ছবিঋণ- ইন্টারনেট
দু'দিন আগে ফোনটা এসেছিল। ছোটকার বাড়াবাড়ি অবস্থা। আজ রবিবার, সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। দমদম স্টেশনে নেমে রিক্সায় উঠে বললাম," কালীন্দি"। রিক্সাওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "কালীন্দি কোথায়?
"মানে" !
"আরে বাবু, কালীন্দি তো অনেক বড় জায়গা। ঠিক কোথায় যাবেন" ? রিক্সাওয়ালা ভদ্রলোক বাঙালি। আমার দিকে কেমন রহস্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সত্যিই তো ঠিক কোথায় নামব ! ছোটকাকীমাকে বরং ফোন করে জেনে নিই। বছর তিনেক আগে এসেছিলাম। আর এদিকে আসা হয়ে ওঠেনি। ফোনেই খবরাখবর আদান প্রদান হয়। কী যেন ক্লাবটার নাম বলেছিল ঠিক মনে করতে পারছি না। পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা পেলাম না। হাতে ব্যাগ নেই যে ব্যাগ হাতড়ে দেখব। ফোনটা টেবিলে রেখেছিলাম। আসার সময় তাড়াহুড়োয় নিতে মনে নেই। রিক্সাটা মানুষজন কাটিয়ে বড় রাস্তা ছাড়িয়ে একটা গলির মধ্য ঢুকেছে। ভাল গেরোয় পড়েছি ! বেআক্কেলের মত কাজ করেছি। কোথায় যে নামব --সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। নিজের দুর্বলতা সব জায়গায় প্রকাশ করা যায় না। বেশ গম্ভীর হয়ে প্রত্যয়ের সঙ্গে বললাম, "কালীন্দিমোড়।" রিক্সাওয়ালা ভদ্রলোক আবার আমার দিকে পিছন ফিরে তাকাল। বলল, "কালীন্দি এলাকায় ঢুকে গ্যাছি বাবু।"
একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে রিক্সাটা থামল। কথা না বাড়িয়ে নেমে পড়লাম। আমার মনে আছে, কালীন্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে সিধে পুব দিকে দশমিনিটের হাঁটা রাস্তা ছোটকার ফ্ল্যাট। বাসস্ট্যান্ডটা পেয়ে গেলে আর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। একজন পথচলতি মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম । বলল, বামদিকে পাঁচমিনিটের রাস্তা বাসস্ট্যান্ড। বাসস্ট্যান্ডে এসে কিছুই চিনতে পারছি না। সব কেমন অপরিচিত লাগছে। কী অদ্ভুত পরিবর্তন ! রাস্তাগুলো বেশ চওড়া হয়েছে। দোকানপাট বেশ সাজানো গোছানো। একজনকে জিজ্ঞেস করে পুবদিকের রাস্তা ধরলাম। হাঁটছি তো হাঁটছি পথ যেন শেষ হচ্ছে না। সব অলিগলি একই রকম লাগছে। রাস্তার দু'ধারে চার-পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি মাথার উপর হুমড়ি খেয়ে এসে পড়েছে যেন। কেবল, ইলেকট্রিক, টেলিফোন কতরকমের তার মাথার উপর দলা পাকিয়ে ঝুলছে। ঘিঞ্জি এলাকা। উন্নততর বস্তিবাড়ি। কিছুই চিনে উঠতে পারছি না। প্রাণপণ স্মৃতি হাতড়ে মনে করার চেষ্টা করছি। সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় একটাও টেলিফোন বুথ চোখে পড়ল না। সবার পকেটে ফোন থাকলে টেলিফোন বুথের আর অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। একটা জেরক্সের দোকানে ঢুকলাম। বললাম, "দাদা, এখান থেকে ফোন করা যাবে ! দোকানদার লোকটা হাঁ পেতে আমায় দেখছে। যেন দিনদুপুরে ভূত দেখছে। বলল, "না দাদা, সে কবেই উঠে গেছে।" বাড়িতে একটা ফোন করে ছোটকার বাড়ির ঠিকানাটা জানতে হবে। কিন্তু কীভাবে ফোন করব ! সবসময় টাকা পকেটে থাকলে সব কাজ উদ্ধার হয় না। কথাটার অর্থ এখন ভালমত বুঝতে পারছি।
সামনে একটা দোতলা বাড়ি। ফ্ল্যাটবাড়ির জঙ্গলে এখনোও টিম টিম করে টিকে আছে। সামনে বেশ বড় লন। লনজুড়ে নানান রকমের ফুলের গাছ। বেশ সাজানো গোছানো বাড়ি। দেখলে মনটা উদাস হয়ে যায়। চড়া রোদে হাঁটতে হাঁটতে ঘামে ভিজে গ্যাছি। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর। একটা জেদ চেপে গেল। সহজেই বাড়ি ফিরব না। ছোটকার সঙ্গে দেখা করেই তবে ফিরব। লনে দাঁড়িয়ে একজন ভদ্রমহিলা কাকে যেন ফোন করছেন। গোলগাল ভারী চেহেরা। দুগ্গাঠাকুরের মত পানপাতা মুখ। টানা টানা চোখ। গভীর চোখ দু'টো কেমন যেন উদাসী। চেহেরায় শিক্ষা ও আভিজাত্য যেন উপচে পড়ছে। দেখলে সম্ভ্রম জাগে। হঠাৎ মনে হল, ভদ্রমহিলাকে বলে বাড়িতে একটা ফোন করলে হয়। একবার বলেই দেখি না কেন ! বিপদে পড়লে মানসম্মান অহংবোধ সব ধুয়ে মুছে যায়। একবার রিকোয়েস্ট করেই দেখি। কাছে গিয়ে বললাম, "এক্সকিউজ মি, আপনার ফোন থেকে একটা ফোন করা যাবে ! --আসলে আমার ফোনটা বাড়িতে ফেলে এসেছি। ভদ্রমহিলা অবাক বিস্ময়ে আমাকে দেখছেন। আজকাল কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। কতরকম ঠগ-জোচ্চোর কতরকম ফাঁদ পেতে আছে তার হিসেব নেই। অকারণ ঝামেলায় কেই বা জড়াবে ! ভদ্রমহিলা আমাকে দেখছেন। হয়তো জরিপ করছেন। বললেন, "নম্বরটা বলুন, ধরিয়ে দিচ্ছি।" হাতে চাঁদ পেলাম যেন। নম্বরটা বললাম। বাড়িতে কথা বলে বুঝলাম, আমি ছোটকার বাড়ির আশেপাশে ঘুরে মরছি। হঠাৎ স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেল যেন। এতক্ষণ যে জায়গাটা অপরিচিত লাগছিল কেমন যেন সব চেনা জানা হয়ে ধরা দিল। কাকার বাড়ির গলিটা চিনতে পারলাম।
ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসছি, ভদ্রমহিলা পিছন থেকে ডাকলেন। কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। কিছু সন্দেহ করে বসলেন নাকি !
"আপনার গ্ৰামের বাড়ি কি সুন্দরবনে ?"
ফোন ফেলে এসে গাঁইয়া লোকের মত কাজ করেছি বটে ! তবে সত্যি সত্যি আমার গ্ৰামের বাড়ি সুন্দরবনে। কিন্তু ভদ্রমহিলা জানলেন কীভাবে ! বললাম, "হ্যাঁ।"
"আপনি অতনু তো !"
আরো তাজ্জব বনে গিয়ে উত্তর দিলাম, "হ্যাঁ।" আশ্চর্য হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছি, ভদ্রমহিলা আমায় ভিতরে এসে বসতে বললেন। অনুরোধ হোক বা আদেশ সে কথায় বেশ আন্তরিকতা ছিল। সুরেলা মিষ্টিস্বরে আবিষ্ট হয়ে বারান্দায় সুসজ্জিত সোফাটায় গিয়ে বসলাম। কোমরটা টনটন করে উঠল। একটু বসতে চাইছিলাম যেন। ভয়ে ভয়ে জড়সড় মেরে আছি। একজন অপরিচিত মহিলার ফোনে ফোন করার জন্য হয়তো ভালমত জ্ঞান বিতরণ করবেন। কপাল মন্দ হলে তিরস্কারও জুটতে পারে।
"আপনি বসুন আমি চা করে আনছি।" ভদ্রমহিলা দ্রুত ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে গেলেন। এবার ভয়টা আরো গাঢ় হল। নির্ঘাত কপালে দুর্দশা আছে। পালিয়ে গেলে বাঁচি। পালাব না বসে থাকব, কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না।
ভদ্রমহিলা চা-বিস্কিট নিয়ে এলেন। সোফার অপর প্রান্তে সোজা হয়ে বসলেন। কম বয়সে সুন্দরীই ছিলেন। দেহের বাড়তি মেদ সৌন্দর্য হরণ করে নিয়েছে। এখনোও পলকে সুন্দরী লাগে।
"আমাকে চিনতে পারছেন ?"
মনে মনে ভাবলাম, থানার বড় দারোগা। মুখে বললাম, "---ঠিক চিনতে পারছি না।"
"আমি অরুণা। ক্লাস টেনে একসঙ্গে পড়তাম। মনে পড়ছে !"
বুকের ঠিক মাঝখানে ছ্যাঁকা খেলাম যেন। বুকটা ধড়াস করে লাফিয়ে উঠল। হাপরের মত পাঁজরটা ওঠা নামা করছে। ক্লাস টেন মেজকাকার বাড়িতে থেকে পড়েছি। ওখান থেকেই মাধ্যমিক পাশ। অরুণা ক্লাসের ফার্স্টগার্ল। স্কুলসেক্রেটারির মেয়ে। স্কুলের ড্রিমগার্ল। রোগা ছিপছিপে বুদ্ধিদীপ্ত চেহেরার অসাধারণ সুন্দরী। আমার সদ্য যৌবনের আলোড়ন তোলা একতরফা প্রেম। আমার রাতের স্বপ্ন। দিনের প্রতীক্ষা। আমি টেস্টে ফার্স্ট হয়ে অরুণার সম্ভ্রম আদায় করেছিলাম। লুকিয়ে চুরিয়ে, সামনা সামনি ওকে দেখতাম। গভীর ভালবাসার দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আনমনে কথা বলে যেতাম উদ্দেশ্যহীন। অরুণা আমাকে পছন্দ করত। ভালবাসত কিনা জানি না। আমিও কোনোদিন ভালবাসার কথা ওকে বলতে পারিনি। স্কুল ছাড়ার সময় পদ্মপুকুরের মত আমার দু'চোখ টল টল। আজ এখনোও অরুণা আমার প্রেম। সেই বেনী দুলানো ছিপছিপে সুন্দরী। আমার গোপন প্রেম। আমার গোপন ভাললাগা।
সেই অরুণা আর এই অরুণা ! আকাশ পাতাল ফারাক ! এই অরুণাকে আমি দেখতে চাইনি। প্রায় তিরিশ বছর পর দেখা। মেয়েদের শরীরে কত পরিবর্তন হয় ! সে তুলনায় ছেলেদের চেহেরায় তেমন পরিবর্তন হয় না।
আমি হাঁ পেতে অরুণাকে দেখছি। অরুণাও আমাকে দেখছে। অজস্র কথা ভিড় করে এসে গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। মুখ ফুটে কিছুই বের হচ্ছে না। সামনে বসে থাকা মুটিয়ে যাওয়া অরুণাকে আমি দেখছি না। আমার সেই নবযৌবনের অরুণাকে দেখছি। সেই গভীর উদাসী টানা চোখ। সেই লুকিয়ে দেখা একফালি অনিন্দ্যসুন্দর মুখ। সেই চঞ্চল মেধাবী ছাত্রী। সেই ভুবনভোলানো হাসি।
আমি সেই ক্লাস টেনের অতনু। আমার স্বপ্নের রানী আমার চোখের সামনে বসে। এত কাছে অরুণাকে কোনোদিন পাইনি। আমি সেই না বলা কথাই বলব। বুকের মধ্যে আগলে রাখা কথাই বলব। আমার স্বপ্নের লালিত কথা বলব। আমি অস্ফুটে বললাম, "আই লাভ য়্যু অরুণা।"
মাথার উপর সাঁই সাঁই করে সিলিংফ্যান ঘুরছে। আমি সেই ফ্যানের শোঁ শোঁ আওয়াজ ছাড়া কিছুই শুনতে পেলাম না।
---------------------------
বিকাশ বর
9, M, Roy para byelane
Sinthee, Kolkata- 50.
প্রথম প্রেমে এমন কত কথা না বলা থেকে যায়! সার্থক নামকরণ আর সুন্দর নিটোল এক খানা গল্প।
উত্তরমুছুন