প্রবন্ধ ।। বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ও মুদ্রণযন্ত্র ।। আবদুস সালাম
সাহিত্য একটা জাতির মানস মুকুর। সূক্ষ্ম ভাবে সাহিত্য মানে চলতাধর্মী চিত্র প্রবাহকে স্থায়ী অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা । স্থাপত্য কীর্তি যেমন মানুষের শিল্প মহিমাকে প্লাবিত করেছে, মুদ্রা যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে তেমনি মানুষের অগ্রগতিকে বাধা মুক্ত করেছে , চিন্তার জগতে এনেছে বিপ্লব। ঘন ঘন রাজনৈতিক বিপ্লব যখন মানুষকে দিশাহীন করে তুলেছে তখন সাহিত্য মানুষকে সোজা মেরুদন্ডের উপর দাঁড় করিয়েছে।
বাংলাদেশের স্থাপত্য কীর্তি বড়োই ভঙ্গুর । ঘনঘন নদী গতিপথ বদল করে নষ্ট করেছে স্থাপত্য। কিন্তু যা আমাদের আজকের দিনে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে তারা হলো বাংলা সাহিত্য। সমগ্র মধ্যযুগকে সজীব,সচল ও সবাক করে রেখেছে পুঁথি সাহিত্য। বাংলা দেশের সামাজিক উপাদান সন্ধান করতে আমাদের পুঁথির উপর নির্ভর করতে হয়। মধ্যযুগের সাহিত্য দীর্ঘ দিন ধরে কাঠের পাটাতনের মধ্যে লাল কাপড়ে মুড়ি দিয়ে মরণ ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল।
মুদ্রাযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে য়ুরোপীয় মানসমুক্তি যেমন ঘটিয়েছে দ্রুত বেগে তেমনি বাংলাদেশের মুদ্রণযন্ত্র বাঙালি মনে চিন্তার দ্বার খুলে দিয়েছে নিঃসন্দেহে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে উনিশ শতকের বাঙলা সাহিত্যের অনেক বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করি। প্রথমতঃ, মধ্যুযুগীয় সাহিত্য পুঁথি নির্ভর। তার গতি ও প্রচার সীমাবদ্ধ। পুঁথির গতিশীলতা নেই বলে পাঠক ও শ্রোতা কম। একটা নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুদ্রণযন্ত্র প্রবেশের ফলে স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে সাধারণ পাঠক ও সংগ্রহীতার সংখ্যা বাড়লো। মুদ্রা যন্ত্রের প্রধান দান হলো বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়। বাংলা সাহিত্য একলাফে মধ্যযুগ থেকে বেরিয়ে আধুনিক সাহিত্যের আঙিনায় কালিঝুলি অঙ্গে নিয়ে কলকাতায় অবতীর্ণ হলো। ক্রমশ সাহিত্য মঠমন্দির, পুরোহিতের খুংগীপুঁথি,চন্দন , সিঁদুর চর্চিত তুলট কাগজ ছেড়ে ছাপাখানায় কালিঝুলি মেখে হাজির হলো পাঠকের দরবারে । গঠন করলো বাংলা সাহিত্যের মোহময় কায়া। সূচনা হলো নবযুগের। এতদিন যে বাঙালি জড়ত্বের কূপে বন্দী ছিলো, ছিল সলিলে নিমগ্ন,। মেডুসা সর্পের মতো জড়িয়ে ধরে ছিলো সেই বাঙালি আজ সুখনিদ্রা ত্যাগ করে আধুনিক জীবনের কোলাহলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
দশম শতাব্দী থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে ১৭৫৭সালে পলাশীর যুদ্ধ তথা ভারতচন্দ্রের মৃত্যু ১৭৬০সাল পর্যন্ত সময়কে পুরাতন বাংলা সাহিত্যের কালসীমা। এই সাহিত্যের প্রধান ভান্ডারী ছিলেন বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠির উপধর্মসম্প্রদায়, তান্ত্রিক সহজিয়া বৌদ্ধাচার, শৈবনাথপন্থ,গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় , বাউল,শাক্ত ,সুফী , নানা ধর্ম শাখা, মঙ্গলকাব্য,রামভক্তিও গুহ্যতাবলম্বী কান্টের অন্তর্ভুক্ত রহস্যবাদী সাধকগণ। এরাই প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রন করতো । সেকালের কবি ও সাধকগণ ধর্ম সাধনের উদ্যেশ্যে কলম ধরলেও তার সঙ্গে প্রচ্ছন্ন ছিল মানুষের প্রতি কৌতুহল ও আকর্ষণ।
উনিশ শতকের প্রারম্ভ থেকেই যে সাহিত্য আমরা পেলাম তা কলকাতা ভিত্তিক ও সাধারণ মানুষের কথা বলা সাহিত্য । এই সময় সাহিত্য দৈবীকরণের মায়ালোক থেকে বেরিয়ে কঠোর মৃত্তিকায় অবতরণ করলো। বরং বলা যেতে পারে দেবচেতনা আবার নতুন করে নতুন উদ্যমে মানবের বেশে ফিরে এলো। তবে একথাও বলা ভালো পশ্চিমা হাওয়ায় শিক্ষা ,দর্শন, বিজ্ঞান ,সমাজ তত্ত্ব, রাষ্ট্র নীতিতে ভাব আদর্শে নব্য বাঙালী কে উন্মত্ত করে তুললো। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে দেবভাবনা প্রায় উধাও হয়ে যেতে বসলেও দ্বিতীয়ার্ধে আবার নবরূপে,অভিনব তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ফিরে এলো। এর অর্থ হলো এবার আর স্বর্গলোক থেকে পৃথিবী দেখা নয় ,শুরু হলো পৃথিবী থেকে স্বর্গ পরিক্রমার প্রচেষ্টা।
বিশাল অপ্রতিরোধ্য দুর্জ্ঞেয় শক্তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ,সব কর্মের ফলদাতা বলে আশ্বাস লাভের বৃথা চেষ্টা establishment বা চিরাচরিত বদ্ধমূল সংস্কার কি একেবারে নির্মূল হয়ে ছিল? একটা প্রশ্ন তবে থেকেই যায় ঈশ্বর গুপ্ত, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য কর্ম বিশ্লেষণ করলে দেখতে পায় সংশয়াবাদ ও নাস্তিক্যবাদের মধ্যে ঈশ্বর চেতনা দোদুল্যমান হলে ও তার একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় নি। কেউই ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে দিতে পারেন নি। তবে গোটা উনিশ শতক ধরে আমরা পেলাম অভিনব শিক্ষাদর্শ , নতুন সমাজ ভাবনা, রাজনীতি নিয়ে নানাবিধ জ্ঞান বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা। পেলাম আমাদের সংস্কারের উপর নতুন পালিশের বিদ্যুৎ এটা।
এই সময়ের বাংলা সাহিত্য প্রধানত কলকাতা ভিত্তিক ও মধ্যবিত্তের সাহিত্য। সাহিত্যের অঙ্গে প্রত্যঙ্গে বৈশ্যভাবের ছাপ পড়েছে। আধুনিক বিশ্বের যা কিছু বস্তুগত ও জ্ঞানগোচর ব্যাপার তার তার চেতনায় ধরা পড়েছে। উনিশ শতকের বাঙলা সাহিত্য সমগ্র দেশের সাহিত্য নয়, বরং মুষ্টিমেয় ইংরেজি শিক্ষিত কলকাতাবাসী বাঙালিদের সাহিত্য। সমাজ বিজ্ঞানে যাকে বলে বাবু কালচার।
উনিশ শতকের ইংরেজি বিদ্যা বাঙালি তরুণকে মাতিয়ে তুলে ছিল। একে আমরা রেনেসাঁস, নবজাগরণ, পুনর্জাগরণ যাই বলি না কেন বাঙলা সাহিত্য মধ্যযুগ থেকে বেরিয়ে এসে এর প্রবাহ বাংলাদেশের মানসিক ভূগোলের সীমানা অতিক্রম করে সারা ভারতের চিত্ততটে আলোড়ন তুলেছিল। ঐতিহাসিক গণ বলেন- New literary types, reform of the language, social reconstruction, political aspirations, religious movement and even change s in manners that' originated in Bengal, passed the ripples from a central eddy, across provincial barriers to the farthest corners of India .---- History of Bengal ## edited by DKSinha Calcutta University
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
-----------------------------
আবদুস সালাম
প্রয়াস শ্রীকান্তবাটি মাদারল্যান্ড