বর্তমান ভারতে আদর্শহীন রাজনীতির উপশমের একমাত্র দাওয়াই বিবেকানন্দের আদর্শ
তীর্থঙ্কর সুমিত
ভারতমাতার তিন রত্নবীর সন্তানেরা হলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস।১৮৬১ সালে ভারতমাতার কোল আলো করে জন্ম গ্রহণ করেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার সিমলা স্ট্রীটের দত্ত পরিবারের নরেন্দ্রনাথ দত্ত-যিনি স্বামীজী নামেই প্রাতঃস্মরণীয় এবং ১৮৯৭ সালে কটক শহরে জন্ম গ্রহণ করেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস।এই তিন রত্নবীরই দেশের জন্য সর্বশক্তি উজার করে দিয়েছেন নিজেদের দেশভক্তি ও লেখনীর মাধ্যমে।কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ একবার রোমারোঁঁলাকে বলছিলেন" যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও তবে বিবেকানন্দকে জানো।" আর নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস একবার স্বামীজী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন "শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট আমি যে কত ঋনী তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।চরিত্র গঠনের জন্য রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সাহিত্য আমি কল্পনাও করতে পারি না।" স্বামীজী বলেছিলেন "যখন আমি আমাদের দেশের প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তখন সমগ্র বিশ্বের পাশ্চাত্যের আদর্শ থেকে ভারতীয় আদর্শ কত পৃথক। পাশ্চাত্য দেশের বক্তব্য- " কর্ম করো, কর্ম করে তোমার শক্তি দেখাও।"ভারতের বক্তব্য-"দুঃখ কষ্ট সহ্য করে তোমার শক্তি দেখাও।"
বর্তমান ভারতের আদর্শহীন রাজনীতির উপশমের একমাত্র দাওয়াই স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ- তিনি বলতেন-"মানুষ চাই ,মানুষ চাই, আর সব হইয়া যাইবে।বীর্যবান, সম্পূর্ণ অকপট, তেজস্বী, বিশ্বাসী যুবক আবশ্যক।এইরূপ একশত যুবক হইলে সমগ্র জগতের ভাবস্রোত ফিরাইয়া দেওয়া যায়। জগতের সমুদয় ধনরাশির চেয়ে মানুষ হল সর্ব বৃহৎ মূল্যবান। তোমরা কি মানুষকে ভালবাসো? তোমরা কি দেশকে ভালোবাসো? তাহলে এসো, আমরা ভালো হওয়ার জন্য- উন্নত হওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি।" বর্তমানে আমরা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের যাত্রী।স্বাধীন হয়ছি ৭৪ বছর আগে, কিন্তু আমাদের দেশের সমস্যা কেবলই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। বর্তমান ভারতবর্ষে অভাব, অভিযোগ, দারিদ্র, দুর্নীতি ও অন্যায়ের চিত্র বড়োই ভয়ঙ্কর।দায়ী একমাত্র রাজনৈতিক উত্তাপ। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতির আশ্রয়স্থল।তার সাথে রয়েছে ধর্ম-বিদ্বেষের রাজনীতি। এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ সতর্ক বাণী দিয়ে বলেছিলেন -"ধর্ম সংহতি স্থাপনই
ভবিষ্যৎ ভারত গড়িবার সোপান।সেই মূল এক্যের দিকে লক্ষ রাখিয়া নিজেদের এবং জাতির কল্যাণের জন্য পরস্পরের সর্বাধিক মতভেদ ও অকিঞ্চিৎকর কলহ আমাদের বর্জন করিবার সময় আসিয়াছে। বহু বিকীর্ণ আধ্যাত্বিক শক্তি সমূহের সম্মেলন দ্বারাই ভারতের জাতীয় এক্যের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।" সম্প্রদায়গত ধর্মের নামে যে জাতি সৃষ্টির কথা বর্তমানে আমরা দেখছি- তা নিছক ভ্রম ছাড়া আর কিছুই না। "ওরা"," আমরা " র রাজনীতির শিকার হই আমাদের মতো সধারণ মানুষেরা। স্বামী বিবেকানন্দ সার্বিক উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন আজ থেকে দেড়শো বছর আগেই। তবে তাঁর পরিকল্পনায় প্রাধান্য পেয়েছিল ব্যক্তি-চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন।এটা সম্ভব হবে একমাত্র জনসাধারণের সার্বিক শিক্ষা দানের মাধ্যমে।
১৮৯৪ সালের ২০শে জুন আমেরিকা থেকে হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন " জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং তাহাদিগকে উন্নত করাই জাতীয় জীবন গঠনের পন্থা।" স্বামী শুদ্ধানন্দকে লেখা ১৮৯৭ সালের একটি চিঠিতে স্বামীজী লিখেছিলেন "জন-সাধারণকে যদি আত্ম নির্ভরশীল হতে শেখানো না যায়, তবে জগতের সমগ্র ঐশর্য ভারতের একটি ক্ষুদ্র গ্রামের পক্ষেও পর্যাপ্ত সাহায্য হবে না। "উন্নয়নের অপর নাম শিক্ষা" - এটাই স্বামী বিবেকানন্দ বারংবার সকলকেই বোঝাতে চাইতেন। ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতি স্তরের মানুষের সীমাহীন লোভ আর স্বার্থপরতা রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে তুলেছে।বর্তমানে প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতন্ত্রে সাধারণ নাগরিক ভোট দানের সময় ব্যতীত সর্বত্রই উপেক্ষিত থাকেন। বাড়তে থাকে রাজনৈতিক অনীহা, ক্ষোভ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো নানান জটিলতা। স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তা ভাবনায় এই সমস্যার সমাধানের পথ মেলে।১৮৯৭ সালে মাদ্রাজে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন-" এখন লোকদের নিজেদেরই সমাজের সংস্কার , উন্নতি প্রভৃতির চেষ্টা করতে হবে।সুতরাং যতদিন না লোকে শিক্ষিত হয়ে নিজেদের অভাব বোঝে, আর নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে প্রস্তুত ও সমর্থ হয় , ততদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।নতুন প্রণালী হল নিজেদের দ্বারা নিজেদের উন্নতি সাধন। দেশের সার্বিক উন্নতিতে বিবেকানন্দ কথিত এই চিন্তা ভাবনার বাস্তবায়ন আজ প্রবলরূপে প্রাসঙ্গিক।ব্যক্তি চরিত্রের বিকাশের মধ্যেদিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সম্ভব। নৈরাজ্যের বাতাবরণে দেশের সার্বিক গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। সেটি ভেঙে ফেলতে হলে জাতীয় জীবনে আত্মশক্তি ও সততার প্রয়োজন।অনেক পঞ্চাশ বছর আমরা পেরিয়ে এলেও তাঁর কথামতো "আগামী পঞ্চাশ বৎসর আমাদের গরীয়সী ভারত মাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা।" তবেই রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব হবে। ১৮৯৩ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় ধ্বনিত হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দের সেই কালজয়ী বক্তৃতা। এই বক্তৃতার মাধ্যমেই বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষ তথা হিন্দু ধর্মকে তিনি নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেদিনের সেই ধর্ম মহাসভায় তিনি বক্তৃতায় যা বলেছিলেন, আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের বিশ্বেও তা সমান প্রাসঙ্গিক। ভারতবর্ষের সম্প্রীতি নিয়ে গর্বিত বিবেকানন্দ কি আজকের ভারতবর্ষ দেখে মর্মাহত হতেন না? আজ সময় এসেছে - স্বামী বিবেকানন্দের বাণী অনুসরণ করে পুনরায় ভারতবর্ষকে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে ও আদর্শ রাজনীতির পীঠস্থান হিসেবে গড়ে তোলার।
===================
তীর্থঙ্কর সুমিত
মানকুণ্ডু, হুগলী
পিন - 712139