
নিবন্ধ: আশাপূর্ণা দেবী ও তার ট্রিলজি প্রসঙ্গ।। দীপক পাল
আশাপূর্ণা দেবী ও তার ট্রিলজি প্রসঙ্গে
দীপক পাল
আমার অত্যন্ত প্রিয় সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয়া শ্রীমতী আশাপূর্ণা দেবী। তিনি ঊনিশশো নয় সালের জানুয়ারী মাসে উত্তর কলকাতার পটলডাঙায় মামার বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু সেই যুগে নারীদের বিদ্যাশিক্ষার বিশেষ কোন সুযোগ ছিল না। তিনিও সম্ভবত সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু তার শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল অদম্য। এই সময় তার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ জন্মায়।। তার মায়ের উৎসাহ ও ইচ্ছায় তিনি হাতে কলম ধরেন। তার লেখা প্রথম একটি কবিতা ' শিশুসাথী ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি ছোটদের জন্য কবিতা লিখে পুরস্কারও পান। ছোটদের জন্য লেখা তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ঊনিশশো চল্লিশ সালে। বড়দের জন্য লেখা তার প্রথম উপন্যাসের নাম 'প্রেম ও প্রয়োজন'। কৃষ্ণনগর নিবাসী কালিদাস গুপ্তের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার মৃত্যু হয় ঊনিশশো পচানব্বই সালের জুলাই মাসে। তার লেখনী সমাজের অমানবিক দিকগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে তুলে ধরেছেন আমৃত্যু।
আশাপূর্ণা দেবী উপন্যাস 'প্রথম প্রতিশ্রুতি', 'সুবর্ণলতা' ও 'বকুল কথা' এই তিনটি উপন্যাসের মাধ্যমে একটি পরিবারের প্রধান নারী চরিত্রগুলো পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থার অন্যায়ের প্রতিবাদে ভাস্বর। সত্যবতী চেয়েছিল তার মেয়ে সুবর্ণলতা, তার ছেলের সাথে শিক্ষা দীক্ষায় অনেক বড় হয়ে উঠুক। তাই স্বামীর অনিচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে স্কুলে ভর্তি করান। ভাই বোন একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা শুরু করলো। সত্যবতী খুব খুশী। তার স্বামীর চিন্তা ভাবনা ছিল সম্পূর্ণ অন্য। সে ভাবতো মেয়ে লেখাপড়া করে কি করবে। বিয়ের পরে সেই তো শ্বশুরবাড়ীতে ভাতের হাঁড়ি ঠেলতে হবে। তিনি সত্যবতীর অগোচরে দেশের বাড়ীতে গিয়ে নিজের মায়ের সাথে আলোচনা করে সুবর্ণর বিবাহের ব্যবস্থা পাকা করে আসেন। তারপর গ্রীষ্মের ছুটিতে সুবর্ণকে নিয়ে দেশের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে এক অতি রক্ষণশীল পরিবারের মেজ ছেলের সাথে বিবাহ দিলেন। তখন সুবর্ণর বয়স মাত্র নয়। এদিকে সত্যবতী তার স্বামীর প্রতি সন্তুষ্ট ছিল তার কথা শুনে সুবর্ণকে স্কুলে ভর্তি করে দেবার জন্য। তাই সত্যবতীর কোন সন্দেহ হয়নি তার মেয়েকে নিয়ে তার দেশের বাড়ী যাওয়ার। যখন সুবর্ণর বিবাহের কথা শুনলেন তখন তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। তিনি নিজেকে বঞ্চিত ও ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন। তার স্বামী ভেবেছিল ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হয় নি। সত্যবতীর ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারন। তার স্বামী তার তল খুঁজে পাননি কোনদিন। সত্যবতী সেদিনই পরিবারের প্রতি ঘৃণায় ও যন্ত্রণায় তৎক্ষণাৎ গৃহত্যাগ করে কাশী যাত্রা করেন। আর কোন দিন তিনি ফিরেও আসেন নি এই সংসারে।
এদিকে সুবর্ণলতা শ্বশুর বাড়ীতে পা দিল গৃহত্যগী মায়ের সন্তান বদনাম নিয়ে। সে বুঝতে পারে না মায়ের গৃহত্যগের কারণ। একারণে শ্বশুর বাড়ীতে তার মাথা নিচু হয়ে থাকে সবসময়। তার বাবাও বোধ হয় কথা মতো টাকা বাকি রাখায় সুবর্ণকে আর কোনদিন তার বাপের বাড়ীতে যেতে দেওয়া হয়নি। এমন কি তার বাবা মিষ্টি হাতে সুবর্ণকে একাধিক বার দেখতে আসলেও সুবর্ণকে তার বাবার কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। তার মন এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তার মন মুক্তি খোঁজে একটু খোলা আকাশ দেখতে, যেখানে প্রতিদিন সূর্য ওঠে, অস্ত যায়, রাতের তারা ভরা আকাশ আর চাঁদের আলো ও সর্বোপরি খোলা হাওয়া আর পথে মানুষের নিরন্তর চলা ফেরা। কিন্তু তার পরিবর্তে কি হলো? তার সামনে নিচের ঘরের একটা জানলা দিয়ে সে একদিন গলিটা দেখায় সে জানলা চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল। তার আগে ছাদে যাওয়ার দরজাটায় তালা পরেছিল। তার চতুর্দিকে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তোলা হলো শাশুড়ী ও দেওরদের বদান্যতায়। তার সঙ্গে চলে শাশুড়ী মুক্তকেশী ও স্বামী প্রবোধ আর দুই দেওরদের গঞ্জনা ও কুবাক্য। কিন্তু সুবর্ণলতার প্রতিবাদী মন মাথা উঁচু করে তার সেসব কথার জবাব দিত পাল্টা যুক্তি দিয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তায়। মুক্তকেশী তার কথার ওপর তর্ক পছন্দ করতেন না। সুবর্ণলতার মান সন্মান বোধ তাকে চুপ থাকতে দেয়নি কখনো। ব্যতিক্রম ছিল ভাসুর, বড়ো জা ও ননদের সাথে। তাদের সাথে ছিল খুব সদ্ভাব। সুবর্ণলতার জীবন বোধ তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে তার এই ক্ষুদ্র পরিসরে। কোন ভাবে কোন অবস্থায় কেউ তাকে দমাতে পারেনি।
কিন্তু সুযোগ আসে ঘুরে ফিরে। আবার চলেও যায় হঠাৎ। মুক্তকেশীর হলো এক গভীর ছোঁয়াচে রোগ - যক্ষা। এক সুবর্ণ ছাড়া সবাই ভয়ে দুরে সরে গেল। মুক্তকেশী নিজেই বলেছিল কাউকে কাছে না আসার জন্য। কিন্তু সুবর্ণর মূল্যবোধ তাতে সাড়া দিতে পারেনি। সে নেমে পড়লো শাশুড়ীর সেবা শুশ্রূষায়। সে বোঝে এই শরীর নিয়ে বিছানা থেকে ওঠা যায় না, তার আবার রান্না, খাওয়া দাওয়া ও সময়ে ওষুধ খাওয়া। তাই এক হাঁড়িতে দুজনের জন্য চারটি ভাত কোনরকমে ফুটিয়ে নিয়ে নিজে খেয়ে শাশুড়ীকে খাইয়ে, সাথে ওষুধ ও খাইয়ে দরজার বাইরে মাদুর পেতে নিজে শুয়ে পড়তো।
এরপর আর একবার অযাচিত ভাবে স্বাধীনতার মুক্তি উপভোগ করেছিল কিছু দিনের জন্য কলকাতায় প্লেগের মতো এক মহামারীর আক্রমণে মানুষের কলকাতা ছেড়ে পলায়নের সূত্রে। বাড়ীতে চার ভাই তাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদের সমেত কলকাতার বাইরে কোন নিরাপদ জায়গায় রেখে এলো। সুবর্ণকে প্রবোধ চাঁপতায় তার বোনের বাড়ীতে দিয়ে এলো। চাঁপতা তখন অজ পাড়াগাঁ। এই প্রকৃতির মাঝে আর সুবলার আন্তরিকতায় এক নতুন জীবনের স্বাদ পেল সুবর্ণর খাঁচায় বন্দি প্রাণ পাখিটা। সেই প্রাণ পাখিটা যে সবসময় খোলা আকাশে উড়তে চায়। এখানে কারো শাসন নেই কোন কটু কথা নেই। আছে অবাধ স্বাধীনতা যার জন্য সে প্রতিনিয়ত মাথা কুটে মরেছে। সেটা যে এখানে সহজলভ্য। কিন্তু এই সুখ বেশীদিন তার সইলো না। সন্দেহপ্রবণ প্রবোধ তার সুন্দরী স্ত্রীকে খুব বেশীদিন বাড়ীর বাইরে রাখতে চায়নি। সুবর্ণলতা পরাধীন ভারতের মুক্তির জন্য নিজের প্রাণ বলি দিতে প্রস্তুত হয়ে যারা দেশের হয়ে কাজ করে চলেছে তাদের সে খুব শ্রদ্ধা করত। তার মা যে তাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে। ননদের পাশের বাড়ীর অমূল্য ছিল সেরকমই একজনা । সে এখন গা ঢাকা দিয়ে সুবলার জিম্মায় থেকে খাওয়া দাওয়া করে। আবার হয়তো কোন দিন ডাক পড়লে গোপনে পালিয়ে যাবে। প্রবোধ সুবর্ণকে অমূল্যর বাড়ীতে দেখে রাগে অন্ধ হয়ে দুজনকেই মুখে যা নয় তাই বলে ও যাচ্ছেতাই গালাগালি দিতে থাকে ও সুবর্ণকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চায় কলকাতায়। রাগে ও অপমানে সুবর্ণ বলে, 'ঠাকুরপো দেশের কাজে যদি নারীদের সমান যোগদান না থাকে তবে এই পোড়া দেশের কিছুই হবার নয়'। অতঃপর খাঁচার পাখীর পুনরায় খাঁচায় গমন।
আর একবার সে একদিনের জন্য স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করেছিল। ননদ বাপের বাড়ীতে বেড়াতে এসে প্রবোধকে থিয়েটার দেখার বায়না করায় প্রবোধ চার বৌ ও বোন সহ 'বিল্ব মঙ্গল' থিয়েটারের টিকিট কেটে আনে। বাড়ীতে সে এক হৈ হৈ ব্যাপার। সুবর্ণর দেওর দুজন হাসাহাসি ও মজা করতে থাকায় প্রবোধ তাদের ধমক দিয়ে বলে 'লঘু গুরু জ্ঞান নেই তোদের?' শুনে সুবর্ণের ভাল লেগেছিল। প্রবোধ নিজে ফরাসডাঙার ধুতি পাঞ্জাবী পরেছিল। চলাফেরা যেন সেদিন তার রাজার মতো। তারপর নিচ থেকে ওপরে পাঁচ জনের জন্য হিংএর কচুড়ি আলুর দম খাস্তা গজা আর অমৃতি এবং পাঁচ বোতল লেমনেড প্রবোধ পাঠিয়েছিল। এদিকে বিরাজের সুগন্ধিওয়ালা পান চিবানোর সাথে থিয়েটার দেখার সুখ, এরকম একটা দিনের কথা কি ভোলা যায়। শুধু দিন কেন সেদিন সারা রাত ননদের পাশে শুয়ে গল্প করা। আর ভাবের ঘোরে একটা কবিতা লেখা। একটা নিজস্ব স্বাধীন দিন কেটেছে তার। তার একটা ডায়েরি ছিল। তাতে প্রায় প্রতিদিন সে কিছু না কিছু লিখতো। তার জেদ ছিল নিজের মেয়েদের শিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করার। তার জন্য সে নিজের স্বামী ও ছেলেদের রীতিমতো অনুরোধ করে ও পরে চাপ দিয়েও তাদের রাজী করাতে পারেনি। তাদের সবার এক কথা ওদের লেখাপড়া শিখিয়ে কি ওদের দিগ্গজ করবে? বিয়ে হলে তো সেই শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে। পারুলের মেধা ছিল পড়ার খুব ইচ্ছাও ছিল। পারুল ও বকুলকে সে পাশের বাড়ীর একটি ছেলের সাহায্যে ইস্কুলে ভর্তি করিয়েছিল তার জন্য স্বামী পুত্রদের কাছে তাকে নানা কথা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু সে দৃঢ়তার সাথে তার উত্তর দিয়েছিল। বলেছিল ' তাদের বাবা ভাইয়েরা যদি তাদের ইস্কুলে ভর্তি করার দায়িত্ব এড়িয়ে চলে তবে এছাড়া আর গতি কি?' ওদের লেখা পড়ার দরকার আছে বলে পারুল বকুল পড়বে যতদুর সম্ভব।
সুবর্ণলতা তার বাবার মৃত্যু সজ্জায় সবার আপত্তি সত্ত্বেও একাই গিয়েছিল। ভয়ে প্রবোধ আর একটা ফিটন নিয়ে শ্বশুর বাড়ী পৌছাল যদি ফিটন তাকে অন্যত্র নিয়ে যায়? সেখানে বাবার কাছে সুবর্ণকে লেখা ওর মা সত্যবতীর একটা চিঠি পায়। মা বাবাকেও একটা চিঠি দিয়েছিল। সুবর্ণর ছোড়দা সেই চিঠি দুটো সত্যবতীর নির্দেশ মতো তার মৃত্যুর পরে বাবাকে পৌঁছে দেয়। অভিমানে সে চিঠি সে বহুদিন খোলেনি। বাবার শ্রাদ্ধ শান্তি হবার পর একদিন দুপুরবেলা পড়ে মার প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা অবনত হলো। মা সত্যবতী কাশী গিয়ে সমাজের কড়া অনুশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মেয়েদের জন্য একটা ইস্কুল খুলে নারী শিক্ষার প্রচলন করেছিল। এবং ধীরে ধীরে সেই ইস্কুলের ছাত্রী সংখ্যা বেড়েছিল। ছোড়দা চাকরীর সূত্রে মোগলসরাইতে পোস্টিং ছিল। সে প্রায়ই মার কাছে যেত এবং ইস্কুলের দেখভাল করতো। সত্যবতী নারীশিক্ষার মাধ্যমে সেকালকে অতিক্রম করেছিল। তাইতো সে কালতীর্ণ। অন্যদিকে সুবর্ণ সেকালের ভুল চিন্তাধারার পরিবর্তন চেয়েছিল সবসময়। কখনো হেরেছে কখনো জিতেছে। কিন্তু কখনো তার লক্ষ্য থেমে থাকেনি। এক অতি রক্ষণশীল পরিবারে থেকে বিপরীতের প্রবল বাধা অতিক্রম করে একালে পৌঁছতে পারা ছিল অনেক কঠিন কজ। কিন্তু তার হাত ধরে এসেছিল এক নতুন কালের পদধ্বনি। সেটা স্পষ্ট বোঝা যায় তার মৃত্যুতে। হয়তো বা তার মৃত্যুর লগ্নে। দুই পরিবার আত্মীয় পরিজন চেনা জানা সবার হাজিরায়, সহায়তায় এবং অতি আন্তরিক বেদনায়।
শ্রদ্ধেয়া আশাপূর্ণা দেবী ছিলেন এক কালজয়ী লেখিকা। তার লেখা ট্রিলজির চরিত্রগুলো ছিল তার মনেরই প্রতিফলন। তাইতো তিনি কালের অতীত হয়েছেন। তিনি নারী স্বাধীনতা চেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু এটাও চেয়েছিলেন যে সেটা যেন সেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে না পৌঁছায়।
_________________________
Address:-
------------‐-
Dipak Kumar Paul
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata- 700104
Contact: 9007130853
------------------------------------