(১)
" ও মেরে স্বপ্নো কে সওদাগর
তুঝকো মুঝসে হ্যায় পেয়ার আগার.........."
এই টুকু গান গাওয়ার সাথে সাথে খাটের ওপর পিঠে বালিশ ঠেসান দিয়ে বসে থাকা শিবু দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল,"ওরে আমার রূপসী রাজকুমারী এলেন , ওর জন্যে রাজকুমার আসছে।শ্যাওরা গাছের পেত্নী।যা কাজে যা।"
পম্পি র বড়ো কালো চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। আয়না য় ফিরে দেখে নিজেকে।অসুন্দর তো লাগে না। গায়ের রং তার কালোর দিকে।দোষের মধ্যে দাঁত গুলো বিশ্রী উঁচু।আর ছোটবেলার বসন্ত রোগ তার ছাপ ফেলে গেছে। পুরো মুখ ভর্তি গর্ত।কষ্ট মনে চেপে কাজে বেরোল পম্পি।
(২)
রাজারহাট- কৈখালী এই রাস্তায় অটো চালাতো শিবু। ঘরে ছিল মা,বৌ আর বছর তেরো র মেয়ে আর পাঁচ বছরের ছেলে।কম পয়সা হলে ও সুখে র ঘর ছিল তাদের। দুপুরে বাড়ি ফিরে মা এর হাতে লাউ শাক ঘণ্ট আর ভাত খেতে মনে হতো স্বর্গ সুখ। কখনো কচি লাউ ডগা সেদ্ধ করে পোস্ত বাটা দিয়ে মেখে দিত মা ।তার পছন্দের খাবার ছিল সেটা।
শুধু দু- চোখের বিষ ছিল মেয়ে টা। মুখের দিকে তাকালে দিন খারাপ যায়। সারাদিন বলতো," তোর জন্য আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে না,মুখ দেখলে মনে হয় চোখ বুজে নি।"
মা বলতো," শিবু অত হতচ্ছেদ্দা করিস না,কে বলতে পারে ওই তোকে দেখে রাখবে।" শিবু বলে,"ও দেখবে আমায়,ঐ অপয়া কে পার করতে আমার কতো খরচ হবে কে জানে??ওর জন্যে তো আর কেউ নিজে থেকে আসবে না??"
ঠাকুমা পরে ডেকে পম্পি কে বলে , " মন খারাপ করিসনা দিদিভাই, বাইরের রূপ কদিনের,মন আর ব্যবহার সুন্দর রাখিস। ওতে ই তোকে মনে রাখবে সবাই।"
(৩)
কাজে যেতে যেতে পম্পির মনে পড়ে কিভাবে আজ এই অবস্থায় এলো সে আর তার বাবা।সে দিন টা ছিল পম্পি র জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন।আজ ও স্পষ্ট মনে পড়ে। শিবু এসে আগের রাতে বললো,অটো ওয়ালা রা সব মিলে পিকনিকে র ব্যবস্থা করেছে। একটা বাস ভাড়া করে যাওয়া হবে, বিকেল এ ফিরে আসবে।সেই মতো পরদিন সকালে সবাই তৈরি হয়ে গেলো হুগলির কোন এক আমবাগানে পিকনিক করতে। সারাদিন হৈ-হৈ করে খুব আনন্দ করেছে। খাওয়া,নাচ,গান হুল্লোড় করেছে।ফেরার সময় জুলি কাকিমা মা কে এসে বললো," দেখো,পাড়ার ছেলেদের কান্ড, বাগানের পিছনে গিয়ে মদ খাচ্ছে। নিজেরা খা, সাথে ড্রাইভার কে ও নিয়েছে।" মায়ের চোখে ভয়ের ছায়া দেখলো পম্পি।
বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পর আর কিছু মনে নেই পম্পির। হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলে জানতে পারে বাসের ড্রাইভার নেশার ঘোরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের নয়ানজুলি তে পড়ে যায়। অনেকেই জলে ডুবে যায়,যার মধ্যে তার ভাই,মা আর ঠাকুমা ছিল।সে কি করে বেঁচে আছে সেটা আশ্চর্যের?চরম ক্ষতি হয়েছে তার বাবার। পাথরের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে ।আর কোনদিন ঠিক হবে কিনা জানা নেই।
ওই অবস্থার পর বাবার কাজ করার ক্ষমতা আর থাকে না।কিছুদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া সাহায্যে দিন চলছিল, কিন্তু একসময় সেটা বন্ধ হয়।পাড়ার কাকিমা দের সাহায্যে লোকের বাড়িতে বাসন মাজার কাজ নেয় পম্পি।সেই দিয়ে বাড়ি ভাড়া আর দুজনে র জীবন কোনরকমে চলে। অকেজো হয়ে যাওয়ার পর থেকে শিবু র গালাগালি যেন বেড়েই চলেছে।কেন পম্পি সেইদিন মরলো না এই প্রশ্ন সবসময় করে চলে। আজকাল পম্পি আর কিছু মনে করে না।বরং অকেজো হয়ে যাওয়া বাবার জন্যে করুণা হয় তার।ক্ষমা করে দেয় বাবাকে,উলটে ভাবে কি করলে বাবা কে একটু ভালো রাখতে পারবে।
(৪)
কাজের বাড়িতে ঢুকতেই মাসিমা বললো,"পম্পি পিছনের বাগানে অনেক বড়ো বড়ো লাউ শাক হয়েছে।পেড়ে নিয়ে আয়,আমায় দিস আর তুই ও নিয়ে যাস।আর এই নে তোর এ- মাসে র মাইনে।" পম্পি খুব খুশি হয়ে বলল," আমি শাক পেড়ে কেটে পরিষ্কার করে দেব।"
মনে মনে ভাবে আজ পোস্ত কিনবে অল্প। বাবাকে লাউডগা দিয়ে পোস্ত করে দেবে।খুব ভালো বাসে বাবা ওটা খেতে।কাজ সেরে যায় লাউ শাক পাড়তে। কয়েকটা পাড়ার পর হঠাৎ তীব্র জ্বালা অনুভব করে হাতে র কব্জি তে। বিস্ফারিত চোখে দেখে লাউডগা র সাথে প্যাঁচানো সরু সবুজ সাপ ছোবল দিয়েছে।কয়েক মুহূর্ত চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ,মুখে ওঠে ফেনা। পড়ে যায় সেখানে লুটিয়ে।
শিবুর ঘরের দাওয়ায় পাড়ার ছেলেরা এসে নামায় পম্পির নিথর দেহটা।এক হাতের মুঠোয় ধরা লাউডগা, অন্য হাতে মাইনে র টাকা।
শিবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। চোখ বুজে নেয়।দেখে পম্পি উঁচু দাঁত গুলো বের করে হাসছে আর গান গেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে কোথায়। শিবু শুধু শুনতে পাচ্ছে,
"ও মেরে স্বপ্নো কে সওদাগর"............
^^^^^^^^^^^^
পর্ণা বসু
মুম্বাই