প্রবন্ধ ।। রামনারায়ণ তর্করত্ন : দ্বিশত জন্মবার্ষিকী ।। বিশ্বনাথ প্রামাণিক
রামনারায়ণ তর্করত্নঃ দ্বিশত জন্মবার্ষিকী
বিশ্বনাথ প্রামাণিক
বাঙালির মন ও মননে নাট্যশিল্প চর্চা যাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে, তাঁদের কথা স্মরণ করতে গেলে অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় রামনারায়ণ তর্করত্নকে।
উনবিংশ শতকে পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে বঙ্গ সমাজে বহুদিনের পোষিত কুৎসিত ব্যাধিগুলির নগ্নরূপ উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল। তৎকালীন শিক্ষিত তরুণ সমাজের যে গুটিকয়েক সমাজ সংস্কারকগণ সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের ধারার বিপ্লব ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন- বাংলা গদ্য সাহিত্যের ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, টেকচাঁদ ঠাকুর্, কালীপ্রসন্ন সিংহ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। গদ্য সাহিত্যের পাশাপাশি নাট্যসাহিত্যের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের দিশারী হয়ে উঠেছিলেন- উমেশ চন্দ্র মিত্র, মনোমোহন বসু ,রামনারায়ণ তর্করত্ন, মধুসূদন দত্ত প্রমূখেরা।
বাংলা নাটকের ইতিহাস প্রণেতা অর্জিত কুমার ঘোষ রামনারায়ন প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, "নাট্যক্ষেত্রে সংস্কারের মুদগর লইয়া অবতীর্ণ হলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন।"
নিজে সংস্কৃত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হয়েও ব্রাম্ভন্যবাদের পুরাতনপন্থী সমাজব্যবস্থার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন নাটুকে রামনারায়ণ।
জন্ম ও বাল্যশিক্ষাঃ
সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত রামনারায়ন জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২৬ ডিসেম্বর ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ ২৪ পরগনার অন্তর্গত সোনারপুরের হরিনাভি গ্রামে। পিতা রামধন শিরোমনি সংস্কৃত পন্ডিত ও অধ্যাপক ছিলেন। দাদা প্রাণকৃষ্ণ ছিলেন বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক। এহেন পরিমণ্ডলে বড় হওয়া রামনারায়ন ছোট থেকেই শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার আবহে বড় হয়ে উঠলেন । প্রথমে হরিনাভির চতুষ্পাঠীতে বাল্যশিক্ষা লাভ করেন। বড় হয়ে সংস্কৃত কলেজে ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৩ পর্যন্ত ব্যাকরণ, কাব্য ,স্মৃতি, ও ন্যায়শাস্ত্র চর্চ করেন।
কর্মজীবনঃ
পাঠ সমাপনান্তে হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজের প্রধান পন্ডিত হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। এখান থেকেই দীর্ঘ কর্মজীবন শেষ করে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরকালীন সময়ে নিজ গ্রামে চতুষ্পাঠী খুলে অধ্যাপনার দ্বারা বাকি জীবন অতিবাহিত করেন।
সৃষ্টিসম্ভারঃ
তিনিই প্রথম পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে মৌলিক নাটক রচনা করেন। যেগুলি হল - রুক্মিনিহরণ (১৮৭১), কংসবধ ( ১৮৭৫) ও ধর্মবিজয় ( ১৮৭৫)।
যদিও তাঁর রচিত প্রথম ও শ্রেষ্ঠ নাটক ছিল- কুলীনকুলসর্বস্ব (১৮৫৪),
এছাড়া বাল্যবিবাহের কুফল ও অন্যান্য সামাজিক সমস্যা নিয়ে রচিত নাটক- নবনাটক ( ১৮৬৫), স্বপ্নধন (১৮৭৩), সম্বন্ধসমাধি( ১৮৬৭)।
চারটি অনুবাদ নাটক- বেণীসংহার (১৮৬৫), রত্নাবলী ( ১৮৫৮, অভিজ্ঞান শকুন্তলা (১৮৬০) এবং মালতিমাধব( ১৮৬৭)।
প্রহসন - যেমন কর্ম তেমন ফল(১৮৬৩), চক্ষুদান (১৮৬৯), উভয়সংকট (১৮৬৯),
আর একমাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থ- পতিব্রতপাখ্যান লেখা হয় ১৮৫৩ খ্রীঃ ।
কীর্তিঃ
হরিনাভি বঙ্গ নাট্যসমাজ প্রতিষ্ঠা-(১৮৬২খ্রীঃ)।
তার রচিত নাটক গুলির মধ্যে অবশ্যই প্রথমে স্মরণ করতে হয় “কুলীনকুলসর্বস্ব” নাটকটির কথা । কুলীনকুলসর্বস্ব ও নবনাটক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি এই দু’খানি নাটক রচনা করেছিলেন এবং পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তর্করত্ন ইংরেজি জানতেন না। পাশ্চাত্য নাটক সম্বন্ধেও তিনি অনভিজ্ঞ ছিলেন বলেই মনে হয়। সংস্কৃত নাটকে ছিল তার অবাধ অধিকার। তার নাটক পাশ্চাত্যের নয়, প্রাচ্যের একান্ত অনুসরণ। কুলীনকুলসর্বস্ব বহুবিবাহ প্রথার কুফল নিয়ে রচিত। এই নাটকে দেখি- এক কন্যাদায়গ্রস্ত ভদ্রলোক তার চার কন্যার বয়স হওয়া সত্বেও বিবাহ দিতে সক্ষম হননি । অবশেষে এক কুরুপ বৃদ্ধের সঙ্গে তিনি বিবাহ দিতে বাধ্য হলেন। নাটকের বিজ্ঞাপনে নাট্যকার লিখেছিলেন- “পুরাকালে বল্লাল ভূপাল আবহমান প্রচলিত জাতি মর্যাদা মধ্যে স্বকপোলকল্পিত কুলমর্যাদা প্রচার করিয়া যান, তৎপ্রথায় অধুনা বঙ্গবাসী যেরূপ দূরবস্থাগ্রস্থ হইয়াছে তদ্বিষয়ে কোনো প্রস্তাব লিখিতে আমি নিতান্ত অভিলাষী ছিলাম।“
নাটকের ভাষা গুরুগম্ভীর ও তার পাশাপাশি সরস কৌতুক রসে পরিপূর্ণ। এটি সে সময়ের অত্যন্ত একটি জনপ্রিয় নাটক ছিল- যা তাঁকে নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিল।
আবার “নবনাটক” প্রসঙ্গে নাট্যকারের অভিব্যক্তি- নবনাটক বহুবিবাহ প্রথা নিবারণের নিমিত্ত সদুপদেশ সূত্র।
তবে রামনারায়ণ প্রহসন রচনায় যত মুন্সিয়ানার পরিচয় রাখতে পেরেছিলেন কুলীনকুলসর্বস্ব বাদ দিলে বাকি নাটক রচনায় তেমন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে পারেননি। তাঁর রচিত প্রহসনগুলির কথা না বললে এ আলোচনা অসম্পূর্ণই থেকে যায়। “ যেমন কর্ম তেমন ফল’, “উভয় সংকট” কিংবা “চক্ষুদান”-এক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়।
“যেমন কর্ম তেমন ফল”- প্রহসনটি সামাজিক সমস্যা নিয়ে অত্যন্ত সরস ভাষায় রচিত। পরস্ত্রীর প্রতি অবৈধ আসক্তি এবং তার হাস্যকর শাস্তি নিয়ে এটি লেখা হয়েছিল। আবার “চক্ষুদান”- প্রহসনে স্বামী নিকুঞ্জবিহারী স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করে অন্য নারীতে নিমগ্ন। তার স্ত্রী বসুমতী একদিন ছলনার আশ্রয় নিয়ে কীভাবে স্বামীর চৈতন্য উদ্রেক করতে সমর্থ হলেন তার সরস রচনা দর্শককে উদ্বেলিত করে তোলে। নাটকের শেষে নিকুঞ্জের খেদোক্তি – “বসুমতী তুমি আজ কেবল আমাকে চক্ষুদান দিলে এমন নয়, সেই সঙ্গে অনেকেরই চক্ষুদান হল।“ এ যেন তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আবার “উভয়সঙ্কট” প্রহসনে সপত্নী সমস্যার অবতারণা দেখতে পাই । বড়বউ , ছোটবউ এবং গোয়ালিনী -চরিত্র তিনটির বাস্তবধর্মী প্রকাশ প্রশংসার দাবি রাখে। দুই সতীনের কলহ তিক্ততা এবং স্বামীকে যত্নে পীড়িত করে তোলার নিপুন বর্ণনা । নাটকের শেষে কর্তা বেচারার আক্ষেপ- “অগো মহাশয়েরা আমার দুর্গতি আপনারা দেখেছেন আপনাদের মধ্যে আমার মত সৌভাগ্যশালী পুরুষ কেহ থাকেন তিনি এমন সময় উপস্থিত হলে না জানি কি করেন বোধকরি তার ও এইরূপ উভয়সঙ্কট।“
এই মহান নাট্যকার দি বেঙ্গল ফিল্হার্মোনিক একাডেমি কর্তৃক ”কাব্যপোধ্যায়” উপাধি পেয়েছিলেন কিন্তু নাটকের প্রতি নিষ্ঠা ও ভালোবাসা, নাটকের প্রতি তার প্যাশন কতখানি ছিল তা বোধহয় আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাঁর ডাক নাম ছিল যে- নাটুকে রামনারায়ণ।
পুরাতন ধারার নাট্যকার হলেও রামনারায়ন চিন্তা ও চেতনায় আধুনিক ছিলেন। মধুসূদনের পূর্বে তিনিই একমাত্র নাট্যকার যিনি অধিকাংশ স্থলে অভিনয়ের উদ্দেশ্যে কলম ধরেছিলেন। সমসাময়িক কালে নাট্যকার হিসাবে তিনি বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন। তাঁর নাটক বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে, কলকাতার অভিজাত শ্রেণির নিজস্ব মঞ্চে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির রঙ্গালয়ে মঞ্চস্থ হয়েছিল।
মধুসূদনের আবির্ভাবের ফলে ক্রমে পুরাতন ধারার নাটকাভিনয় হ্রাস পেতে লাগলো। রামনারায়নের “রত্নাবলি” নাটকের অভিনয় দেখে খুশি হতে না পেরে মধুসূদন দত্ত নাটক রচনায় হাত দেন। তারপর থেকেই যথার্থ আধুনিক নাটকের সূচনা হয়।
তবু পুরানো যুগের নাট্যকার হিসাবে অভিনয়কে জনপ্রিয় করতে তাঁর অবদান শ্রদ্ধ্যার সঙ্গে স্মরণীয়। এই মহান নাট্যকার নিজ গ্রামে ১৯ জানুয়ারি ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন।
এবছর তার দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী । নাট্যকার রামনারায়ন তরকরত্নের প্রতি জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি।
-------------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
ঋণস্বীকারঃ-
i) উইকিপিডিয়া
ii) Millioncontent.com
iii) bn.atoznea24.com
iv) বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত- ডঃ অসিতকুমার বন্ধ্যোপাধ্যায়।