
চিনা লোককথা ।। যে লোকটি ভূতকেও বেচে দিয়েছিল ।। বাংলা রূপান্তর : চন্দন মিত্র
চিনা লোককথা
যে লোকটি ভূতকেও বেচে দিয়েছিল
বাংলা রূপান্তর : চন্দন মিত্র
নানইয়াং প্রদেশের সুং-তিং-পো ছিলেন যেমন বুদ্ধিমান তেমন সাহসী। যৌবনে তিনি একবার ভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন। তাতে অবশ্য তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি বরং সমস্যায় পড়েছিল তাঁর পাল্লায় পড়া প্রৌঢ় ভূতটি।
সুং-তিং-পো হাটে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন রাত থাকতে থাকতে। হাট ছিল অনেকটা দূরে, আবার বসত ভোরবেলা থেকে। জ্যোৎস্নালোকিত নির্জন পথে হেঁটে যাওয়ার সময় তিনি দেখলেন রাস্তার ধারে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। সুং-তিং-পো তার হুলিয়া দেখে বুঝলেন এ ব্যাটা ভূত ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু তিনি সাহস না-হারিয়ে সেই ভূতের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করলেন।
সুং তিং পো— কে মশাই, এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন ?
ভূত— আমি একজন ভূত। তা আপনি কে মশাই ?
সুং তিং পো— মশাই, আমিও আপনার মত একজন ভূত।
ভূত— তা আপনি এত রাতে একা একা কোথায় চলেছেন ?
সুং তিং পো— যাচ্ছি একটু হাটের দিকে।
ভূত— হাট, বাঃ চমৎকার। কতদিন হাট দেখিনি । চলুন আপনার সঙ্গে হাটের দিকেই যাই।
সুং-তিং-পো সাহসে ভর করে সেই ভূতের সঙ্গে চললেন হাটের পথে। পাশে পাশে চলতে চলতে ভূতটি বলল, 'শুনুন এভাবে খামোখা দুজন না হেঁটে আমরা তো পরস্পরের কাঁধে চেপেও যেতে পারি। প্রথমে আপনি আমার কাঁধে চেপে বসুন।' বলেই ভূতটি উবু হয়ে বসল। সুং তিং পো সানন্দে সেই ভূতের কাঁধে চাপল। ভূতটি অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল। সুং-তিং-পো ছিলেন বেশ ওজনদার। ভূতটির প্রতিটি অস্থিসন্ধি কড়কড় শব্দ করে উঠল। ভূতটি ককিয়ে উঠে বলল—'মশাই আপনি বেশ ভারি, সত্যি সত্যি ভূত তো ?'
সুং-তিং-পো সপ্রতিভভাবে বললেন— 'বুঝেছি, আপনার বয়স হয়েছে। তাই আমাকে বইতে আপনার কষ্ট হচ্ছে। আপনি বরং আমাকে নামিয়ে আমার কাঁধে চাপুন।'
ভূত বলে কী আত্মসম্মান থাকবে না ! সে দাঁতে দাঁত কোঁ কোঁ করতে করতে এগিয়ে চলল।
একসময় নিতান্ত ক্লান্ত হয়ে সে সুং-তিং-পোকে কাঁধ থেকে নামাল।
ভূতটাকে কাঁধে চাপিয়ে সুং-তিং-পো দেখলেন, একেবারে পাখির পালকের মতো হালকা; ওজন নেই বললেই চলে। তিনি দ্রুত পা চালাতে লাগলেন।
ভূতটি অবাক হয়ে বলল— 'মশাই, আপনার গায়ে তো দারুণ জোর ! আমি একটি জলজ্যান্ত ভূত আপনার কাঁধে বসে পা দোলাচ্ছি আপনি যেন পাত্তাই দিচ্ছেন না।'
সুং তিং পো হাসতে হাসতে বললেন— 'আপনার খুলি তো দেখছি একদম ফাঁকা। কতবার বলব আমি সদ্য সদ্য ভূত হয়েছি, মানে ইয়াং ভূত। আমার গায়ে জোর থাকবে না তো আপনার মতো বুড়ো ভূতের গায়ে জোর থাকবে ? আচ্ছা বলুন তো আমরা ভূতেরা সব থেকে কীসে ভয় পাই ?'
ভূতটি কিচকিচ শব্দে বলল— 'মানুষকে দেখে। তারা আমাদের দেখলেই থুতু ছেটায়।'
সুং-তিং-পো দেখলেন, এবার একটা নদী পার হতে হবে। কাঁধ থেকে ভূতকে নামিয়ে তিনি বললেন— 'মশাই, আপনি আগে পার হন।'
আসলে সুং-তিং-পো নদীটির গভীরতা বুঝে নিতে চাইছিলেন। নদীর যে অংশ দিয়ে তিনি সচরাচর পার হতেন, ভূতের পাল্লায় পড়ে সে দিক ছেড়ে অন্যদিকে এসে পড়েছিলেন।
ভূত জলে নেমে নিঃশব্দে ওপারে পৌঁছে গেল, তার গায়ে একফোঁটাও জল লাগল না।
সুং-তিং-পো অগভীর নদীতে ছপছপ শব্দ তুলে নদী পার হলেন।
ভূতটি তাঁকে বললেন— 'এই যে মশাই, আমরা ভূতেরা তো জলের উপর থেকে যাওয়ার সময় কোনোরকম শব্দ করি না। আপনি ওরকম শব্দ করছিলেন কেন ?'
সুং-তিং-পো বললেন— 'সত্যি আপনার বয়স হয়েছে বুঝলেন। কতবার বলব, আমি সদ্য সদ্য ভূত হয়েছি।'
কথায় কথায় ভোর হয়ে এল, কয়েক পা হাঁটলেই হাট। সুং-তিং-পো ভূতটির হাত শক্ত করে ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে চললেন। বেগতিক দেখে ভূতটি এক নধর পাঁঠার রূপ ধরল। সুং-তিং-পো, ভয় না-পেয়ে শক্ত মুঠোয় সেই পাঁঠার একটি কান ধরে নিয়ে চললেন যে দিকে গবাদিপশু বেচা কেনা হয়।
দূর থেকে পাঁঠাটিকে দেখে একজন এগিয়ে এসে বললেন— 'মশাই, কত দামে বেচবেন ?'
সুং-তিং-পো বললেন— 'একদর, দেড় হাজার টাকা।'
লোকটি টাকা মিটিয়ে পাঁঠাটিকে বেঁধে ফেললেন। সুং-তিং-পো টাকাগুলি পকেটে গুঁজে হনহন করে হাটের বাইরে বেরোনোর রাস্তা ধরলেন, একবারের জন্যও পিছনে তাকালেন না।
----------------------------------------------
চন্দন মিত্র
ভগবানপুর (হরিণডাঙা)
ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা