট প্রাইজ
অদিতি ঘটক
সবাই শুয়ে পড়ার পর অর্না মোবাইলটা নিয়ে সবে বসেছে, রিন্টু শুয়ে শুয়েই বলে উঠল, "মা নেট শেষ করো না, কাল আমার ক্লাস আছে।"
অর্না পাশের ঘরে গেল সৌনক কম্পিউটার এ কাজ করছে, কি বোর্ডের টক টক আওয়াজ হচ্ছে। অর্না কে দেখে বলল, "টুসু, রিন্টু ঘুমিয়ে পড়েছে? যাচ্ছি, তুমি শুয়ে পড়। আর একটু বাকি আছে। সব কাজ গুছিয়ে রাখতে হচ্ছে তো ! ওয়ার্ক ফর্ম হোমের ঝামেলা কবে মিটবে কে জানে ! তুমি এই রাতে আবার ফোন নিয়ে বসছো নাকি ! যাও যাও ,আর রাত জেগো না। টুসু আবার কখন উঠে পড়বে ! আর ঘুম হবে না।"
অর্না বলে," সমরেশ দা কালকের মধ্যে লেখাটা পাঠিয়ে দিতে বলেছে না হলে কম্পিটিশন এ রাখতে পারবে না।"
--কাল লিখে পাঠিয়ে দিও। এখন শুতে যাও।
অর্না পেছন ফিরেও জানে সৌনক ঠোঁট বাঁকাছে, আর মনে মনে বলছে, "যত্তসব।"
সমরেশ দা কাল ফোন করে বারবার বলেছে, "অর্না কম্পিটিশন এ লেখা পাঠাও আমি তো তোমাকে জানি, এক দুই এর মধ্যে তুমি থাকবেই।তোমার গুণটা চর্চা না করে নষ্ট করো না।"
অর্না শোয়ার ঘরে আর একবার মোবাইলটা নিয়ে বসল 'কানেক্ট ইয়োর চার্জার' মেসেজ দিচ্ছে,পাওয়ার ব্যাংক সৌনকের টেবিলে--
মোবাইল রেখে দিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে কোনোমতে ডাইরি পেন খুঁজে ডাইনিং হলে এল। এল. ই.ডি. অন করে প্রথম লাইন এর কটা মাত্র শব্দ লিখে উঠতে পারল, শ্বশুর মশাই ও শাশুড়ি মা দুটো ঘর থেকে এমন নাক ডাকছেন যে তাদের দুজনের ভিন্ন ঐক্য তানে অর্নার চিন্তা সূত্র ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে অর্না শুতে চলে গেল। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে টুসু কেঁদে উঠল টুসু কে শান্ত করে অর্না কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানেও না।
পরদিন সকালে অর্না জলখাবার করছে, সুমি পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল, আব্দারি গলায় শুরু করল বৌদি এই লেখাটা একটু দেখে দাও না! কলেজ এবার অন লাইন ম্যাগাজিন বার করবে। অর্নার তখন দম ফেলবার অবকাশ নেই , পুজো করে এসেই শাশুড়ি চা চাইবেন, কাপটা নামিয়ে রাখার সাথে সাথে জলখাবার, শ্বশুর মশাই বাজার থেকে চলে আসবেন, হাত পা ধুয়ে বসবেন খাবার টেবিলে, সৌনকের অফিস শুরু হয়ে যাবে, রিন্টুর ক্লাস,টুসু উঠবার আগে সব গুছিয়ে নিতে হবে। এখন তো সবই ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে। আগে তবু একটু ফুরসৎ পাওয়া যেত। সৌনক, রিন্টু বেরিয়ে গেলে শ্বশুর মশাই ও জল খাবার খেয়ে হয় বন্ধুর বাড়ি না হলে চায়ের দোকান নতুবা কোনো ছুতো নাতায় ঘুরে বেরিয়ে আসতেন। শাশুড়ি, বৌমা মিলে কাজ হয়ে যাবার পর একটু সময় পাওয়া যেত। এখন বাজার না গেলে নয় তাই।
সুমি ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে, এই মেয়েটাও তেমন, কলেজ কবে খুলবে কে জানে ! অর্না মুখে বলল, দুপুরে দেখে দেব, দাঁড়া কাজগুলো তাড়াতাড়ি সেরে নিই। সুমি খাতাটা মায়ের ঘরে রেখে এসে অর্নাকে অবাক করে দিয়ে তরকারি কাটতে বসল। অর্না হাঁ হাঁ করে উঠল। তুই পারবি না। উঠে পড়। এক্ষুনি হাত কেটে ফেলবি। শাশুড়ি পুজো সেরে রান্না ঘরে এসে ভূত দেখার মত চমকে উঠেন। বলেই ফেললেন, "ব্বাবা আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছে ! যে নবাব নন্দিনী এত সকালে বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরে ! ক্ষিদে পেয়ে গেছে নাকি!
--না মা আজ সকালে ক্লাস নেই। সেই ১১.৩০ টায় একটা আর ২.১৫ আর একটা ব্যাস। অন্য ক্লাসগুলো হবে না। তাই একটু--
--তাও ভালো। ঘরের কাজকম্ম জানা দরকার। তোমার দাদাও রান্না করতে জানে। আমায় একটু চা দাও।
সব পাট মিটে যাবার পর অর্না সবে বিছানায় গা টা এলিয়েছে। সুমি খাতা নিয়ে হাজির।
--বৌদি লেখাটা দেখে দাও না।
অর্না পড়ে দেখে কিচ্ছু হয়নি।
বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে, এত আগ্রহ নিয়ে মেয়েটা এসছে, অর্না বলল এখন তো তিনটে কুড়ি বাজে। তোর কি মোবাইল দরকার ? না হলে আমি এখানেই লিখে দিচ্ছি। অর্না 'সমরেশদা' কে যে লেখাটা পাঠাবে ভেবেছিল সেটাই সুমির মোবাইল এ লিখে দিল। এই করতে করতে প্রায় সাড়ে ছটা বেজে গেল। কারণ এরই মধ্যে টুসুকে ফলের রস খায়ানো, রিন্টুর আব্দার, ঘরের টুকিটাকি কাজ এইসবও সারতে হয়েছে। অর্না মোবাইলটা দেওয়ার জন্য সুমিকে ডাকতে গিয়ে দেখে সুমি রান্নাঘরে সবার জন্য চা করছে। আজ সুমি চমকে দিচ্ছে একেবারে !
সমরেশদা কে অর্নার আর লেখা পাঠানো হয়নি। নতুন একটা লেখা খানিকটা লেখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু রিন্টুর টিউশন থাকার কারণে অর্না ফোন পায়নি। পেলেও কমপ্লিট করতে পারত না।
প্রায় আড়াই মাস কেটে গেছে সুমি সেদিনের পর আর রান্নাঘর মুখো হয়নি। অর্থাৎ সবই আগের মত চলছে মানে মার্চের পর থেকে নব্য সাধারণ যে রুটিন তাই চলছে। হঠাৎ আজ দুপুরে সুমি, "ই --য়ে, ই--য়ে," চিৎকারে সবার রবিবারের দুপুরের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে।
ব্যাপার টা কি হয়েছে জানার জন্য রিন্টু দৌড়ে গেল। প্রাইজ ,প্রাইজ, ফ্রাস্ট প্রাইজ বলে সুমি পুরো লাফাচ্ছে। সৌনক বেরিয়ে এলো, "কি উল্টো পাল্টা অনলাইন খেলা খেলছিস আমায় জিগ্গেস না করে।" "না রে দাদা, গল্প লিখে প্রাইজ।
---বৌদি--,বৌ--দি এসো না ! "
অর্না টুসুকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। টুসু চিৎকারে কেমন হকচকিয়ে গেছে। অবাক হয়ে সবার দিকে দেখছে। সুমি অর্নাকে মোবাইলে হোয়াটসআ্যাপ মেসেজটা দেখাতেই অর্না ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। সুমির দিকে অবাক হয়ে চেয়ে, চোখ ভর্তি জল।
সৌনক ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে মোবাইলটা নিয়ে দেখে, অর্নার দিকে চেয়ে রইল। বয়স্ক মানুষ দুটো অস্থির হয়ে বলে উঠলেন, "কি হয়েছে বলবি ?" সুমিই খোলসা করল-- "বৌদি গল্প লিখে ফ্রাস্টক প্রাইজ পেয়েছে। প্রায় আড়াই মাস আগে এক ভদ্রলোক বৌদিকে এক জায়গায় লেখা দেওয়ার জন্য বলেছিলেন কিন্তু বৌদি সব কাজ করে কিছুতেই সময় বার করতে পারছিল না। বৌদি তো লেখা দেবেই না ঠিক করে ফেলেছিল। তখনই আমার মাথায় আইডিয়াটা আসে। আমার কলেজ ম্যাগাজিনের জন্য বৌদি ওত কাজের মধ্যেও আমাকে গল্প লিখে দিয়েছিল। আমি তার আগেই বৌদির মোবাইল থেকে সমরেশ বাবুর নম্বর নিয়ে তাকেই লেখাটা পাঠিয়ে দিই আমার নাম্বার থেকে। হ্যাঁ নামটা অবশ্যই বৌদির।
এবার আমাদের সকলের উচিত বৌদির এই দক্ষতা কে শান দেওয়ার জন্য সহযোগিতা করা।"
রিন্টু বলে ওঠে, "আর পার্টি ?"
সৌনক কিছু বলবার আগেই সৌনকের বাবা সন্দীপ বাবু বলেন, "আজ রাতেই।"
#######################
অদিতি ঘটক
চুঁচুড়া, হুগলি