পয়লা বৈশাখ
সমর আচার্য্য
আজ পয়লা বৈশাখ। শশাঙ্কবাবু সকাল সকাল স্নান, পূজা, আহ্নিক সেরে প্রতিদিনের মতো হাঁটতে বের হলেন। উনি প্রাতঃভ্ৰমণ করেন না। ঐসময় তার বিশেষ অসুবিধা আছে।
রাস্তায় বেরিয়ে দেখলেন দোকানে দোকানে গনেশ পূজা হচ্ছে। বন্ধু নিতাই এর দোকানে প্রসাদ খাওয়ার নিমন্ত্রণ আছে। বন্ধুর সামান্য দর্জির দোকান। ওর দোকানের সামনেই মা লক্ষ্মী জুয়েলার্স। ভীষণ তোড়জোড় সেখানে। দোকান সাজানো হয়েছে সুন্দর ভাবে। অসংখ্য খরিদ্দার। সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। পূজা অন্তে চেয়ার টেবিল পেতে খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে।
মা লক্ষ্মী জুয়েলার্স এর জাঁকজমকপূর্ণ ব্যবস্থা দেখে শশাঙ্কবাবু মুহূর্তে হারিয়ে যান অতীতে। তাদের ছোট বেলার সেই হালখাতার দিন। ডাক্তারখানা, মুদিখানা, কাপড়ের দোকানে প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ হালখাতা হতো। কেউ দুই টাকা, কেউ এক বা পাঁচ টাকা দিয়ে হালখাতা করত। দোকান থেকে গরম গরম জিলাপি কলার পাতায় মুড়ে দেওয়া হতো। কী ভালো ই না লাগত সেই জিলাপি খেতে।
সেবার শশাঙ্কবাবুর বাবার খুব অসুখ। হালখাতা করার টাকা জোগাড় করতে পারেননি। অথচ অবনী ডাক্তারের দোকানে একগাদা বাকি। চিঠি দিয়েছে। হালখাতা না করলেই নয়।
শশাঙ্কবাবুকে একটা সিকি ধরিয়ে দিয়ে বাবা বলেছিলেন, যা এইটা দিয়ে হালখাতা করে আয়।
লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড় তার!
ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে তার হাত দিয়ে হালখাতা করিয়েছিলেন, নিজে দূরে দাঁড়িয়ে থেকে। দোকানে সেই পয়সা নেয়নি। বলেছিল, চার আনা দিয়ে হালখাতা হয় না খুকি । তুই মাধাই এর মেয়ে না ?এটা নিয়ে যা। তোকে হালখাতা করতে হবে না। তোর বাবা আগে সুস্থ হয়ে উঠুক। ডাক্তারের দোকানের লোক তো জানত ই বাবা অসুস্থ। তবে কলার পাতায় জড়ানো কয়েকটা জিলাপি দিয়েছিল। তাতেই বোন খুব খুশি হয়েছিল। শশাঙ্কবাবু ও যে খুশি হননি তা নয়। তবে সিকি টা ফেরৎ দেওয়ায় একটু লজ্জা লেগেছিল।
পিছন থেকে নিতাই বলে, কি রে শশাঙ্ক কী ভাবছিস ? তারপর সামনের দোকানের দিকে চেয়ে বলে, বুঝতে পারছি তুই অতীতের কথা ভাবছিস। অতীত ভাবলে আর হবে না বন্ধু। দিনকাল পাল্টিয়েছে! যখন যেমন তখন তেমন দেখতে শুনতে অভ্যাস করতে হবে। এই দেখ না, আজ থেকে কয় বছর আগে আমিই কি হালখাতা করতে পারতাম। এখন একটু সামর্থ হয়েছে, পারছি। এখন মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে
চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্খাটা বড় বেড়ে গিয়েছে। নিতাইয়ের কথায় শশাঙ্কবাবু সুর মিলিয়ে বলেন, ঠিকই বলেছিস ---আগের পয়লা বৈশাখ আর এখনকার পয়লা বৈশাখে কত ফারাক। তবুও যা এসেছে ভালোই এসেছে, যা আসবে হয়তো ভালো ই হবে। তবে আমাদের কাছে আগেরটাই বেশি ভালো লাগে ---! শশাঙ্কবাবুর সাথে নিতাই ও যেন ফিরে যায় তাদের সেই ফেলে আসা অতীতে। দুঃখ কষ্টের হলেও সে যে ছিল ভীষণ প্রাণময়!
-------------------------------------------
রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর