মৃত্যু ও মুক্তি
চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়
নিশুতি রাত। সারা আকাশে কুচোকুচো তারা রাশি যেন নিজেদের মধ্যেই বাক্যবিনিময় করতে ব্যস্ত। আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।উদভ্রান্তের মত শুধুই দৌড়াচ্ছি।হৃৎপিণ্ডটি যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।কোন কিছু দেখতে পাচ্ছি না আর আমি৷ সামনে বিশাল সমুদ্র তাও চোখে পড়ছে না৷তবুও দৌড়াচ্ছি পা গুলো বালিতে ঢুকে যাচ্ছে তবুও খুব জোরে দৌড়চ্ছি।এবারে ঢেউ আমাকে সঙ্গী করে নিয়ে চলেছে দূরে আরও দূরে.. অনেক দূরে।
রিনরিন করে ঘাম হচ্ছে।পাতলা ফিনফিনে গেঞ্জিটা জ্যবজ্যব করছে ঘামে ভিজে গিয়ে।প্রায়ই এই স্বপ্নটা আমাকে তাড়া করে বেড়ায়৷অথচ এর যে কি অর্থ তা এখনো বুঝতে পারিনি৷মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে৷আর ঘুম আসে না সারা রাত।
বাই দ্য ওয়ে এই অধমের নাম ত্র্যম্বক সেন।পেশায় শিক্ষকতা।অ্যাব্রডে সেটেল হওয়ার মতো একটা জব পেয়েছিলাম বটে কিন্তু শিক্ষকতা আমার নেশা এবং ভালবাসাও৷ভালবাসি আমি পড়াতে।
নিজের হায়ার স্টাডিস আর ছাত্রদের জন্য সময় দিতে গিয়ে মেঘে মেঘে যে কত বেলা হয় তা আর খেয়াল করা হয়নি৷হ্যাঁ আপনারা ঠিকই ধরেছেন আমি অবিবাহিত।তবে এর জন্য আমার কোন আফশোস নেই।অবসর সময় একটা খাতা এবং পেন আমার সঙ্গী৷যখন যা মনে আসে তাই লিখি৷যখন যা কল্পনায় আসে ক্যানভাসে রং তুলিতে ডুব দিই৷
ডিসেম্বরের ছুটিতে এবার ঠিক করেছি পুরীতে যাব। এমনিতেই সমুদ্র আমার বড় পছন্দের।অমাবস্যা পূর্ণিমাতে সমুদ্রের ঢেউ ফুলে ফেঁপে ওঠে।সমুদ্রের এই রূপ জীবনের কোন দেখার সৌভাগ্য হয়নি।তাই এবার সমুদ্রের উত্তাল রূপ দেখতে চাই সামনে থাকে।
অবশেষে পুরীতে।বহু কষ্টে একটা রুম পাওয়া গেছে। এই সময তো পূরীতে প্রচুর ভিড় হয় বেশীর ভাগ হোটেলে প্রি বুকিং করা থাকে।তাড়াহুডোর চোটে হেটেলটাই বুক করতে বেমালুম ভুলে গেছি।এই হোটেলটায় যথারিতি সব রুম বুকড।শুধু একটা রুম বহুদিন ধরে বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে৷হোটেলের ম্যানেজার তো অনেক ভূতের ভয়টয় দেখাল।কিন্তু আমি আবার এগুলোতে একদমই বিশ্বাস করি না। যাই হোক আমার চাপাচাপিতে ম্যানেজরবাবু ওনার কর্মচারী দিয়ে রুমটা পরিষ্কার করিয়ে দিলেন।আজ বড় ক্লান্ত দুপুরের লান্চ করতে করতেই সাড়ে তিনটে বেজে গেল৷সী বিচে সমুদ্র এবং সামুদ্রিক বাতাস উপভোগ করতে করতে কখন যে ন রাত হয়ে গেল৷ কোন রকম ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে হোটেলে রুমে এসেই ধপাশ৷একবারে গভীর ঘুম।
হঠাৎ করে শরীরের মধ্যে যেন কী হতে লাগল।মনে হচ্ছে যেন ক্রমশ তুলতুলে তোশকের মধ্যে ঢুবতে শুরু করেছি।চোখ মেলেও তাকানোর শক্তি চলে গেছে৷ সমস্ত শরীরে হাড় হিম করা শীতল স্পর্শ। যেন লতার পাতায আমি যেন আটকে আছি ৷ বুকের উপরে কেউ যেন একটা ভারী পাথর চাপিয়ে দিয়েছে ৷
।কতক্ষন যে এভাবে পড়েছিলাম কে জানে।ঘন ঘন কড়া নাড়ার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল।ধড়মড় করে উঠে বসলাম৷ মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা বারোটা।আমি অবাক হয়ে গেলাম।এত দেরীতে আমি জীবনে উঠিনি।তবে আজ?যাই হোক উঠে দরজাটা খুললাম। ম্যানেজার বাবু বাইরে দা্ঁড়িয়ে ৷
-কোন অসুবিধে হয়নি তো মিস্টার সেন?
-কিসের অসুবিধা৷নানা কিছু প্রবলেম হয়নি।
-আসলে যারা এখানে আছেন সবাইকেই একবার হলেও বেরোতে দেখেছি।একমাত্র আপনাকেই দেখিনি। তাই ...
-হা!হা!হাঃ আর তাই ভাবলেন ভূতে আমার ঘাড় মটকেছে।
ম্যানেজের বাবু বেশ অস্বস্তিতে পরে গেলেন৷
কিন্তু একটা খটকা কিন্তু আমার মনে রয়েই গেল। যেটা গতকাল রাতে আমার সাথে ঘটেছিল সেটা কি সত্যি নাকি আমার ক্লান্তির প্রকাশ?কে জানে?
ফ্রেশ হতে গিয়ে বুকের ব্যাথাটা টের পেলাম ৷ বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে
কালশিটের দাগ ৷ মনে হচ্ছে চিন্তারা মনের মধ্যে উঁকি দিছে। লান্চ করতে করতে বেশ খানিকটা বেলা হয়ে গেল।তাই এখন আর হোটেলে গিয়ে কাজ নেই এই ভেবে অলস মেজাজে সী বিচের ভেজা বালির উপর দিয়ে চলতে লাগলাম। এই কনে দেখা আলোতে অপূর্ব লাগছে এই সমুদ্র৷সী বিচের এই দিকটা বেশ নির্জন।শুধু চার পাঁচ জন কপোত কপোতী নিজেদের মধ্যে সময কাটাচ্ছে৷দেখে তো মনে হচ্ছে এরা সদ্য বৈবাহিক জীবনে বাঁধ৷পড়েছে৷আমি আর কি করি কিছু সমুদ্রের সাথেই সেলফি টেলফি তুললাম।তবে এই নির্জনতা আমি বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলাম৷
... এই কী হচ্ছে?ছাড়ো প্লিজ
... একটু সারিকা ... প্লিজ ... আমি যে তোমায় খুব ভালবাসি৷
... তাই বুঝি!
... হ্যাঁ কী জানো তো এই তোমার মধ্যে না কেমন সমুদ্র সমুদ্র গন্ধ পাই .. যেন মনে হয় সারা শরীরে মেখে নিই৷
সারিকার সমস্ত শরীর শিহরিত হতে লাগল৷একটু একটু করে এগোতে লাগল বিমল৷সারিকার কপালে রেশমের মতো চুলগুলো আদরে যত্নে কানের পাশে গুঁজে দিল সে৷ধীরে ধীরে উষ্ণ ঠোঁট কপাল ছুঁলো ৷ প্রাকৃতিক নিয়মে প্রস্ফুটিত ফুলের মত স্তনযুগল যেন কঠিন হলো।বিমলের কঠিন বাহুডোরে নত হতে বাধ্য হল সারিকা।
কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে - " মৃত্যু আসন্ন ... ওঠো ওঠো.. সময় যে আর পাবে না.." ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ভেবে পেলাম না সমুদ্রের এত কাছাকাছি কিভাবে এসে পড়লাম?পায়ে ঠান্ডা ঠান্ডা কী লাগছে বারবার?প্যান্ট টাও খানিকটা ভিজে গেছে মনে হচ্ছে?এতক্ষন কী তবে আমি ঘুমিয়ে পরেছিলাম নাকি?স্বপ্ন দেখছিলাম?কিন্তু এরা কারা?কারা ছিল আমার স্বপ্নে?এদের তো আমি কোনদিন চিনি বা দেখেছি বলে মনে পড়ছে না৷ আগোছালো ভাবে বসে থাকতে থাকতে কখন চোখের পাতা ভারী হয়েছে তা বুঝতেই পারিনি৷ আর ঐ কানের কাছে হিসহিস করে কীসব বলে গেল...এখনই হোটেলে ফিরে চেন্জ করতে হবে ৷ মাথার মধ্যে কেবল স্বপ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে।ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। তবে কী এই রুমটা সত্যি হন্টেড। না না এটা হতে পারে না৷ দেখাই যাক না আজকের রাতটা।
এই হোটেল রুমের জানালা থেকে সমুদ্র টা চোখে পড়ে।কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়লাম নিজেকে একটু স্ট্রেস ফ্রী করতে ৷এমন সময় আলো টা নিভে গেল৷বিরক্ত হয গেলাম।এমন সুসজ্জিত হোটেলে আবার কারেন্ট অফ হয় নাকি?কোন রকমে হাতড়ে হাতড়ে দেশলাই বের করে জ্বালালাম আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল কারো উপস্থিতি ঘটেছে এই ঘরে।হাড় হিম করা ঠান্ডা স্রোত যেন সারা শরীরে বইতে লাগল৷কিন্তু একি এ আমি কাকে দেখছি বোরখা পরা এক নারী। বোরখার আড়ালে শুধু জ্বলজ্বল করে জ্বলছে দুটি চোখ দেখা যাচ্ছে ৷এতো সেই স্বপ্নের সারিকা! কিন্তু কে এই সারিকা।এর সাথে আমার কি সম্পর্ক? উত্তরের অপেক্ষার অবসান হওয়ার আগেই
... চিনতে পারলে বিমল?
... আমি বিমল তো নয় ৷
... তোমার কী কিছুই মনে পড়ছে না বিমল ? তোমার ভালবাসার সারিকাকে তুমি চিনতে পারছ না? তোমাকেই তো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম।যা বলেছিলে তাই শুনেছি৷তোমার জন্য আমি বাড়ির বিপক্ষে গিয়ে তোমার সাথে বেরিয়ে গেছি বাড়ি থেকে!তোমার কী কিছুই মনে পরছে না?
... কথা ছিল এই পুরী থেকে ফিরেই আমারা রেজিস্ট্রি ম্যারেজে আবদ্ধ হব। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই তুমি আমাকে খুন করলে বিমল?তুমি তো জানতে আমি অন্তঃস্বত্তা ছিলাম!কি করে পারলে এমন একটা জঘন্য কাজ করতে। আমার ভালবাসায় তো কোন ফাঁক ছিলনা ৷
একে একে সব কেমন চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল ৷ মনে হচ্ছিল এ কোন আমি ৷ সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র ছেলে ছিলাম আমি৷ বাবা নেই৷শুধু মা এবং দুই বোন নিয়ে সংসার৷নিজে যা চাকরি করে তাতে তাদের মোটামুটি চলে যায়। তাই এতো তাড়া তাড়ি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াটা তার পক্ষে বেশ কঠিন ছিল৷সারিকাকে অনেক বুঝিয়েছিল সে৷কিন্তু সারিকা বুঝতে চায়নি৷পরে বুঝেছিল যে সারিকা প্রেগন্যন্ট।এই সম্পর্ক বিমলের কাছে গলার কাঁটার মতো হয়ে গেছিল৷ফেরার আগের দিন বিমল বড় আদরে সোহাগে সারিকাকে শেষবারের মতো খাইয়ে দিয়েছিল৷আর সে খাবারে ছিল স্ট্রং একটি বিষ।কিছুক্ষণ পরে সারিকা খুবই ছটফট করছিল৷
বিমল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না' ... সারিকার জন্য খুব খারাপ লাগছিল ৷
... এতোদিনেও আমি মরে গিয়েও ভালো নেই বিমল । এসো আমার কাছে। এই এতদিন পর আমার আত্মা শান্তি পেতে চলেছে।
... আমি জানি তোমার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। কিন্তু বিশ্বাস কর আমিও নিজেকে সেই রাতে শেষ করে ফেলেছিলাম। জানিনা নিজের মুখ দিয়ে অনর্গল এই কথা গুলোই বেরোতে লাগল ৷
- কিন্তু এ কি করে সম্ভব৷ আমি তো এখনও জীবিত ...
অসহ্য কষ্ট হচ্ছে আমার।মাথা দপ দপ করছে।এই প্রথমবার বোধ হয় বোঝা আর না বোঝার মধ্যিখানে আমি৷ ক্রমশ দুটি হাত আমার দিকে এগোচ্ছে।আমি পিছন ফিরতেই দেওয়ালে একটা ধাক্কা খেলাম। আমার চোখ গুলো ঠেলে যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে ৷ আর সেই খোনা গলায় তার বিকট হাসি ... অনবরত বলে চলেছে
... এসো আমার কাছে। আমি তো তোমায় খুব ভালবাসি .. এসো..এসো..
কোন রকমে জানালা দিয়ে লাফিয়ে বাইরে পড়লাম৷ উফ !! খুব লেগেছে হাঁটুটা বেশ ছড়েছে ৷ পিছনে তাকিযে দেখি সেই হাতখানা ...এবারে টলমল পায়ে আমি দৌড়াতে লাগলাম৷নিশুতি রাত।সারা আকাশে কুচোকুচো তারা যেন নিজেদের মধ্যেই বাক্যবিনিময় করতে ব্যস্ত।আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। উদভ্রান্তের মত শুধুই দৌড়াচ্ছি।হৃৎপিণ্ডটি যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।কোন কিছু দেখতে পাচ্ছি না আর আমি৷সামনে বিশাল সমুদ্র তাও চোখে পড়ছে না৷তবুও দৌড়াচ্ছি পা গুলো বালিতে ঢুকে যাচ্ছে তবুও খুব জোরে দৌড়চ্ছি। সমুদ্র আমাকে ডাকছে ৷ ঢেউ আমাকে সঙ্গী করে নিয়ে চলেছে দূরে- আরও দূরে.. অনেক দূরে৷
✍️ সমাপ্ত✍️
চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়
৬৪০, জপুর রোড
কলকাতা ৭০০০৭৪