প্রবন্ধ।। দীপাবলি - আলোক উৎসব ও সংস্কৃতি ।। মৃণাল কান্তি দেব
আলোর উৎসব দীপাবলি। বাংলায় কালীপুজো বা শ্যামাপূজোর দিনে দীপাবলি উদযাপিত হয় সুপ্রাচীনকাল থেকেই। দীপ মানে প্রদীপ। দীপাবলি মানে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের সুদৃশ্য সমষ্টি যেখানে আহ্বান করার হয় আলোকে তথা শুভ শক্তিকে। অন্য অর্থে আলো মানে ন্যায়,বোধ ও চেতনা। বাংলা ও তার সন্নিহিত অংশ বাদে ভারতের অন্যান্য অংশে দীপাবলি দেওয়ালি নামে পরিচিত। দেওয়ালি বা দিওয়ালি শব্দে ব্যবহৃত দেওয়া বা দিয়ার অর্থও প্রদীপ। বাংলায় যেমন দীপাবলি শ্যামাপূজার সাথে সম্পর্কিত, বাংলার বাইরে দীপাবলি বা দিওয়ালি মহালক্ষ্মী আরাধনা ও ধনতেরাস এর সাথে সম্পর্কিত। একটা উৎসবকে ঘিরে কতরকমের যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র থাকতে পারে, এটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বর্তমানে, দুই ধরণের সাংস্কৃতিক পরিবেশ অবিমিশ্রিত হয়েছে, যদিও এখানে আমরা "কালচারাল হেজেমনি" ঘটতেই বেশি দেখতে পাই, অর্থাৎ বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক স্রোতে অন্য সংস্কৃতির মিশ্রণ ও আধিপত্য। সময়ের সাথে সাথে, যুগের অগ্রগতির সাথে সাংস্কৃতিক পরিবেশ পরিবর্তিত হয়, চিন্তাধারা ও সাংস্কৃতিক শৈলীর রূপান্তর ঘটে,বিবর্তন ঘটে, এক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে আলোর উৎসব ঘিরে যে প্রভেদ রয়েছে, এক সংস্কৃতির আরেক সংস্কৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের নিরন্তর প্রচেষ্টা আছে সে নিয়ে নানা মতপার্থক্য ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু এসবের ঊর্ধে যে সারকথাটা আছে, তা হল আলোর উৎসবের মিলনের উৎসব ও সংহতির উৎসবে পরিণত হওয়া। মূলত এই বিষয়কে সামনে রেখেই বিশ্বের বহু দেশ দীপাবলিকে তাদের নিজেদের মতন করে পালন করছে। এদেশে ব্রিটিশ সরকার থাকাকালীনই দীপাবলি তথা আলোর উৎসবের বিশ্বায়ন ঘটে। আবার অনেক গবেষক মনে করেন, রাজস্থান, মুম্বাই এ যেভাবে দিওয়ালি পালিত হয়, তার অনেকটা এসেছে আফ্রিকান সভ্যতা থেকে। আবার, একবিংশ শতকের গোড়ার দিক থেকে ভারতের দীপাবলিতে যে মায়াবী আলোর খেলা ও রোশনাই দেখা যায়, সেটা এসেছে নিউ ইয়ার কালচার থেকে। আবার ভারতের মহাসমারোহে আলোর উৎসব বা দীপাবলি উদযাপন এর কনসেপ্টটা পশ্চিমী দুনিয়াকে নতুন ভাবে ভাবিয়েছিলো। পাশাপাশি, ভারতবর্ষের দীপাবলি উৎসবের সাথে যে পৌরাণিক কাহিনী বা ধর্মীয় লোকাচার জড়িত থাকে, তা পাশ্চাত্যের আলোর উৎসবের সাথে সরাসরি জড়িত থাকে না, কিন্তু পরোক্ষভাবে থাকে। কম্বোডিয়া, স্পেন এর বেশ কিছু অঞ্চলের অধিবাসীরা তাঁদের আরাধ্য দেব দেবীর পুজো করেন এবং আলোর উৎসব পালন করেন। গ্লোবালাইজেশন এর যুগেতো বটেই, গ্লোবালাইজেশন এর আগেও যে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির ওয়ার্ল্ডওয়াইড ট্রানসাকশান ঘটেছে, তার আভাস আমরা বহুলাংশে পাই। আর বিগত কয়েক বছর ধরে এই ট্রানসাকশান এ এসেছে জেট গতি। সমগ্র বিশ্বর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ছে উৎসব। আর এই উৎসব পরিণত হয়েছে পারস্পরিক মিত্রতা ও সম্পর্কের সুস্থতা বজায় রাখা,অন্বয়বোধ ও সামাজিক নির্মিতিবাদকে পুনর্গঠিত করা,গঠনাত্মক মানসিকতা বৃদ্ধির উপাদান হিসেবে।
আনন্দের হিল্লোল লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে। প্রবাসী ভারতীয় থেকে শুরু করে লন্ডনের স্থানীয় নাগরিকরা তথা বিদেশিরা একযোগে আয়োজন করেছেন দীপাবলি উৎসব। নানা দেশের নানা ধর্মের ও সংস্কৃতির মানুষরা আমন্ত্রিত এই আলোর উৎসবে। আলোর প্রদর্শনীর পর শুরু হতে চলেছে কালচারাল কনসার্ট, যেখানে সংমিশ্রিত হবে নানা দেশের সংস্কৃতি, যেখানে আন্তর্জাতিকতাবাদ এর রুদ্রবিনায় ঝংকৃত হবে সৌভাতৃত্ববোধ ও মৈত্রীর সুর। বিশ্বব্যাপী মহামারীর আগে এমন চিত্রই দেখা গিয়েছিলো। এ তো গেলো লন্ডনের কথা। এবার আসি নিউইয়র্ক এর কথায়।
নিউইয়র্ক এর টাইমস স্কোয়ার, যেখানে দীপাবলি পরিণত নিউ ইয়ার এর অ্যাডভান্সড সেলেব্রেশনে। রঙ্গীন আলোর মায়াবী বিচ্ছুরণে উদ্ভাসিত ফানুস অঙ্কিত করে অন্য এক দীপাবলিকে। নানা জাতি, নানা ভাষা, আর নানা সংস্কৃতি মিলেমিশে এক হয়ে সৃষ্টি হয় মিলনমঞ্চ। ফ্লোরিডাতে দীপাবলি পালিত হয় আধুনিকতা ও ক্লাসিক কালচার এর দুরন্ত যুগলবন্দিতে।
অস্ট্রেলিয়া তে নিউ ইয়ার বা ডোমেস্টিক ফেস্টিভ্যালগুলোতে যে উন্মাদনা দেখা যায়, সে রকমই উন্মাদনা চোখে পড়ে দীপাবলির ক্ষেত্রেও। অস্ট্রেলিয়ানরা দীপাবলিকে মনে করে "ডিসলভার অফ নেগেটিভ ডেমোনিক ফোর্সেস " । স্কট মরিসন থেকে জুডিথ রাইট ফেস্টিভ্যাল কে নিয়ে এই ধারণাতেই বিশ্বাসী। সিডনি থেকে ব্রিসবেন,হোবার্ট থেকে পারথ সর্বত্রই আলোকশক্তিকে মঙ্গলজনক ও শান্তিপ্রতিষ্ঠাকারী শক্তিরূপে মনে করেন। দেশের কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন ভারতের মাটিতে নানা বৈচিত্রের মধ্যে পালন হওয়া দীপাবলিকে।
শ্রীলংকা আর কুয়ালালামপুর এবং ভারতবর্ষের কিছু অংশে দীপাবলিতে নদীতে দিয়া অর্থাৎ প্রদীপ ভাসিয়ে প্রকৃতিকন্যা ও অশুভনাশিনী মহামায়ার আরাধনা করা হয়।
কানাডা, স্পেন আর পর্তুগাল এর নানা স্থানে মহাসমারোহে পালিত হয় দীপাবলি, যেখানে দিওয়ালির অর্থ "কালার অফ লাইফ " এবং "টুগেদারনেস "। নকশাকরা রংবেরঙের কাগজের মধ্যে এল ই ডি বাল্ব দিয়ে সাজানো হয় রয়্যাল স্ট্রিট।
ফ্রান্সের দিওয়ালিতে ক্লাসিসিজম এর সাথে মেশে সফ্ট মডার্নিজম। ক্যান্ডেললাইট ডিনার কে করা হয় আরো স্পেশাল। সাথে চলতে থাকে ইন্ডিয়ান ডেভোশনাল, চলতে থাকে পোয়েট্রি রিডিং। ফ্রান্স এ দিওয়ালির অলিখিত ট্যাগলাইন " স্পার্কলিং ফ্লো অফ লাইফ স্ট্রিম "।
ডেনমার্ক আর বোলিভিয়াতে দিওয়ালি মানেই ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল সামিট। সুদূরের প্রবাসীরা খুঁজে পান একখণ্ড ভারতকে। জ্যাজ, পপ,রক এর সাথে মেশে দেশি ভাংড়া, আর ভারটনাট্যম। মহালক্ষ্মী ও শ্যামা মায়ের ভাস্কর্য চোখে পড়ে ফেস্টিভ এরিয়া তে।
পেরু, আর্জেন্টিনা, জার্মানিতে দীপাবলি বা দিওয়ালি র পরিচয়"ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্টারকানেকশন "হিসেবে।
নেপাল থেকে সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড থেকে ডারবান, সব জায়গাতেই আলোর উৎসব
সমাদৃত। প্রদীপের স্নিগ্ধ শিখায়, ফানুসের উচ্ছলতায়, নৃত্যগীতের মূর্ছনায়, আলোকমালার রাগিনীতে দীপাবলি তথা দেওয়ালি রঙ্গীন হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে নয়, শুধুমাত্র হুল্লোড়ের জন্য নয় -- মিলনের জন্য, সংহতির জন্য,সর্বোপরি মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য এই উৎসব হয়েছে বিশ্বের উৎসব, বিশ্বমানের উৎসব।
তথ্যসূত্র:-
এককথায় অসাধারণ তথ্যবহুল রচনা।
উত্তরমুছুন