ছোটগল্প।। জীবন বর্ণহীন নয়।। চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়
সন্ধ্যার পর থেকে তির তির করে শিশির পড়তে শুরু করেছে। শীতের চাদরে যেন চার-পাশটা ঢেকে রয়েছে। এই নিস্তব্ধতা প্রতিমুহূর্তে গ্রাস করে চিত্রাকে। আজ বাড়িতে একদম একা চিত্রা। কাজের মেয়েটা দুই দিনের জন্যে তার বাড়ি গেছে। ও থাকলে আবার বকে বকে মাথা ধরিয়ে দেয় চিত্রার। আর না থাকলে একাকীত্ব এসে জাপ্টে ধরে চিত্রাকে। ছেলেটা কাজের সূত্রে জামশেদপুরে থাকে। কত সাধ ছিল নাতনিকে নিয়ে সময় কাটানোর ওর সাথে খুনসুটি করে বাকি দিনগুলো পার করার। কিন্তু সে আর হলো কই!!চিত্রা গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বড় শখের ফায়ারপ্লেসটাতে আগুন দিল। মিউজিক সিস্টেমে লো ভলিউমে গান চালিয়ে দিল। গান চলছে-
"আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে
আসবে যদি শূন্য হাতে"
চিত্রার খুব পছন্দের গান এটা। এর সাথে জড়িয়ে আছে কত নস্টালজিয়া। এটাই ওর কলেজ সোশ্যাল এর প্রথম গান গাওয়া। টেনসনের চোটে মাঝখানে গানটা ভুলে গিয়ে সে যে কি যা-তা অবস্থা হয়েছিল , সেদিন বিজন এসে যদি ওর আধভোলা গান টা না ধরত কি যে হতো কে জানে। সেই থেকেই ওদের মধ্যে একটা আলাদা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। বিজন ওর থেকে এক বছরের সিনিয়র ছিল। কলেজ ব্রেকে ওদের দুজনকেই সবসময় একসঙ্গে দেখা যেত। বন্ধুরাও বলত কুছ তো হ্যায়!! ওরা এসব কথার গুরুত্ব দিত না।
আড়ালে আবডালে একটু করে চিত্রাকে দেখা বিজন ধীরে ধীরে কিভাবে ওর হৃদয়ের কাছাকাছি চলে আসতে লাগলো তা সে নিজেই কোনদিন টের পায়নি। চিত্রারও ওকে খুব ভালো লাগতো। পথে যেতে যেতে কখনো হালকা হাতের স্পর্শ দু'জনকেই বেশ শিহরিত করত। তখন কলেজের গণ্ডি সবে শেষ হয়েছে বিজনের। অত্যন্ত মধ্যবিত্ত ছাপোষা পরিবারের ছেলে সে। উচ্চশিক্ষা করার মত সচ্ছল তাদের পরিবার ছিল না। তাই বিজন কিছু টিউশন করতো আর সাথে সরকারি চাকরির প্রিপারেশন নিতে শুরু করলো।
টিউশন থেকে ফেরার পথে ইচ্ছে করেই প্রতিদিন ওদের দুজনের মধ্যে দেখা হতো। সেই আলের ধারে বসে থালার মত চাঁদ আর তারাদের সাক্ষী রেখে ওদের মধ্যে বাক্য বিনিময় হত। ওই চাঁদের আলোয় চিত্রাকে আরো মোহময়ী লাগত। দুদিকে দুটো লক্স ওর গাল গুলো ছুঁয়ে থাকতো। কপালে ছোট্ট একটা টিপ। ছিপছিপে গড়ন, আর মায়া ভরা চোখ। বিজন মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করে ফুঁ দিয়ে ওর লক্স উড়িয়ে দিতো আবার কখনো বা দোদুল্যমান কোমর অব্দি মোটা বেনী ধরে এক ঝটকায় নিজের কাছে নিয়ে আসতো। তারপর ওর ঠোঁট ধীরে ধীরে চিত্রার কপাল ছুঁতো। গাল বেয়ে নরম তুলতুলে ঠোঁটে এসে থামত। চারিদিকে জোসনা ভরা সুন্দর কোমল এবং শীতল পরিবেশ ওদের মাঝে বেশ উষ্ণতার সৃষ্টি করত।
চিত্রা জানতো না বাড়িতে বিয়ের জন্য দেখাশোনা চলছে। চিত্রার এ বিষয়ে মৃদু আপত্তি থাকলেও তেমন কিছু বলতে পারে না কারণ বিজন এর দিক থেকে কোনো রকম ওদের সম্পর্ক নিয়ে পজিটিভ কিছু শুনেনি। একি তাদের মধ্যে শুধুই শরীরী আকর্ষণ নাকি ভালোবাসা তা বুঝতে পারেনা চিত্রা। চাকরি-বাকরি এখন পায়নি। তাই বাড়িতেও কিছু বলতে পারেনা। বিয়ের দিন নীলার হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল বিজন। তাতে লেখা ছিল
"এতটুকু ভরসা ছিল না আমার উপর? ভালো থেকো চিত্রা।"
দমকা হাওয়ায় পাখির নীড় ভেঙ্গে গেলে যেমন হয় ওর জীবনটাও যেন ক্ষণিকের মধ্যে এলোমেলো হয়ে গেল। চিত্রা সুখের পথে বিজন আর আসেনি। একেবারে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ছিল। ভেবেছিল যাবার আগে একবার হয়তো দেখা হবে দুজনের মধ্যে কিন্তু ভুল ভেবেছিলে কোথায় যে হারিয়ে গেছিল বিজন!!
চিত্রার বিয়ের পর ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডান হাতটা প্যারালাইসিস হয়ে গেছিল। মাঝে মাঝে বাবাকে দেখতে আসতো। বছরে এক পর ওর বাবা ওকে ফোন করে জয়দীপের কথা বলে ফেলে। সমস্ত রকম ভাবে আর্থিক সাহায্য করে জয়দীপ ওর বাবাকে সুস্থ করে তুলেছে। সেদিন আর চিত্রা চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। ওদের মধ্যে এতদিন ধরে যে ব্যবধান ছিল তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল চিত্রা। এক পশলা বৃষ্টির মতো বিজন ঝরে গিয়ে পরিষ্কার ঝকঝকে তরুলতার মত ঘিরে ছিল জয়দীপ। নতুন জীবন শুরু করেছিল চিত্রা। এরপর ও আর পিছনে ফিরে তাকায় নি। চিন্তায় কখনো আসেনি বিজন।
কাল জয়দীপের প্রয়াণ দিবস। বাড়িতে কেউ নেই। আচ্ছা ছেলেটার কি মনে আছে কাল এমনি দিনেই তার বাবা সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বারোটা বেজে কুড়ি মিনিট। ইস! অনেক দেরি হয়ে গেছে. এত রাতে ডিনার করলে ওর শরীরটা খারাপ করে। তাই ডিনার না করেই চিত্রা শুয়ে পড়ে। ঠিক করে কাল সে নিজেই যাবে একটা মালা কিনতে জয়দীপের জন্য।
সকাল হবার আগেই উঠে পড়েছে চিত্রা। টেবিলে সাজিয়ে রাখা জয়দীপের ছবিতে নরম সূর্যের আলো এসে যেন স্নান করিয়ে যাচ্ছে।। চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা চিত্রা। হাই প্রেসারের রোগী চিত্রা তাই ডাক্তার ওকে বাইরে যেতে না করেছে একা একা কিন্তু আজ ডাক্তারের কোনো বারণ শুনবে না চিত্রা। একহাতে পার্সটা নিয়ে কোনরকমে দরজার কাছে এলো। দরজাটা খুলে চিত্রা জুতো পড়ছে এমন সময় পেছন থেকে কে যেন বলে ওঠে ---কোথায় যাচ্ছো মা?
-----শুভ তুই!
-----কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বল?
-----আজকের দিনে অন্তত আমি যে বাড়ি ফিরব সেটা তোমার ভাবা উচিত ছিল মা। আজ যে বাবার মৃত্যু দিন। তবে আর কোনদিন তোমায় ছেড়ে অন্য কোথাও যাবো না। আমার অফিস কলকাতায় পোস্টিং হয়ে গেছে।
-----আম্মা আম্মা এবার চলো না। আমার যে খুব ক্ষিদে পেয়েছে।মা তোমার প্রিয় পনির স্যান্ডুইচ বানিয়েছে।
-------ছাড়ো ছাড়ো দিদিভাই। টানাটানি করলে পড়ে যাবো যে। বুড়ো হয়ে গেছি তো। চলো চলো আজ আমরা সবাই মিলে একসাথে খুব মজা করবো। আজ আমি খুব খুশি।
--------------------------
লিখেছেন- চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়
640 Jawpur Road
kol - 74