হাওয়ার দোলায় কাশফুল নেচে নেচে বলছে .. 'আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে' .. শরতের আকাশে আগমনী সুর পৃথিবী ছাপিয়ে কৈলাশে গিয়ে কড়া নাড়ছে প্রতিনিয়ত .. পূজো আসতে তখনও কিছুদিন দেরি .. হঠাৎ মা দূর্গার যে কী খেয়াল হলো.. কার্ত্তিককে ডেকে বললো, 'আমাকে একবার পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়ে আসবি? একবার ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে পৃথিবীর লোকজন সত্যিই কি অপেক্ষা করে আমাদের জন্য? পূজোর সময় তো প্যান্ডেলেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঠাঁই.. দেখার সুযোগ হয় না।'
মায়ের কথা মতো কার্ত্তিক ময়ূরে চাপিয়ে মা দূর্গাকে নামিয়ে দিয়ে গেল বাংলার এক কোনে। মা একা একা কিছুক্ষণ মাঠে ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে ঢুকে পড়লেন বাংলার এক শহরাঞ্চলে। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য .. সবাই ব্যস্ত .. কেউ কারো দিকে নজরই দিচ্ছে না। এক জায়গায় কয়েকজন খবরের কাগজ হাতে কি সব বলাবলি করছে, -- 'পূজো মানে তো চাঁদার জুলুমবাজি.. যত সব বুজরুকি খেয়াল .. ভক্তি-টক্তি চুলোয় গেছে.. থিমের টানে মানুষ টানার প্রচেষ্টা চলছে। পূজো কি গরিবদের জন্য ? পূজো বড়োলোকদের খেয়ালখুশি.. আর কিছু বখাটে ছেলেদের আড্ডার জায়গা .. মদ মাংস এগুলোই এখন পূজোর আসল প্রসাদ ..! চিন্ময়ী দূর্গাকে ছেড়ে মৃন্ময়ীর প্রতি অকারনে টাকা ধ্বংস! গরিব মানুষ খেতে পাচ্ছে না আর ওদিকে পূজোর নামে কোটি কোটি টাকা নষ্ট। ঘরের নারীর প্রতি অবহেলা, অত্যাচার আর মাটির পুতুলকে জাঁকজমক সহকারে সিংহাসনে বসিয়ে পূজা.. এসব কুসংস্কার নয় তো কী ?'
মা দুর্গার মন খারাপ করতে লাগলো .. এসব কী শুনছে? মানুষ এতো কষ্টে আছে আর পূজোর আয়োজন মানে সময় ও অর্থনষ্ট !
আনমনা ভাবে তিনি কুমোরটুলিতে ঢুকে পড়েছেন ততক্ষণে.. সেখানেও চরম ব্যস্ততা.. কাজের ফাঁকে একজনকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো, -- আচ্ছা, তোমরা অকারনে প্রতিমা গড়ে সময় ও পরিশ্রম নষ্ট করছো কেন?
-- কী যে বলো? কাজ না করলে খাবো কী? সারা বছর তো ছোটোখাটো ঠাকুর বানাই .. দুর্গোপুজোতেই আমাদের আয়.. পূজোর মরশুমে প্রতিমা বানিয়ে যা আয় হয় তাতে বছরের অর্ধেক চলে যায়.. বাকি সময়টা খুচরো কাজ করি। এই দিনগুলোর জন্যই তো অপেক্ষা করে থাকি মা !
মা দূর্গা কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে কিছুদূর হাঁটতেই সামনে একটা ছোট্ট বাড়ি .. সেখানে উঁকি ঝুঁকি মারতেই দেখে মাঝবয়সী দুই বোন প্রতিমার সাজ তৈরিতে ব্যস্ত।
--- কি গো, কি করছো তোমরা ?
--- দেখছো তো, ব্যস্ত আছি .. এখন পূজোর কাজ চলছে .. কথা বলার সময় নাই..
--- এগুলো করে তোমাদের কী লাভ ?
--- কী যে বলো? সারা বছর অপেক্ষায় থাকি এই সময়টার জন্য .. অনেক বেশি কাজের অর্ডার পেয়ে যায় ..আয় বাড়ে , খাটনি বাড়ে.. এখন শোলার খুব দাম গো , মাকে আর 'ডাকের সাজে' সাজাতে পারি না .. রাংতা, জরি, চুমকি.. এগুলো দিয়েই সাজাই।
মা দূর্গা খুশি মনে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলো বড় রাস্তার ওপর .. ভীষণ ভিড় .. আলো ঝলমলে বিশাল বিশাল দোকান মানে যাদের চলতি নাম 'শপিং মল'। সবাই ব্যস্ত, কেউ কিনছে .. কেউ নেড়ে চেড়ে দেখছে, কেউ বেচছে।
সেলসম্যানদের কয়েকজন পাশের একটি দোকানে চা খেতে এসেছে কাজের অবসরে ..
মা দূর্গা তাদের দিকে এগিয়ে গেল.. শুনতে পেল..ওরা বলাবলি করছে ..
--- "পূজো আসে তাই মাস দুয়েক ভালো বিক্রি হয়। গ্রামের ও শহরের অনেক বেকার ছেলেমেয়ে কাজ পেয়ে যায় .. হোক অস্থায়ী তবু তো কাজ করি বলে লোকে মর্যাদা দেয় .. নইলে সারা বছর বেকার বসে থাকি .. এখানে ওখানে কাজের জন্য ছুটতে হয়।"
শহরের ব্যস্ততায় হাফ ধরে গেছে .. মা দূর্গা শহর ছাড়িয়ে একটা পুকুরের ধারে এসে বসলো। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে মন ভরে যাচ্ছে। মৃদু বাতাসে কাশের হিল্লোল .. পাখির ডাক, ফুলের সৌরভ, মেঘেদের ছুটোছুটি, চারিদিকে মন কাড়া দৃশ্য। পদ্মফুলে ভরে আছে পুকুরটি, একটি ছোট ডিঙি করে দুজন পদ্মফুল তুলতে ব্যস্ত ..
--- ফুল তুলছো কেন তোমরা ?
--- মা আসছে যে গো ! কত ফুল লাগবে মায়ের পুজোয়, তাছাড়া, সন্ধিপূজোর জন্যও একশো আটটা করে ফুলের আলাদা আলাদা আঁটি বাঁধতে হবে .. অনেক কাজ এখন .. এখন থেকে ফুলগুলি তুলে কুলহাউসে রেখে দেব, তবেই না পূজোর সময় বিক্রি করতে পারবো .. ভালো আয়ের সুযোগ .. এই সময় ফুলের চাহিদা বাড়ে .. তাই কাজ বাড়ে নইলে বছরের অন্য দিনগুলো কাজের আশায় বাইরে চলে যেতে হয়।
মা দূর্গা মুচকি হাসলেন।
কী মনে হলো, মা দূর্গা তাদের পিছু পিছু তাদের গ্রামে চলে এলেন .. দুদিন নিরিবিলিতে থাকবেন বলে।
কিন্তু গ্রামেও সবাই ব্যস্ত .. কেউ ঘরদোর পরিষ্কার করছে .. কেউ মুড়ি চিড়া খৈ ভাজছে.. কেউ মুড়কি বানাচ্ছে, নাড়ু মোয়া বানাচ্ছে..
--- কি করছো তোমরা ? নাড়ু বানাচ্ছ ? বাড়ির ছেলেপুলেদের জন্য বুঝি ?
--- নাগো, এখন এগুলো আমাদের ব্যবসা গো। পূজো আসছে তো.. কাজ বেড়েছে, নাড়ু খৈ মুড়কি .. সব বাজারের অর্ডার .. সাপ্লাই দিতে হবে গো ? পূজা-পার্বনে কাজ একটু বেশি পাওয়া যায়, একটু বাড়তি লাভের মুখ দেখি।
কোথাও মাটির ঘট প্রদীপ সরা বানাচ্ছে কুমোরেরা, কোথাও বাঁশ কেটে ডালি ডালা কুলো বানানোর কাজ চলছে .. ঢাকিরা দূরে দূরে গিয়ে পূজোর কাজ ধরছে, দরিদ্র কর্মঠ পুরুষেরা শহরে গিয়ে দিন রাত্রির পরিশ্রম করছে .. প্যান্ডেল তৈরী, মণ্ডপ সজ্জা, আলোক সজ্জা ইত্যাদি নানান কাজের জন্য পূজোর মরশুমে সবার একটা বাড়তি আয়ের সুযোগ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এভাবেই আনন্দ উৎসবের ভাগীদার হয়ে ওঠে ...!
পর্ব - ২
শরতের আকাশে মেঘেদের আনাগোনা .. প্রায় বৃষ্টি হচ্ছে.. নদী ভরে উপচে পড়ছে জল.. এখানে ওখানে বন্যা .. ঘরছাড়া মানুষ আশ্রয়ের খোঁজে দিকহারা.. প্রকৃতির শক্তির ওপর কারো জোর খাটে না।
মা দূর্গাও মানুষের দুঃখ দেখে মনোকষ্টে আছে, এবছর দেবীর ঘোটকে আগমন .. সুতরাং ছোট খাটো অঘটনতো ঘটবেই তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
উদাসচিত্তে মা দূর্গা এসে পড়েছেন অন্য একটি শহরে। এখানেও সেই ব্যস্ততা .. সবার মুখে একই কথা .. পূজো আসছে .. মা আসছেন! হাতে গোনা আর কটা দিন ! অকাল বর্ষণ সবার কাজে বাধা সৃষ্টি করছে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে .. সারাদিনের ক্লান্ত মা দূর্গা রাত কাটানোর আশ্রয়ের খোঁজে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, সামনে সার সার বড় বড় বাড়ি.. লোকজন নজরে আসছে না .. একটি বাড়ির সামনে দারোয়ান পাহারারত। মা দূর্গা ভাবলেন, এই বাড়িতেই আশ্রয় নেবেন.. কিন্তু কাছে যেতেই কেয়ারটেকার টাইপের লোকটি বলে উঠলো,
--- বাড়িতে কেউই নেই, সবাই কলকাতা গেছে.. অতএব ফাঁকা বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেওয়া নিষেধ।
--- কলকাতা! সেখানে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে ..
--- না না, সেখানে ওদের নিজেদের ফ্ল্যাট রয়েছে, ছোটমেয়ে সেখানে পড়াশুনা করে .. ওরা গেছে পূজোর শপিং করতে ..
--- কবে ফিরবে ?
--- এখন ফিরবে না গো .. একেবারে পূজোর পর ফিরবে ..
--- পাশের বাড়িতে ?
--- সেখানেও কেউ নেই .. তারা তাদের ছেলের কাছে বিদেশে গেছে .. মাস তিনেক পরে ফিরবে ..তার পাশের বাড়িতেও কেউ নেই .. তারা তাদের শান্তিনিকেতনের ফ্ল্যাটে গেছে কাশফুলের শোভা দেখতে.. প্রতি বছর শরৎ আর বসন্ত ওখানেই কাটায়, প্রকৃতিকে কাছে থেকে অনুভব করে ..।
মা দূর্গা দেখলেন .. সবাই কষ্টে নেই .. কারো কারো কাছে পূজোটা ছুটি কাটানোর মাধ্যমমাত্র ! কোনো কোনো বাড়ি আবার বাড়ির পূজাকে কেন্দ্র করে ভরে উঠছে লোকে লোকারণ্যে.. আত্মীয় স্বজনের মিলন উৎসবে মেতে উঠেছে পূজোর আলোয় সেজে উঠেছে বারোয়ারি পূজোমণ্ডপ। ফর্দ তৈরী হচ্ছে নানান ধরণের কাজের। ভোগ তৈরী, অতিথি অভ্যাগতদের নিমন্ত্রণ, নরনারায়ণ সেবা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পূজোসংখ্যা'র পত্রিকা প্রকাশ, দরিদ্রদের বস্ত্র-বিতরণ থেকে বিসর্জনের আগাম পরিকল্পনা। ছোটরাও মেতেছে আনন্দে...।
পর্ব - ৩
এদিক সেদিক দেখতে দেখতে মা দুর্গা এসে পৌঁছলেন একটি সাধারণ পাড়ার চৌরাস্তার মোড়ে.. একটি ছোট্ট প্যান্ডেল গড়ে কয়েকজন উঠতি বয়সের ছেলে বসে মাইকে আগমনী গান বাজাচ্ছে .. মাঝে মাঝে মাউথ স্পিকারে চিৎকার করে করে বলছে,
"আর মাত্র কয়েক ঘন্টা .. আজকেই খেলা.. টিকিটের মূল্য মাত্র একশো টাকা.. একশো টাকায় আপনিও পেতে পারেন প্রথম পুরস্কার হিরোহোন্ডা মোটরবাইক .. দ্বিতীয় পুরস্কার ..ইত্যাদি ইত্যাদি .."
মা দূর্গা কিছুই বুঝছেন না .. এগিয়ে গিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করলেন,
--- কী হচ্ছে এগুলো ?
--- লটারী গো, দেখছো না একশো টাকায় কত কী পুরস্কার ..
--- এসব কেন ?
--- কি করবো বলো? পাড়ার লোক চাঁদা চাইলে বলে জুলুমবাজি ..পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দেয় .. আজকের দিনে এতো অল্প টাকায় কী পূজার আয়োজন হয় .. তাই এই ব্যবস্থা ! ...
--- এই যে মাসখানেক এখানে পড়ে পড়ে চিৎকার করছো , বাড়িতে বকে না ? আর পড়াশুনা?
--- সব করি গো, বকাও খাই, পড়াশুনাও করি.. চাঁদাও তুলি, আমরা না করলে কে করবে? এসব না করলে পাড়ার ছোট ছোট ক্লাবে পূজা কী করে হবে ? দুর্গাপূজা বলে কথা?
টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে.. কোথাও দাঁড়াবার ঠাঁই নেই .. পাশের একটি বন্ধ দোকানের বারান্দায় একজন চাদরমুড়ি দিয়ে জুবুথুবু বসে রয়েছে। পুরুষ না নারী, ঠিক ঠাওর হচ্ছে না ! কাছে যেতে বোঝা গেল এক বার্ধক্যপীড়িত মহিলা। পাগলী ? না পাগলের কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। তাহলে ভিখারিনী ? কই, সে তো ভিক্ষাও চাইছে না কারো থেকে ! আসলে সে একজন সংসার থেকে বিতাড়িত জরাগ্রস্থ ! হাঁটতে চলতে অক্ষম অথবা বসে থাকতে থাকতে চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে .. ঘষটে ঘষটে নিজেকে এদিক সেদিক কাছে পিঠে নিয়ে যায় .. খালি বারান্দা দেখে বসে থাকে সারাদিন.. আশেপাশের কোনো বাড়ি থেকে কেউ ভাত দিয়ে যায় ..তাতেই পেট চলে .. রাতে হাত-পা কুঁকড়ে পড়ে থাকে কারো বারান্দায় । সম্বল বলতে একটি জলের বোতল আর একটি কম্বল। চারিদিকে এতো বড় বড় বাড়ি .. কত বাড়ি খালি পড়ে রয়েছে তালাবন্দ.. থাকার লোক নেই। কিন্তু তার জন্য কোথাও নির্দিষ্ট একচালা তো দূর.. আস্তাকুঁড়েও নেই .. সারা বিশ্বই তার বাসভূমি ! যথেচ্ছ যাতায়াত.. তাই সে সারাদিন কোনো এক নিরিবিলি জায়গা বেছে নিয়ে অভিযোগহীনভাবে চুপটি বসে থাকে।
মা দুর্গা তার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো, বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে ..
সন্ধ্যা গড়িয়েছে ..
--- তুমি বুঝি এখানেই সারারাত কাটাবে ?
--- হ্যাঁ গো মা !
--- কেন ? সামনে তো দেখছি একটা দোতলা বাড়ি .. সেখানে গিয়ে থাকতে পারো.. এই জলবৃষ্টির রাতে একা বারান্দায় পড়ে থাকবে ?
--- রোজই তো থাকি মা ! তাছাড়া, আমি তো ওপরে উঠতে পারবো না সিঁড়ি বেয়ে। তোমার বাইরে থাকতে অসুবিধা হবে .. তুমি বরং যাও, একটা রাত ঠিক থাকতে দেবে।
মা দুর্গা সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে সেই বাড়িটার সামনে এলো.. গেট খোলা ছিল .. অতএব ঢুকে পড়লো ভেতরে। খুব পুরোনো দোতলা বাড়ি, লোকজন বিশেষ চোখে পড়ছে না। নিচতলার উঠোন জলে থৈ থৈ .. সিঁড়ি বেয়ে সোজা দোতলায়। ভেজানো দরজা টোকা দিতেই খুলে গেলো .. ঘরের ভেতরের অবস্থা দেখে মা দুর্গা কিছুক্ষণ বাকরহিত হয়ে রইলো ..
পুরো ঘর জলে জলময় .. দিন সাতেক টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি পড়ছে ..তাতে পুরোনো ছাদ আর দেওয়াল রসে ঘরের ভেতর জল চুইয়ে পড়ছে, ফাটা অংশ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ছে .. কোথাও শুকনো নেই ! বিছানা.. টেবিল.. আলমারি সব জায়গায় পলিথিন ঢাকা .. ঘরের এখানে ওখানে বালতি মগ কৌটো বোতল লাগনো যা নিমেষেই জলে ভরে যাচ্ছে। ঘরে একটুখানি শুকনো জায়গা .. আর সেখানে চেয়ারের ওপর হাত পা গুটিয়ে বসে আছে একজন মাঝবয়সী মহিলা।
--- আজ রাতটা থাকতে দেবে গো ?
--- থাকবে ? থাকো !
কোথায় থাকতে দেবে ? বসতে দেবার শুকনো জায়গা খুঁজে পাওয়ায় মুশকিল তবু জুবুথুবু হয়ে বিছানার এক কোণে বসতে দিল।
--- তোমার তো খুব অসুবিধা ?
--- না গো, হঠাৎ বৃষ্টি লাগালো ..পূজোর কটাদিন বাকি ..মা আসবেন বছর ঘুরে তাই চিন্তা হচ্ছে।
--- এত কষ্টে থাকো, তবু পূজো পূজো করছো, মাকে কোনোদিন বলেছো তোমাদের দুঃখের কথা ?
--- মা দুর্গা বছরে একবার বাপের বাড়ি আসেন, তাকে কি দুঃখের গল্প শোনাতে আছে ? তাকে আদর যত্ন করতে হয় .. ঘরে ঘরে নানারকম নাড়ু মোয়া লুচি ক্ষীর পায়েস মিষ্টি তৈরী করা হয় .. সবাই নতুন জামাকাপড় পরে মায়ের দর্শন করে মাকে প্রণাম করে বলে , .."দেখো মা আমরা কত ভালো আছি, আমাদের জন্য চিন্তা করো না।"
তাইতো মা নিশ্চিন্তে ফিরে যান কয়েকদিন কাটিয়ে।
গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল ওরা..
মাঝরাতে বৃষ্টির জোর বাড়লো..
মা দুর্গার মনে পড়লো সেই অসহায় বৃদ্ধার কথা.. এই ধারাবর্ষণে তার কী অবস্থা ?
তৎক্ষণাৎ চলে এলো তার কাছে ..
পরদিন .. দেবীপক্ষের সূচনা ..
সকালবেলা.. সারারাতের অবিরাম বৃষ্টিতে পথঘাট জলে থৈ থৈ .. রাস্তায় হাঁটুজল.. রাস্তার পাশের দোকানের বারান্দাও জলমগ্ন.. অনেক দোকানেও জল ঢুকেছে।
পথচলতি লোকেদের দৃষ্টি ছুঁয়ে গেলো পাশের ছোট্ট প্যান্ডেলে.. যেখানে গতকাল অব্দি লটারির টিকিট বিক্রি হচ্ছিলো !
এ কী দেখছে তারা ! চারিদিকে জলে জলময়.. শুধু প্যান্ডেলের ছোট্ট জায়গাটা শুকনো, সেখানে কতকগুলো ইট জড়ো করে তৈরী হয়েছে ছোট্ট এক বেদী! আর সেই বেদীতে উবু হয়ে বসে আছে এক দেবী.. সেই অথর্ব মহিলা .. তার দৃষ্টিতে ক্ষুধা নেই .. তৃষ্ণা নেই .. ক্ষোভ নেই .. দুঃখ নেই .. উদ্বেগ নেই .. দুশ্চিন্তা নেই ..
আছে শুধু প্রশান্তি ! আজ যেন প্রথমবার সে তার নিজের ঘর খুঁজে পেয়েছে .. মাথা গোঁজার আপন আশ্রয় .. এ যেন শুধু তার জন্যই তৈরী ! দুর্গামণ্ডপে অধিষ্ঠিত দুর্গা প্রতিমা !
মা দূর্গার মতোই তার দুচোখে ঝরছে শুধুই করুণাধারা..
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
শারদ শুভেচ্ছাসহ...
রীতা রায়
মহেশমাটি রোড , মালদা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
ধন্যবাদ 🌹
উত্তরমুছুন-- রীতা রায়