
নববর্ষের নবতম আশা
—সমীর কুমার দত্ত
পয়লা বৈশাখের পূর্ব রাত কলকাতা -হাওড়ার প্রখ্যাত মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী নকুল চন্দ্র নাগের বেশ কয়েকটি শাখার তোড়জোড় চলছে পরের দিন পয়লা বৈশাখের ভোরে দক্ষিণেশ্বরে ভব তারিণী মায়ের মন্দিরে হালখাতার পূজো দেওয়ার। বাড়ির গিন্নি, কর্তা সহ উঠতি ছেলেমেয়েদের সকলেরই সাজসাজ রব। এ প্রথা চলে আসছে বহুদিন ধরে। এবারেরও তার ব্যতিক্রম নেই বরং উন্মাদনা এবার একটু বেশি। কারণ এবার পরিবারের এক অষ্টাদশী যুবতী কন্যা উচ্চ মাধ্যমিকে দশম স্থানাধিকারিণী উচ্চশিক্ষার্থে অর্থাৎ জি.আর.ই ক্র্যাক করে আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে এই পয়লা বৈশাখে রাতের ফ্লাইটে। শুভ দিন নি:সন্দেহে।
নকুল চন্দ্রের পাঁচ সন্তানের কনিষ্ঠ সন্তান সোমনাথের জ্যেষ্ঠ কন্যা সুলক্ষণা নাগ খুবই মেধাবী ও বইপোকা । লরেটো স্কুলের আই.এস. সি পরীক্ষায় দশম স্থানাধিকারিণী ছাত্রীটি বংশের গৌরব। আই. সি. এস. ই পরীক্ষাতেও সে দশম স্থান অধিকার করে। নকুল চন্দ্রের পাঁচ সন্তানদের মধ্যে সোমনাথই কলেজ পাশ। বাকিরা কেউ মাধ্যমিক, কেউ উচ্চ মাধ্যমিক আবার কেউ স্কুল ছুট। সোমনাথের স্ত্রী সুচিন্তিকা কলা বিভাগের স্নাতক। নাচগান জানে, বেশ সংস্কৃতি সম্পন্ন। বাড়ির অন্যান্য বৌ দের চেয়ে রূপে লক্ষ্মী, গুনে সরস্বতী। আর সেহেতু একটু দম্ভ আছে। সব সময় মেয়েকে গাইড করে চলে। নিজের এম. এ পাশ করে ডক্টরেট করার ইচ্ছে ছিলো। বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে সেই সাধ পূরণ হয়নি। ব্যবসায়ী পরিবারে বৌ হয়ে এসে লেখাপড়া করার কথা ভাবাই যায় না। তাই মেয়ে সুলক্ষণাকে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলে সেই সাধ পূরণ করার আশা পোষণ করে। নাগ বাড়ি হলো পুরো দস্তুর ব্যবসায়ী বাড়ি। ছোট বৌ এসেই বাড়ির ভোল পাল্টে দিতে চায়। অন্যরা তা মেনে নেবে কেন। বৌ দের মধ্যে এক বড়ো বৌ ছাড়া বাকি সকলে ছোট বৌকে হিংসে করে। বড়ো বৌ খুবই সরল সাদাসিধে। ছোট বৌ সুচিন্তিতাকে খুব ভালোবাসে। ও মেয়ের পিছনে সময় দেয় বলে ওকে ঘরের কাজ কিছু করতে দেয় না। বলে, "ছোট, তুই মামনির কাছে গিয়ে বোস। ও আমি করে নেবো। আমাদের ছেলেপুলেদের তেমন কিছু হবে না।গড়িয়ে গড়িয়ে যতদূর হয়। পড়া শোনায় মনই নেই কারো। তবু তুই লেখাপড়াটা ভালো করে শিখেছিলি তাই। মামনিটা ভালো হয়েছে। ছোট্ ঠাকুরপোর তো সময় নেই দেখার।"
প্রতিবাদ করে সুচিন্তিতা বলে, "কী যে বলো দিদি। তুমিই বা আমার কাজ করবে কেন শুনি। তোমার কি কাজ নেই? আমিই বা করতে দেবো কেন। আর অন্যদেরটা না করলে তোমার ছেড়ে দেবে ভেবেছো। তোমায় কথা শোনাতে ছাড়বে না। সে আমি সহ্য করতে পারবো না।"
যাই হোক সুলক্ষণাও যাবে দক্ষিণেশ্বরে মায়ের আশীর্বাদ নিতে। গোটা বাড়ির মধ্যে তাই একটা চাপা উত্তেজনা রয়েছে। তা সে আনন্দেই হোক আর হিংসেতেই হোক। কারণ বাড়ির কিছু লোক আছে, যারা সুচিন্তিতাকে সহ্য করতে পারে না। আর ওর মেয়ে সুলক্ষণার ভালো যে চাইবে না তা বলাই বাহুল্য। পারিবারিক গোটা দুয়েক গাড়ি আর মিষ্টান্ন সরবরাহের একটা ভ্যান গাড়ীতে চেপে রওনা দিলো ছোট বড়ো সকলে দক্ষিণেশ্বরের উদ্দেশ্যে ভোরের প্রাতঃকৃত্য আর স্নান সেরে।
সারা বছরে ব্যবসা বানিজ্য যাতে ভালো হয় আর তাদের বংশের মেয়ে এই প্রথম উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যাত্রা করছে, তার মনস্কামনা যাতে পূর্ণ হয় মায়ের কাছে সেই প্রার্থনা জানিয়ে এবং পূজো দিয়ে ফিরে এলো সবাই।
দুটো প্রধান কার্য সম্পাদনের ব্যাপার রয়েছে। এক, দোকানে দোকানে সারা বছরের ক্রেতাদের ক্যালেন্ডার ও মিষ্টান্নের প্যাকেটে মিষ্টি ভরা এবং সন্ধ্যায় তা ক্রেতাদের বিতরণের মধ্যে দিয়ে নতুন বছরের হাল খাতার শুভ সূচনা করার কাজ। একটা উৎসব অনুষ্ঠানের মতো ব্যাপার নিয়ে সারা পরিবার ব্যস্ত থাকে। এবছর আবার এই ব্যস্ততার মাত্রা একটু বেশি। বাড়ির এক কন্যা উচ্চ শিক্ষার্থে চলেছে বিদেশে। সেহেতু মালিকরা সবাই দোকানে দোকানে উপস্থিত থাকতে পারছে না। কর্মচারীরাই তা সামলে নিচ্ছে। মনটা ভালমন্দের মিশ্র এক অনুভূতিতে অল্প বিস্তর ভারাক্রান্ত সকলেরই।
সুলক্ষণা বিদেশে পড়তে গেলে কি হবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে ও একটা ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে। ব্যবসায়ীরা যেখানেই যাক্ ব্যবসার নাম ডাকের জন্য বিজ্ঞাপন করতে অভ্যস্থ। তার জন্য তারা যথেষ্ট খরচ করে থাকে। বুদ্ধিমতী সুলক্ষণা মাঝে মাঝে তার মাকে ও বাবাকে বলে, " আমাদের দোকানের তো কতোগুলো শাখা। আমাদের মিষ্টান্নের কোয়ালিটি তো খুব ভালো। তাহলে বিদেশে কোন শাখা নেই কেন? তার বাবা মা তার প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।সুলক্ষণার ইচ্ছা তাদের ব্যবসার বিদেশে কোন শাখা থাকুক। এই মুহূর্তে তার আরও ইচ্ছা বিদেশি সহপাঠী ও শিক্ষকদের মিষ্টি মুখ করানো এবং তার প্রশংসা নিজের কানে শোনা। তাতে তাদের ব্যবসার বিজ্ঞাপনও হবে আর নাম ডাক ছড়িয়ে পড়বে বিদেশেও। তাই যথেষ্ট পরিমাণে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বিখ্যাত মিষ্টান্ন বিদেশে নিয়ে যাবার উপযোগী করে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাবা,মা কে সঙ্গে নিয়ে। সংসারের যারা শুভাকাঙ্ক্ষী তারা বাড়ির পরম আদরের মেয়েকে বিদায় দিতে গিয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। আর যারা ওর প্রকৃত শুভাকাঙ্খী নয়, তারা অভিনয় করে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন।
রাত তখন নটা, এক নব যুবতীর নববর্ষের রঙিন স্বপ্নকে ভাসিয়ে নিয়ে এগিয়ে চললো স্বপ্নের বায়ুযান। এই নববর্ষই যে বিদেশে স্বর্গীয় নকুল চন্দ্র নাগের মিষ্টান্ন ব্যবসার নতুন প্রত্যাশা পূরণে সফল হবে না সুলক্ষণার হাত ধরে, এ কথা কে বলতে পারে? যদি হয় তবে তো বলতে হবে সুলক্ষণাই বিদেশে স্বর্গীয় নকুল চন্দ্র নাগের ব্যবসার পথিকৃৎ।
-------------------------------------------
Samir Kumar Dutta
Bally, Howrah 711201