কলোনিয়াল লাইফ
আজিজ উন নেসা
কলোনিয়াল কোয়ার্টার লাইফ। বাবারা দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টে চাকরি করেন। সামনে পিছনে বড় বড় বাগান। পিছনে ফলের, সামনে ফুলের গাছে ভর্তি।
কোয়ার্টারে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের, গায়ে গায়ে লেগে থাকা রো-হাউসের মতো জীবনটাও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে স্বজনদের থেকেও বেশি আপন, পাশের বাড়ির কাকু- কাকিমা, বন্ধু-বান্ধব... !
কোয়ার্টারের ছেলে-মেয়েদের বিকেল হলেই হই হই করে একসঙ্গে লুকোচুরি, কুমির ডাঙ্গা, গাধাপিট্টু কত খেলাধুলা ; একটু বড়দের মাথা থেকে কত খেলার আইডিয়া বের হয়, ইয়াত্তা নেই! কার বাগানের পেয়ারা ভাঙবে, কার বাগানের কুল... এক একদিন এক এক রকমের প্ল্যানিং।
অদ্রিজা, ইকবাল খুব জোর ছয় বছরের। এক হাইড্রেন হচ্ছে। এক বিকেলে খেলা শুরু হল- কে ওই ড্রেনটা এক লাফে পার হতে পারে? হঠাৎ ইকবাল পার হতে গিয়ে পড়ে যায়। অদ্রিজার কী কান্না!
ঈদের দিনে ইকবালদের বাড়ি, সবাই খেতে আসে। অদ্রিজা, ইকবাল তখন ক্লাস সেভেন এইটে পড়ে। বড়দের সালাম করে পরবী পাওয়া টাকায় দুপুরবেলায় লুকিয়ে ইকবাল, ওর আপা, পাশের বাড়ির লাভলি আপা, রিংকু দি, মিতা, অদ্রিজা, অদ্রিজার দাদা সবাই মিলে মোড়ের দোকানে পপিন্স, লালিপপ কিনতে গিয়ে, ইচ্ছা হল পান খেতে, তাও জর্দা পান। ভীষণ উদ্দীপনা! ও মা, পান খেয়ে ঘর আসতে না আসতে, সবার মাথা ঘোরা শুরু। ইকবাল ও ভীষণ ভয় পেয়ে বারবার অদ্রিজা কে বলছে," তুই তোর মাকে কিন্তু একদম বলবি না, তুই পান খেয়েছিস... তাহলে আমাদের বাড়ি আর আসতে দেবে না।"
অদ্রিজা, ইকবাল প্রাইমারি স্কুলে একই সঙ্গে পড়লেও হাই স্কুলে উঠতে, স্কুলগুলো পাল্টে গেলেও বন্ধুত্বটা থেকে গিয়েছিল।
দু'জনেই সায়েন্স নিয়ে নিজের নিজের স্কুলে ভর্তি হয়, কিন্তু কমন ফ্যাক্টর, দুর্গাপুরের সব থেকে চালু কোচিং সেন্টার, যেখানে মৌমাছির ঝাঁকের মতো সব ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয়।
ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিক্স সব ভারি ভারি সাবজেক্টের ক্লাস করতে করতে মাঝে মাঝে একবার দু'বার অদ্রিজা ইকবালের কথা হয় কিন্তু সবথেকে বড় রিক্রিয়েশন- সাইকেলে করে দল বেঁধে একসাথে বাড়ি ফেরা।
পড়াশোনাতে কোন কিছু আটকে গেলে আদ্রিজা ইকবালকে ফোন করে। অংক বুঝতে না পারলে ওর বাড়িতে গিয়ে বুঝে আসে। ইকবাল কখনো টিউশন মিস করলে অদ্রিজার কাছ থেকে নোট নেয়। নোট দেওয়া নেওয়া করতে করতে কখন যে মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেছিল ওরা টেরও পায়নি।
সেই ছোট্টবেলা থেকে পাশাপাশি একসঙ্গে মানুষ, গল্পের ভান্ডারও বিশাল। কোচিং থেকে বেরিয়ে দু'টো সাইকেল হুবহু পাশাপাশি। ইকবাল ও অদ্রিজা। সবাই দল বেঁধে ফিরলেও অদ্রিজা আর ইকবাল একটু তফাতে । সাইকেল এগিয়ে যায়, ওরাও এগিয়ে যায় গল্প করতে করতে। জীবনের ওঠা পড়ার মতো ওদের সাইকেলেরও গতিবেগ একইসঙ্গে ওঠা নামা করে।
রাস্তাতে রিক্সা, মোটরসাইকেল, চার চাকা অন্যান্য গাড়িও চলাচল করছে। দুই পাশ দিয়ে অনেক লোক হেঁটে যাচ্ছে। দুর্গাপুরের কোয়ার্টারের সামনের রাস্তা। সেরকম কোথাও জেব্রা ক্রসিং আঁকাও নেই। কেউ আবার হাত দেখিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। ওরা মাঝে মাঝে বেল বাজায়, সামনের গাড়িটা একটু সরে গেলে আবার তারা পাশাপাশি। সামনে গাড়ি এসে পড়লে সাইকেল দু'টি কখনো এগিয়ে, কখনো পিছিয়ে... গল্পের খেই হারিয়ে যায় আবার সমান উৎসাহ উদ্দীপনায় "কি যেন বলছিলাম, কি যেন বলছিলাম" করতে করতে, গল্পের প্রবাহ নতুন করে চলতে থাকে। ওদের গল্প ফুরায় না, নোটে গাছটা মুড়ায় না!
যখন গল্পের বিষয় কিছু খুঁজে পায় না, শুধুই পাশাপাশি সাইকেল চালানো। দূর থেকে দেখলে মতিভ্রম হয়, মনে হবে যেন দু'টো সাইকেল পাশাপাশি জোড়া লেগে একটি চার চাকার সাইকেল, চেনা রাস্তা ধরে তর্ তর্ করে এগিয়ে যাচ্ছে।
দু'জনে সাইকলিং করতে করতে কখনো কুমারঙ্গলাম পার্ক, কখনো সিটি সেন্টার চলে যায়।কোন পরিচিত লোক দেখলে ওরা নিজেদেরকে একটু আড়াল করে নিত। হিজড়াদের উৎপাত না থাকলেও কোন সিকিউরিটি দেখলে তাড়াতাড়ি সরে যায়, কখন কে আবার ধরে নিয়ে গিয়ে থানায় ভরে রাখবে। পড়াশোনার আলোচনাটা তাদের গল্পের প্রধান বিষয়। ফিজিক্সের প্রবলেম, কেমিস্ট্রির কোনো রিঅ্যাকশন। ইকবাল ন্যাশনাল স্কলারশিপের টাকাতে পড়াশোনার বই কেনে, টিউশনের খরচা মেটায় ইত্যাদি।
স্কুলের হেডমাস্টার ও সব টিচারদের ভীষণ আস্থা ইকবাল খুব ভালো রেজাল্ট করে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে।
মাঝে মাঝে ইকবালের মানসিক চাপ ও ভীষণ বেড়ে যায়। পড়তে পারে না, চুপচাপ জানলার ধারে বসে থাকে। রাতের পর রাত ঘুম হয় না। মাঝে মাঝে অদ্রিজার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। অদ্রিজা ঠিক বুঝতে পারে না, ইকবালের কী হয়েছে! অদ্রিজা কথা বলার চেষ্টা করলে ইকবাল পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অদ্রিজা, সহপাঠী রোহনের সঙ্গে কথা বললে ইকবালের ভীষণ রাগ হয়।
এমনিভাবেই দিনগুলো কেমন গড়গড়িয়ে পেরিয়ে গেল। বাদ সাধল জয়েন্টের রেজাল্ট।
ইকবাল ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং দু'টো পেলেও ডাক্তারি পড়তে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় আর অদ্রিজা ভর্তি হয় আর.ই. কলেজে। ইকবাল কলকাতায় আর অদ্রিজা দুর্গাপুরেই থেকে গেল। প্রথম প্রথম ভীষণ মন খারাপ, সামনাসামনি দেখা হচ্ছে না। ছোটবেলার সঙ্গী, ছোটবেলার ভালোবাসা, সে কী ভোলা যায়! যদিও মোবাইলে রোজই কথা হয়।
নতুন নতুন কলেজ। বেশ ভয় ভয়। কলেজে রাগিং আছে। সিনিয়র দিদি দাদাদের নজর এড়িয়ে সারাটা দিন কাটলেও রাতের বেলা, হোস্টেলে বাঘের হরিণ শিকারের মত। নিজের নিজের কলেজে নতুন নতুন বন্ধু বান্ধব তৈরি হচ্ছে- নিজেদের অভাব অভিযোগ, একটু প্রাণ খুলে কথা বলা। কত দিনে ফ্রেশার্স ওয়েলকাম হয়! রাগিং-এর হাত থেকে মুক্তি পায়।
আস্তে আস্তে কলেজেরও চাপ বাড়তে থাকে। ল্যাব সেস্যানাল করতে করতে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে গাঢ়ত্ব আরো বাড়ে। অদ্রিজা-ইকবালের কথা বলার সময়ও আস্তে আস্তে কমতে থাকে। অন্ততপক্ষে সপ্তাহান্তে একবার কথা হয়। অবশ্য দুর্গাপুরের বাড়িতে ফিরলে দেখা হয়। এইভাবেই প্রথম বছরটা কেটে গেল।
অদ্রিজার যখন সেকেন্ড ইয়ার, ইকবাল তখনো মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ারে। ইকবালের আপার বিয়ে। গরমের ছুটিতে। ইকবাল, অদ্রিজা, অদ্রিজার দাদা, লাভলী আপা, মিতা, কোচিং এর আরো অনেক বন্ধু-বান্ধব সবাই আমন্ত্রিত। রাত জেগে বিয়ে, কলকাতায় বাসে করে বৌভাত খেতে যাওয়া,খুব আনন্দ উপভোগ।
গত বছর স্কলারশিপের টাকা জমিয়ে, ইকবাল ভ্যালেন্টাইন ডে-তে সোনার হার্ট শেপের উপর আই লেখা একটা ছোট্ট পেন্ডেন্ট অদ্রিজাকে উপহার দেয়। অদ্রিজাও উপহার দিয়েছিল, একটা ভালো পার্কার পেন। অদ্রিজার পড়ার টেবিলের উপর রাখা ছিল পেন্ডেন্টের বাক্সটা, মা জিজ্ঞাসা করতে ও কলেজের অন্য বান্ধবীরা নাম দিয়ে চালিয়ে দেয়।
যথাসময়ে ইকবালের বাবা রিটায়ার করায় পুরো ফ্যামিলি কলকাতাতে শিফ্ট করে যায়।
অদ্রিজার জন্য ইকবালের মন ছটফট করে, কিন্তু কোথায় উঠবে? কোথায় থাকবে? শত চিন্তায় ওর আর দুর্গাপুর যাওয়া হয়ে ওঠে না। অদ্রিজার কথা মনে পড়লে উপহারের পেনটা হাতে করে নাড়াচাড়া করে, আবার রেখে দেয়।
অদ্রিজার ফাইনাল ইয়ার। ক্যাম্পাসিং-এ চাকরি পেল হায়দ্রাবাদে। যদিও মা-বাবাকে ছেড়ে কলেজ লাইফটা হোস্টেলে কাটিয়েছে কিন্তু এরপর দুর্গাপুর ছাড়তে হবে। খুব ছোটবেলাতে মোবাইল হাতে না পেলেও কলেজ লাইফে মোবাইল ছাড়া এক মিনিট চলে না। জেড জেনারেশন। জন্মভূমির থেকেও মোবাইল, বন্ধুবান্ধব, প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার উপরই আকর্ষণ অনেক বেশি। নতুন নতুন চাকরি, নতুন বস। সবকিছু মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা।
অদ্রিজার চাকরি করাও বছর দুয়েক হয়ে গেল। ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক কমে গেছে।বাড়ি থেকে বাবা মা বিয়ের কথা বলছেন। ঠারে ঠোরে অদ্রিজার বাবা-মা ইকবালের কথা জানলেও মন থেকে একেবারে সায় ছিল না, ইকবাল মুসলমান ধর্মাবলম্বী হওয়ায়।
এদিকে অদ্রিজার চাকরির নতুন বস, অতুলের খুব পছন্দ অদ্রিজাকে। অদ্রিজার বাবা-মা এখন হায়দ্রাবাদে অদ্রিজার কাছে থাকেন। অতুল একদিন পৌঁছে যায় অদ্রিজার বাড়ি, অদ্রিজার বাবা-মায়ের কাছে অদ্রিজাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। অদ্রিজার বাবা মায়ের না বলার কিছু ছিল না, খুব সহজেই রাজি হয়ে গেলেন।
আস্তে আস্তে বিয়ের দিনে এগিয়ে এলো। অদ্রিজার কেবলই মনে পড়ে ইকবালের কথা। কিন্তু নিরুপায়, কিছু করার নেই। কেবল চুপচাপ হয়ে যায় আর ভিতরে ভিতরে কাঁদতে থাকে তবু বাবা-মায়ের অবাধ্য হতে কোনদিন সে শেখেনি। বাবা মাকে সে কষ্ট দিতে চায় না। অবশেষে বিয়ের দিন হাজির হলো...পুরোনো সিম, ইকবালের দেওয়া হার্ট পেন্ডেন্ট- একসাথে অদ্রিজা একটি বাক্সে ভরে আলমারির সিক্রেট চেম্বারে যত্ন করে তুলে রেখে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসে। অগ্নিসাক্ষী রেখে অতুল, অদ্রিজার চার হাত এক হল।
ইকবাল তখনো মেডিকেল পড়াশোনায় গভীর নিমগ্ন। এমবিবিএস শেষ করে এমডির জন্য পড়াশোনা। খুবই ব্যস্ত। অদ্রিজার খবর সেইভাবে নেওয়া হয় না। বাবা ও মারা গেছেন। হঠাৎ একদিন অদ্রিজা কে ফোন করতে রিপ্লাই পেল "this number doesn't exist". ইকবালেরও রাগ হচ্ছে অদ্রিজা আর ফোন করে না। কয়দিন পরে অবশ্য বন্ধু মারফত অদ্রিজার বিয়ের খবর পেয়েছিল। অদ্রিজাকে হৃদয়ে রেখে পড়াশোনাকে বেশি আপন করে বেছে নিল।
===================
লেখিকা- আজিজ উন নেসা