রতনবাবু, উবের করে বাড়ী ফিরছেন। বেলা তিন টে বেজে গেল! সঙ্গে ছ'টী ভারী এবং বড় ব্যাগ। এই যজমান এর বাড়ী যখন সকাল বেলায় এলেন তখন ছিল চারটে বড় ব্যাগ ভর্তি জিনিস। নিজে একা যথেষ্ট কষ্ট করে সব বয়ে বয়ে নিয়ে গেছিলেন!
পুজোর পরে আজ এই দিদি র বাড়ী এলাহী ভুড়ি ভোজ করে, এখন গাড়ী তে গা এলিয়ে বসে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে।এসির ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণ টা জুড়িয়ে যাচ্ছে যেন!
গিন্নীর মুখ টা মনে পড়ছে! ওঃ, আজকে যা খুশী হবে সে!বেচারা বাতের ব্যাথায় মাঝে মাঝে বড্ড কাবু হয়ে পড়ে। বাড়ীতে তো আর কাজের লোক নেই, গিন্নীর শরীর খারাপ হলে রতন বাবু কেই তখন বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট মোছা, কাপড় কাচা, রান্না করা সবই করতে হয়! ছেলের বউ এর সেবা পাওয়ার ভাগ্য করে তো আর আসেননি, তারা ঝগড়া ঝাঁটি করে প্রথম থেকেই আলাদা থাকে। তাই এই প্রৌঢ় বয়সে বেশ কষ্ট করেই বেঁচে থাকা!
তবে আজ যা ফল ভান্ডার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন তাতে গিন্নীর সপ্তমে চড়ে থাকা মেজাজের পারদ টা মনে হয় কিঞ্চিত নামবে!
তার ওপর দু বাক্স ভরে ভরে কত যে রকমারী মিষ্টি, আঃ, ভাবলেও জিভে জল এসে যাচ্ছে!
যখন পূজোর পাট মিটে গেল, তখন শীলা দি গেলেন দুপুরের খাবার তদারকি করতে। পূজোর ঘরে অন্য কেউ
নেই। কোভিডের ভয়ে যে দু চার জন নিমন্ত্রিত এসেছিলেন তারাও বাড়ী চলে গ্যাছে। শুধু বাড়ীর কর্তা বসার ঘরে, ফোন নিয়ে ব্যস্ত, কাজের মেয়ে ঘোরাঘুরি করছে। শীলা দি র এক বান্ধবীও রান্নাঘরে ব্যস্ত! অতএব পূজোর ঘর ফাঁকা। রতন বাবু এবারের সিজনের ল্যাংড়া আম এখনও খাননি, চোখের সামনেই পূজোয় বাবার আত্মার উদ্দেশ্যে শীলাদির দেওয়া, পুরুষ্ট ছ'টা ল্যাংরা আম দেখে ,নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলেন না, বড় ব্যাগে ভরতে লাগলেন, পাশে দেখলেন, কাঁচা হলুদ রঙের বেশ নধর বারোটা কাঁঠালী কলা, সেটাও তাড়াতাড়ি ভরে ফেললেন, তারই পাশটিতে রাখা ছিল কচি কলাপাতা রঙের ছ'টা ন্যাশপাতি, ব্যাগে ভরলেন! তারপর ভাবলেন, "থাক, এবার ক্ষান্ত দিই, বাকী ফলে র সম্ভার যেমন আছে থাক ' কিন্ত একবাক্স লাল আঙুরের দিকে বারবার চোখ চলে যেতে লাগল!গিন্নীর প্রবল অ্যানিমিয়া বলে অনেক আগে ডাক্তার বলেছিল, আঙুর খাওয়াতে!কিন্ত রতন বাবুর সংসার কোনও রকমে চলে যায়, তাদের কি আঙুর কিনে খাওয়া পোষায়!এর দাম শুনলেই ছিটকে যেতে হয়!তাহলে এই আঙুরের বাক্স টা কি তার নেওয়া উচিত না?সেই ভোরবেলার থেকে উঠে কম পরিশ্রম তো তিনি করেননি?কেন করেছেন?কারণ এই ভদ্রমহিলার মৃত বাবার আত্মার শান্তির জন্য তার এই ছুটোছুটী করে আসা, এই যে বিছানা বালিশ, ধুতি পাঞ্জাবী, ছাতা, কাঁসার বাসন সমস্ত গুছিয়ে নিয়ে এসেছেন, তা তো ঐ আত্মার জন্য ই। এই সব জিনিসের মূল্য অবশ্য ধরে দেবেন এরা। যদিও এই জিনিস গুলো অন্ততঃ পক্ষে সাতটি মৃত ব্যক্তির আত্মার স্বর্গ যাত্রার সঙ্গী হয়েছে! প্রতিবার এদের তিনি কুমীরের ছানা দের মতোই ঘুরিয়ে আনেন আর যজমান কে বিল ধরিয়ে দ্যান! এখন এই একবাক্স আঙুরও তার পারিশ্রমিক এর মধ্যেই পড়ে বৈকী! খপাত করে তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরলেন!এরপর একবাক্স প্লাম, তারপর ছ'টা লাল টুকটুকে ইয়া বড় বড় আনার, কিছুই ফেলে রাখলেন না। ঘর টা বেশ খালি খালি হয়ে গেল!কারণ অত গাদা গাদা ফল মিস্টি, সবই এখন ওনার বড় বড় ছ'টি ব্যাগে ঢুকে গ্যাছে!
নতুন এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, ওনার বাড়ীর গৃহপ্রবেশ এর পূজো উপলক্ষে বছর খানেক আগে! বেশ মালদার পার্টি, মনে হয়! হাত টাও খোলা! কোনও কিছুতে কার্পণ্য করেন না! বেশ বড় আড়ম্বর করে গৃহপ্রবেশ এর পূজো টা করিয়েছিলেন!
রতন বাবু আবার,পূজো যখন করবেন, সে হবে একেবারে দেখবার মত! মন্ত্রের উচ্চারণেে কোনও খুঁত নেই!যজ্ঞ করায় কেউ ওনাকে হারাতে পারবে না। নতুন এই দিদি র নাম, শীলা চ্যাটার্জি, বড় ভাল মানুষ, মিস্টি ব্যবহার!
গৃহপ্রবেশ এর পূজোয় যজ্ঞ দেখে তো শীলা দি র বাড়ীর লোকেরা ধন্য ধন্য ধন্য করেছিল! রতন বাবু চরিত্রবান সাত্বিক মানুষ, নিজের প্রিন্সিপল এর প্রতি উনি অনড়!
নিজের কাজ টা ভাল জানেন, নিষ্ঠার সঙ্গে সেগুলো পালন করেন, প্রতিদানে কাজের পারিশ্রমিক টা একেবারে কড়া এবং গন্ডা মিলিয়ে আদায় করতে ভোলেন না!
এই যেমন আজ, শীলা দি র বাবার বাৎসরিক এর কাজ করবেন বলে এসেছিলেন! কবে থেকেই তো তার সঙ্গে কথাবার্তা চলছে এই ব্যাপারে।কোভিডের ভয়ে তো কেউ কিচ্ছুটি করতে পারছেনা! তা যাহোক, এখন একটু সুযোগ হয়েছে! করোনা বাবাজী মনে হয়, অনেক পরিশ্রম করে ইদানীং একটু রেস্ট নিচ্ছে!
গত মে মাসে ই বাৎসরিক হবার কথা ছিল, তিথি অনুযায়ী! কিন্ত সেই সময় করোনার দাপটে সবাই ঘরে ঘরে ভয়ে মরছে!
গাড়ী টা কষে ব্রেক মারল, আর কাঁচা ঘুম ভেঙে রতন বাবু, মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি নিয়ে উদাস ভাবে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন! উবারে যাতায়াতের খরচ দেবে যজমান পার্টির লোক! প্রনামী তো দেবেই!তবে আজকের মত ফল তিনি কখনও কোথাও পাননি, এমনকি এইসব দামী ফলেদের তিনি চিরকাল এড়িয়ে চলেছেন, আস্বাদন তো দূরের কথা!
বাড়ীর দরজায় এসে বীর বিক্রমে হাঁক পাড়লেন, "বিমলা, ও বিমলা, কোথায় গেলে গো! তাড়াতাড়ি এস,দ্যাখো দেখি কি এনেছি!" গিন্নীর ফোলা শরীর নিয়ে বেঁকে বেঁকে আসতে সময় লাগে! বিমলা ফল খেতে বড় ভালবাসে! এখন কোভিডের সময়ে পূজো আচ্চা প্রায় বন্ধের জোগাড় হয়েছে। জমানো টাকা ভাঙিয়ে সংসার চলে। ছেলে এক পয়সা ও দ্যায় না। বাবার পুরোহিত গিরি কে সে নাকি ঘেন্না করে। কমিউনিস্ট পার্টি তে নাম লিখিয়েছে। একবার ঝগড়ার মুখে বাবাকে 'চোর' বলেছিল বলে উনি ও ছেলেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ছিলেন। ছেলে ও অমনি আলাদা সংসার পাতল!অবশ্য পূজোর বাড়ী থেকে যা যা কুড়িয়ে বাড়িয়ে আনতে পারেন, সব কিছুর থেকেই ছেলের সংসারে দিয়ে আসেন। নাহলে গিন্নীর চোখে বন্যার মত জলের ধারা নামবে। কারণ তিনি আবার ছেলে অন্ত প্রাণ!গত দেড় বছর ধরে ছেলের ও চাকরী নেই, ঘরে দুটী বাচ্চা, ওর বউ এখন চার টে বাড়ী তে রান্নার কাজ করে!
আজই গিয়ে বউমা কে অর্ধেক ফল মিস্টি দিয়ে আসতে হবে।বাচ্চা গুলো বোধহয় কালে ভদ্রে ফল খেতে পায়!
শীলা দি র কাছে প্রণামী টা বোধহয় একটু বেশীই হেঁকে ফেলেছেন। শীলাদি শুনে যেন থমকে গেলেন মনে হল!
এত বড় ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট, ছেলে মেয়ে ওনার বিদেশে থাকে, তা ,ওনার কাছে তো এ টাকা সামান্য, বাবার আত্মার তৃপ্তির জন্য এটুকু প্রণামী তো উনি দিতেই পারেন!
রতন বাবু হিসেব করে ই এসেছেন, তাদের ইলেকট্রিকের বিল চারমাস ধরে বাকী পড়ে আছে, এই টাকা টা দিয়ে সেটা মেটান যাবে!
গিন্নীর খুশী ধরা যায় না! মুখখানা একইরকম গম্ভীর রেখে ফল, মিস্টি গুছিয়ে তুলতে লাগলেন!
রতন বাবুও বাথরুম গেলেন। তারপর একটু ঘরের দাওয়ায় এসে বসে ছেলে কে ফোন করলেন, " খোকা, তোর স্মার্ট ফোন থেকে আমার ব্যাঙ্ক ডিটেলস টা শীলাদির নম্বরে পাঠিয়ে দে এক্ষুনি "।ছেলের যত কথা, মায়ের সঙ্গে, বাবার সঙ্গে পারতপক্ষে সে কথা বলে না। ফোন কেটে দিল ছেলে। অথচ একবার ভাবেনা যে এই পুরুতগিরি করেই সে ছেলেকে গ্র্যাজুয়েশন অবধি পড়িয়েছে, মাথা র ওপর ছাদ তুলেছে! তবে এটা ঠিক, কথা না বললেও, বাবা কোন কাজ বললে, তখনই করেও দ্যায়!
হঠাৎই রতন বাবুর ফোন বেজে ওঠে, শীলাদির ফোন! নিশ্চয়ই টাকার কথাটাই বলবেন! রতনবাবু বলেন, "হ্যাঁ, বলুন!"
একটু যেন রুক্ষ শোনায় শীলাদির গলা, "রতন বাবু, আপনার ব্যাঙ্ক ডিটেলস পেয়েছি, কিন্ত আমার ,আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে! আপনি আমার সব ফল মিষ্টি নিয়ে গ্যাছেন?আমরা কেউ কোন প্রসাদ পেলাম না!"
রতন বাবুর জবাব তো তৈরী ছিল, "শুনুন, শ্রাদ্ধের ফল মিষ্টি প্রসাদ কাউকে দেবার নিয়ম নেই, শুধু ব্রাহ্মণ রাই খেতে পারে!"
"আরে,আমার এখানে তো অনেকে ব্রাহ্মণ, আমি তো বন্ধুদের আর প্রতিবেশীদের দেব,নিজেরা খাব বলে অনলাইন থেকে অনেক দাম দিয়ে বাজারের সেরা ফল আনিয়েছিলাম, এটা আপনি কি করলেন, রতন বাবু?"
রতন বাবু র মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, মাথা টা নীচু হয়ে যাচ্ছে, "একটু ভুল হয়ে গ্যাছে তাহলে, আপনাকে জিজ্ঞেস করে আনা উচিত ছিল!" ফোন কেটে গেল, রতনবাবু মুখে র ওপর হাত চাপা দিয়ে বসে রইলেন।
-----------------------
কাকলী দেব, কলকাতা।