
ছোটগল্প ।। শূন্যতার গভীরে ।। শুভ্রেন্দু রায় চৌধুরী
শূন্যতার গভীরে
শুভ্রেন্দু রায় চৌধুরী
শনিবার সৌরিকের অফিস বন্ধ থাকে। তবু প্রতি শনিবারই ও অফিস ছোটে। কোনও না কোনও কাজ থাকে। সেগুলো সেরে ফিরে আসে লাঞ্চের পর। লাঞ্চ খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমোয়। তারপর ল্যাপটপ খুলে বসে ক্লায়েন্টদের মেলের জবাব দিতে সন্ধে হয়ে যায়। তারপর ইচ্ছে না করলেও গিন্নি ও বছর চারেকের কন্যাকে নিয়ে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতে হয়। বেশিরভাগই কোনও না কোনও মলে কারণ ওর গিন্নির মলে মলে ঘোরার একটা বাতিক আছে। এখন ওর কন্যাটিরও এই মলে ঘুরে ঘুরে নেশা ধরে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গিয়ে ওর কন্যাটি তেমন স্বস্তি বোধ করে না, খালি ছটফট করে, যদি না সে বাড়িতে তার বয়সি কোনও বাচ্চা থাকে।
সল্টলেকের জি সি ব্লকে ওদের ফ্ল্যাট। তাই বাইপাসের ধারে মানি স্কোয়ার আর বাড়ির কাছেই সিটি সেন্টার ওয়ানে ওদের যাওয়া হয় বেশি। কখনও সখনও সাউথ সিটি মল বা নিউ টাউনের কোনও মলে ওরা হাজির হয়। আর রাতের খাওয়া সেখানেই সেরে বাড়ি ফেরে।
আজ ওরা সিটি সেন্টার ওয়ানে হাজির হয়েছে সন্ধে সাড়ে ছ'টা নাগাদ। জরুরি যে সব জিনিস কেনার ছিল সেগুলো চট জলদি কিনে ফেলল। তারপর এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে লাগল। মেয়ের বায়নার তো আর শেষ নেই। এটা কিনে দাও ওটা কিনে দাও। এ ব্যাপারে ওর গিন্নি বেশ কড়া। ধমকের পর ধমক লাগায়। কখনও আবার আইসক্রিম টাইসক্রিম কিনে দিয়ে মেয়ের মুখ বন্ধ করতে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। মেয়ের বায়না তীব্র হওয়ার আগেই তাকে একটা আইসস্টীক ধরিয়ে দেওয়া হল। আপাতত সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে আর কোনও কথা বলবে না।
একটা শাড়ির দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। একটা বেশ আন্-কমোন সুন্দর শাড়ির দিকে সৌরিকের চোখ আটকে গেল, দাঁড়িয়ে পড়ে গিন্নিকে বলল, কী গো পুজোর জন্য এই শাড়িটা কিনবে নাকি? গিন্নি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে কেউ বলে উঠল, স্যর আপনি!
ফিরে তাকাতেই চমকে উঠল, দেখল, ওর প্রোজেক্টের সব থেকে ব্রিলিয়ান্ট সদস্য নন্দিনী দাঁড়িয়ে আছে। তাকে সব সময় অফিস স্যুটেই দেখেছে, সঙ্গে পনিটেল চুলে। আজ একেবারে ক্যাজুয়াল ড্রেসে আর খোলা চুলে। একটা নেভি ব্লু কালারের ট্র্যাক স্যুট পরেছে, জ্যাকেটের কলারে সাদা পাইপিং আর ট্রাউজারের দু'দিকেই লম্বালম্বি সাদা পট্টি। পায়ে নেভি ব্লু কালারের স্নিকার্স যার সোলটা সাদা। হাতে একটা ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগ। হালকা লিপস্টিক ছাড়া মুখে আর কোনও প্রসাধনী নেই।
- এ কী, নন্দিনী তুমি এখানে? কিছু কিনতে এসেছো? অল্প হেসে সৌরিক জিগ্যেস করল।
- হ্যাঁ স্যর, একটা জিনস্ কিনতে এসেছি, কেনাও হয়ে গেছে। একটু অলটার করতে দিয়েছি, তাই এদিক ওদিক ঘুরে অপেক্ষা করছি। মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল নন্দিনী।
- ও তাই। গিন্নির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সৌরিক বলল, মিট মাই ওয়াইফ রাইমা আর এটা হল আমাদের কন্যা শ্যামৌপ্তি।
মুখে হাসি বজায় রেখে ওর গিন্নিকে হাত জোর
করে নমস্কার করল নন্দিনী আর মেয়ের গাল টিপে আদর করে বলল, ও মা, কী মিষ্টি
দেখতে গো তোমায়। কী যেন নাম বলল তোমার?
- শ্যামৌপ্তি। তাড়াতাড়ি নামটা সৌরিকই জানাল, অবশ্য ওর ডাক নাম তিন্নি।
- শ্যামৌপ্তি! বাব্বা, বেশ আনকমোন নাম তো!
- বলতে পারো। সৌরিক উত্তর দিল, আসলে ও হওয়ার পর ওর একটা আনকমোন নাম খুঁজছিলাম আমরা। আমার গিন্নির খুব বাংলা সিরিয়াল টিরিয়াল দেখার অভ্যেস আছে। কোনও একটা সিরিয়ালের এক অভিনেত্রীর নাম শ্যামৌপ্তি। সেই নামটা গিন্নি বলতেই আমার ভালো লেগে গেল।
এতক্ষণ রাইমা আর তিন্নি ওদের কথাবার্তা শুনছিল। এবার রাইমা বলে উঠল, ও, তুমিই নন্দিনী! তোমার কথা অনেক শুনেছি ওর কাছে। তবে ও কখনও বলেনি, তুমি এত মিষ্টি দেখতে। তা, থাকো কোথায় তুমি?
- সেক্টর টু-তে, একটা পেয়িং গেস্ট অ্যাকোমডেশনে থাকি।
- কেন, তুমি কলকাতার মেয়ে নও! ভুরু কুঁচকে রাইমা জানতে চাইল।
- না না ম্যাম। জোরে জোরে ঘাড় নাড়ল নন্দিনী, আমি বোকারোর মেয়ে। আমার বাবা-মা বোকারোতে থাকেন।
- ও, তাই। কথোপকথন শেষ করতে ব্যস্ত হল রাইমা মেয়ের টানাটানিতে। তিন্নি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছিল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ওদের কথাবার্তা শুনে। নন্দিনী লক্ষ্য করেছিল সেটা। তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, স্যর, আমার জিনস্ ডেলভারির সময় হয়ে গেল। আমি এলাম ম্যাম। খুব ভালো লাগল আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে। চলি স্যর!
কথা না বলে সৌরিক হাত তুলে সম্মতি জানাল। ঝুঁকে পড়ে তিন্নির আরেকটিবার গাল টিপে হাঁটা লাগাল নন্দিনী।
- মেয়েটা কিন্তু খুব মিষ্টি। রাইমা সৌরিকের দিকে তাকাল, আবার স্মার্টও। ওর স্মার্টনেশ দেখে আমি আগেই বুঝেছিলাম, ও কলকাতার মেয়ে নয়।
- হুঁ। গম্ভীর হয়ে সৌরিক রাইমার দিকে তাকাল, চলো, এবার আমরা কিছু খেয়ে নিই! বাড়ি ফিরতে হবে তো!
একটা ফুড স্টলে কিছু খেয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল ওরা। গাড়ির পেছনে বসে তিন্নি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল। কে গো ওই আন্টিটা, বাবার অফিসে কী করে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠে রাইমা ধমকে বলল, আর নয় তিন্নি, এবার থামো।
মেয়ে চুপ করতেই সৌরিকের দিকে তাকিয়ে রাইমা বলল, আচ্ছা, তুমি তো অনেকবার এই নন্দিনীর কথা বলেছো আমায়। বলেছো মেয়েটি ভীষণ মেধাবী, তোমার টিমের অ্যাসেট। কিন্তু কখনও তো বলোনি, মেয়েটি এত সুন্দরী! দেখতে অনেকটা এক দক্ষিণী অভিনেত্রীর মতো যে এখন বলিউড দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, কী যেন নাম, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, রশ্মিকা, রশ্মিকা মান্ধানা ...
গাড়ি চালাতে চালাতে গিন্নিকে থামিয়ে বিরক্ত হয়ে সৌরিক বলল, শোন, তথ্যপ্রযুক্তির কাজে সৌন্দর্য ম্যাটার করে না। শুধু মেধাই ম্যাটার করে। তাই সেটাই বলেছি।
- আরে, তুমি আমার কথায় এতো বিরক্ত হচ্ছো কেন বলতো! ঠোঁট উল্টে বিরক্তি প্রকাশ করল রাইমা। গিন্নির ঠোঁট উল্টোনো তির্যক মন্তব্যে একটু রহস্যের গন্ধ পেল ও। তবে কি নন্দিনী আর ওর সামান্য কথাবার্তায় রাইমা এমন কিছু ইঙ্গিত পেয়েছে যে নন্দিনীর সঙ্গে ওর পেশাগত সম্পর্কের বাইরে অন্য কোনও সম্পর্ক আছে! ও শুনেছে, মেয়েদের ষষ্ঠেন্দ্রীয় নাকি এতটাই প্রখর যে তারা সামান্য ঘটনার মধ্যেও অনেক কিছুই দেখতে পায় যা পুরুষদের চোখে ধরাই পড়ে না। কথাটা ভেবেই ঘামতে শুরু করল। গাড়িতে স্পীড বাড়িয়ে বাড়িতে পৌঁছে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে।
রাতে আর কোনও কথা হল না ওদের। রবিবার সারাদিন ল্যাপটপে মেল দেখে, মোবাইলে কথা বলে আর শুয়ে বসে কেটে গেল। সোমবার সকাল হতেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেয়েকে রেডি করে স্কুলের বাসে তুলে দিতে গেল রাইমা। এরই মধ্যে খবরের কাগজে এক ঝলক দিয়েই অফিস যাওয়ার প্রস্তুতিতে লেগে পড়ল ও। আর মেয়েকে বাসে তুলে দিয়ে এসে ওর জন্য ব্রেকফাস্ট বানাতে কিচেনে ঢুকল রাইমা। কিছুক্ষণ পর ব্রেকফাস্ট সেরে অফিস রওনা হয়ে গেল ও।
প্রতিদিনই অফিস পৌঁছানোর পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওর টিমের অন্তত দু'জন এসে ওকে গুড মর্নিং জানিয়ে যায়। নন্দিনী আর সৃজিত। কিছু আলোচনা করার থাকলে বসে যায় তারা। কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম ঘটল। শুধু সৃজিতই এল। নন্দিনী এল না। অথচ সৃজিত জানাল, নন্দিনী অফিস এসেছে। তবে কি কোনও অজানা তথ্য জেনে নন্দিনী অস্বস্তিতে পড়েছে! তাই আসেনি! না কি কোনও আর্জেন্ট কল অ্যাটেন্ড করতে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে! একটু অপেক্ষা করা যাক। পরে না হয়, ও নিজে গিয়েই খোঁজখবর নিয়ে আসবে।
ল্যাপটপ খুলে বসল সৌরিক। মেল চেক করতেই দেখল, জার্মানির যে সফ্টওয়্যার কোম্পানির হয়ে ওদের কোম্পানি একটা বড় ইমার্ট প্রোজেক্টে কাজ করছে, সেই কোম্পানি জানাচ্ছে, ঠিকঠাক ইম্পিমেন্টেশনের পরও ওদের তৈরি সফ্টওয়্যারে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে যেগুলো সংশোধন করতে ওদের কাউকে জার্মানি আসতে হবে। সেই মেলেই কী কী সমস্যা হচ্ছে তার বিবরণও দেওয়া আছে।
এই প্রোজেক্টের পুরো দায়িত্ব, ডিজাইন থেকে শুরু করে ইম্পিমেন্টেশন, ওর কাঁধেই ছিল। যদিও ওর প্রধান দুই সহযোগী ছিল এই প্রোজেক্টে, নন্দিনী আর সৃজিত যারা গ্রাউন্ড লেভেলে কাজ করেছিল রাতদিন এক করে। ওদের তিনজনকেই জার্মানি যেতে হত। তবে নন্দিনীকে বারবার কারণ সফ্টওয়্যারটির খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে ছিল। তাই এই মুহূর্তে নন্দিনী ছাড়া আর কারও পক্ষেই সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব নয়। তার সঙ্গে আলোচনা করতেই হবে। প্রয়োজনে তাকে আবার জার্মানি পাঠাতে হবে। তাই মেলটার প্রিন্ট আউট নিয়ে ইন্টারকমে নন্দিনীকে ডেকে পাঠাল।
- আসবো স্যর? ওর চেম্বারে ঢোকার অনুমতি চাইল নন্দিনী। তার সারা মুখে আষাঢ়ের মেঘ।
- এসো এসো। হাতে ইশারা করল সৌরিক, এতো গম্ভীর কেন? শরীর ঠিক আছে তো!
- হ্যাঁ স্যর।
- কিন্তু এমন গোমড়া মুখে তো ম্যাডামকে কখনও দেখিনি! একটু মশকরা করে কথাটা বলেই একেবারে কাজের কথায় চলে এল, এই দেখো জার্মানি থেকে মেল এসেছে, কী সব সমস্যা হয়েছে আমাদের সফ্টওয়্যারে।
- দেখি স্যর। সামনের চেয়ারে বসতে বসতে ওর হাত থেকে মেলটা নিল নন্দিনী।
গম্ভীর হয়ে মেলটা পড়ে নন্দিনী বলল, এগুলো সবই মনে হচ্ছে সফ্টওয়্যার বাগ স্যর, যেগুলো আমাদের বার্নিং প্রোসেসে ধরা পড়েনি। কোডিংগুলো মাইনিউটলি দেখে বাগ ফিক্স করতে হবে।
- এখানে বসে করা যাবে? মাথাটা হেলিয়ে জিগ্যেস করল সৌরিক, না, জার্মানি যেতে হবে?
- গেলে ভালো হয় স্যর।
- তাহলে তুমি আর সৃজিত জার্মানি চলে যাও। আমি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে বলে সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কয়েকদিনের মধ্যে যেতে পারবে তো?
- কোনও সমস্যা নেই স্যর। বড় করে শ্বাস নিল নন্দিনী, তবে আমি ভাবছিলাম, কয়েকদিনের জন্য বোকারো যাবো।
- হুঁ, তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে, তুমি খুব ক্লান্ত। মন ঠিক নেই। অল্প হেসে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে তোমার?
- না স্যর তেমন কিছু নয়। এবার এক টুকরো হাসির ঝিলিক দেখা দিল নন্দিনীর ঠোঁটে, ঠিক আছে স্যর, জার্মানি থেকে ঘুরে এসে বোকারো যাবো। আপনি ব্যবস্থা করুন। এখন আমি আসি স্যর।
মেলটা নিয়ে নন্দিনী ওর চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল। এক অদ্ভুত ধন্দে পড়ল ও। প্রায় দু'বছর হল ওর টিমে কাজ করছে নন্দিনী। ভুবনেশ্বরে কে.আই.টিতে ওদের কোম্পানির ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্টে সিলেক্ট হয়ে ওর টিমে জয়েন করে। প্রথম দিনেই তার সঙ্গে কথা বলে ও অভিভূত হয়েছিল। তার হাসি খুশি মুখ, বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা আর ঝলমলে চেহারা দেখে কারই বা না তাকে ভালো লাগবে! তারপর প্রোজেক্টের কাজ যত এগিয়েছে প্রতি পদক্ষেপে তার অসাধারণ মেধা, স্মরণশক্তি আর বুভুৎসা দেখে মুগ্ধতায় ভেসে গিয়েছে। যে কোনও ব্যাপার একবারের বেশি দুবার বলতে হত না তাকে। এত সব গুণের ছটায় কবে যে ওর ভাবনার জগতে নন্দিনী ঢুকে পড়েছে, ও জানতেও পারেনি। এরপর যত দিন গিয়েছে নন্দিনীর হাসি খুশি বুদ্ধিদীপ্ত মুখটা দেখতে ওর ছটফটানি বেড়েছে। তাই আজ সেই সদা হাস্যময়ী মেয়েটাকে মনমরা দেখে হাজারটা প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ওর অন্তরের ভেতরটা!
তবে কি নন্দিনী ও বিবাহিত জেনে মর্মাহত হয়েছে! ওকে নিয়ে সে কি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল! না, না, তা কেন হবে! কাউকে ভালো লেগে শ্রদ্ধা করা কখনও কোনও স্বপ্নের জন্ম দেয় না। কিন্তু তাই যদি হয়, তবে ও কেন দু'বছর নন্দিনীর সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ হয়েও তাকে একবারও বলতে পারেনি যে, বউ বাচ্চা নিয়ে ওর একটা সুখী পরিবার আছে! নন্দিনী এ ব্যাপারে ওকে কখনও জিজ্ঞেস করেনি বলেই কি সত্যটা বলেনি তাকে! না কি ওর মনেও কোনও স্বপ্নের চারা অজান্তেই বড় হচ্ছিল!
ধূর, এ সব কী ভাবছে ও। নিজের দুর্বলতার মাঝে অন্যের দুর্বলতা খুঁজে ও কি কিছু প্রমাণ করতে চাইছে! একদিন নন্দিনীর গোমড়া মুখ দেখে কেন ভাবছে, সেও ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে! তবে এ কথা কী করেই বা ও অস্বীকার করে, নন্দিনী ওর সঙ্গে কথা বলে খুব অন্তরঙ্গ হয়ে আর সে যখন ওর দিকে তাকায় তখন তার চাউনিতে থাকে অদ্ভুত উষ্ণতা। অবশ্য তার মানে এ নয় যে, নন্দিনী ওর প্রতি আসক্ত।
না, না, এ সব হাবিজাবি ভেবে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সঙ্গে কথা বলে নন্দিনী আর সৃজিতের জার্মানি যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ভিসা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। দু'জনেরই মাল্টিপল্ এনট্রি ভিসা আছে। শুধু তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ফোন করতেই তারা জানতে চাইল, কবেকার টিকিট কাটতে হবে। ও জানিয়ে দিল এ সপ্তাহের যে কোনওদিন। একটু পর তারা জানাল, কলকাতা থেকে দিল্লি ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে ডুইসেলডর্ফ যেতে কোনও সমস্যা হবে না। নন্দিনীকে ফোনে সে কথা জানিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সঙ্গে কথা বলতে বলল। কিছুক্ষণ পর নন্দিনী ফোন করে জানাল, সৃজিতের বুধবার কিছু কাজ আছে বলে তারা বৃহস্পতিবার জার্মানি রওনা হবে।
সেদিনই বিকেলে তাদের যাওয়ার সেডিউল জেনে জার্মান কোম্পানিটিকে মেল করে জানিয়ে দিল আর অনুরোধ করল, দু'জনের থাকার আর এয়ারপোর্ট থেকে তাদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। পরের দু'দিন নন্দিনী আর সৃজিতের সঙ্গে সমস্যাগুলো নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করল। সেডিউল মতো নন্দিনী আর সৃজিত জার্মানির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল বৃহস্পতিবার বিকেলে।
দিন দশেক লাগল সমস্ত সমস্যার সমাধানে। প্রতিদিনই ফোনে বা মেলে ওকে কাজের অগ্রগতির কথা জানাতো নন্দিনী। এ ছাড়া ও নিজেও প্রতিদিন জার্মান কোম্পানিটির কোর্ডিনেটরকে মেল করে খবরাখবর নিত। তারা খুব খুশি নন্দিনী আর সৃজিতের কাজে। কাজ শেষ করেই দু'জনে ফিরে এল।
ফিরে আসার পরের দিন সকালে সৌরিকের সঙ্গে দেখা করতে এল নন্দিনী, আসবো স্যর!
- আরে নন্দিনী, এসো এসো। এক গাল হেসে উঠে দাঁড়াল সৌরিক, কনগ্র্যাচুলেশন, তোমাদের কাজে ওরা খুব খুশি। আমি ভাবতেও পারিনি, দশ দিনের মধ্যে এত সুন্দরভাবে তোমরা কাজটা শেষ করে ফিরে আসবে। আরে, দাঁড়িয়ে রইলে কেন! বসো।
- থ্যাংক ইউ স্যর। গম্ভীর মুখে নন্দিনী বসলো।
- নন্দিনী, তোমার কী হয়েছে বলতো! কথা ক'টা বলতে সৌরিকের গলা কেঁপে উঠল।
- আমি তো ঠিক আছি স্যর! সপ্রতিভ হতে চেষ্টা করল নন্দিনী, আসলে গত দশদিন জার্মানিতে সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত কাজ করেছি তো, তাই একটু ক্লান্তি লাগছে।
- তা'লে আজ এলে কেন? অভিভাবকের সুরে বলল সৌরিক, আমাদের কোম্পানির রুলেই আছে যে, এক সপ্তাহের বেশি ফরেন আসাইনমেন্ট থেকে ফিরে একদিন স্পেশাল লিভ পায় সবাই। সৃজিত তো আজ আসেনি, কাল ফিরেই ফোন করে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল।
- তা জানি। চোখ নামাল নন্দিনী, আমি অন্য একটা কারণে এসেছি। আমি একটা অন্য চাকরি নিয়ে হায়দ্রাবাদ চলে যাচ্ছি স্যর। অফারটা অনেকদিন আগেই পেয়েছি, নেবো কী নেবো না ঠিক করতে পারছিলাম না।
- সে কি! আচমকা বাজ পড়ার আওয়াজে মানুষ যেমন চমকে ওঠে, তেমনভাবেই চমকে উঠল সৌরিক। একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, তোমার সঙ্গে ডিটেলে কথা না বলে তোমাকে আমরা কী করে ছাড়ব বলো! আমাদের তো দেখতে হবে, তুমি যা অফার পেয়েছো, আমরা তার থেকে বেটার প্যাকেজ দিতে পারি কি না!
- না স্যর, তার কোনও প্রয়োজন পড়বে না। চোখ তুলে তাকাল নন্দিনী, যে প্যাকেজ নিয়ে যাচ্ছি, সেটা এমন কিছু আহামরি নয়। আপনারা চাইলে তার থেকে অনেক ভালো পোস্ট আর স্যালারি দিতে পারেন।
- তার মানে তুমি ঠিকই করে ফেলেছো! কথা ক'টার মধ্যে একটু আর্তনাদের সুর ঝলসে উঠল, কিন্তু কেন নন্দিনী! হঠাৎ এমন সিন্ধান্ত নেওয়ার কারণ কী!
- হঠাৎ নয় স্যর। ঘাড় নাড়তে লাগল নন্দিনী, কলকাতায় থাকতে আর ভালো লাগছে না।
- সেটাই কারণ! হতাশার সুর বেজে উঠল সৌরিকের গলায়, কিন্তু তুমি তো জানো তোমাকে তিন মাসের নোটিস দিতে হবে, আর না হয় তিন মাসের স্যালারি কোম্পানিকে দিয়ে যেতে হবে।
- জানি স্যর। একটু কঠোর হল নন্দিনীর কণ্ঠস্বর, এ মাসের স্যালারি তো ডিউ হয়েই গিয়েছে। আর দু'মাসের টাকা আমি চেকে পেমেন্ট করে দেবো কোম্পানিকে। চেকটা এনক্যাশ হওয়ার পরই আপনারা আমার রিলিজ অর্ডার দেবেন। আমি এক সপ্তাহের জন্য বোকারো যাবো, তারপর কলকাতা থেকেই হায়দ্রাবাদ যাবো। যেদিন যাবো সেদিন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে রিলিজ অর্ডারটা নিয়ে যাবো। এই আমার রেজিগনেশন লেটার স্যর।
বজ্রাহত মানুষের মতো স্থবির হয়ে গিয়েছিল সৌরিক। কী বলবে বুঝে পাচ্ছিল না। খেয়ালও করেনি নন্দিনী যখন ঢুকেছিল তার হাতে একটা খাম ছিল। কল্পনাও করতে পারেনি, নন্দিনী এমন হঠাৎ করে চাকরি ছেড়ে চলে যাবে। এখন তাকে আটকায় কী করে!
- স্যর, আপনি প্লিজ আমার রেজিগনেশন লেটারটা অ্যাক্সেপ্ট করে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পাঠিয়ে দেবেন। শ্বাস নিতে একটু থামল নন্দিনী, আমার তো আর কাউকে কিছু হ্যান্ডওভার করার নেই। আমি জার্মানিতে থাকতেই সৃজিতকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি। ওর সঙ্গে একবার কথা বলে দেখতে পারেন।
- আমি যে কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না। এ তো বিনা মেঘে বজ্রপাত! কথাগুলো বলতে বলতে অস্বাভাবিভাবে গলা কেঁপে উঠল সৌরিকের, তবে আমার কোনও ব্যবহারে বা আচরণে তুমি যদি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো তাহলে আমার থেকে বেশি দুঃখ আর কেউ পাবে না। তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ারও কোনও ভাষা থাকবে না আমার।
- না, না, এমন কথা আপনি একবারও বলবেন না স্যর। কৃতজ্ঞতা আর প্রত্যয় ঝরে পড়ল নন্দিনীর স্বরে, এই দু'বছরে আপনার কাছ থেকে যা শিখেছি যত কিছু জেনেছি তা তো আমার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য বিরাট সম্পদ হয়ে থাকবে। আপনি ভালো থাকবেন স্যর। ম্যাম আর আপনার সুন্দর মিষ্টি মেয়েকে ভালো রাখবেন। আমি যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করব। বাই স্যর।
হাত জোর করে নমস্কার করে ধুমকেতুর মতো বেরিয়ে গেল নন্দিনী ওর চেম্বার থেকে। এতো দ্রুত বেরিয়ে গেল যে কোনও সুযোগই পেল না ও তাকে তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানানোর।
এক অদ্ভুত শূন্যতার গভীরে ডুবে গেল ওর সারা সত্তা। ছাত্রজীবনে খুব কবিতা পড়ত। ওর এক প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার কয়েকটি ছত্র মনে পড়ে গেল -
"শূন্যতাই জানো শুধু?
শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
একথা জানো না?"
তখন এ ক'টা ছত্রের অর্থ বোঝার মতো মন বা বুদ্ধি কিছুই ছিল না ওর, বোঝার চেষ্টাও করেনি। আজ এর অর্থ মর্মে মর্মে বুঝতে পারল জীবন থেকে নন্দিনীকে চিরতরে চলে যেতে দেখে।
-------------------------------
Subhrendu Ray Chaudhuri
C1/202 Mangalam Park
14 Ho Chi Minh Sarani
Kolkata - 700 034