গল্প ।। আন ওয়ান্টেড সেভেনটি টু ।। সিদ্ধার্থ সিংহ
স্বামীর পিছু পিছু বিয়ে বাড়ি ঢুকতেই কনেপক্ষের লোকেরা শুধু হিরণ্যাদেরই নয়, পুরো বরযাত্রী দলটিকেই সোজা নিয়ে গেল কনের কাছে। কনে তখন আলোয় ঝলমল করছে। তার রূপের ছটায় ভেসে যাচ্ছে গোটা হলঘরটাই। এসি চললেও বারবার দরজা ঠেলে লোকজনের আসা-যাওয়া আর কনে দেখার জন্য লোকের ঠাসা ভিড়ে ঘরটায় যেন একটা দম বন্ধ করা অবস্থা। নিশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না।
এই কনের সঙ্গে যার প্রেম করে বিয়ে হচ্ছে, সে হিরণ্যার স্বামীর অফিসের শুধু সহকর্মীই নয়, বহু দিনের বন্ধুও। তাই বরযাত্রী হিসেবে সপরিবার নিমন্ত্রিত হয়েছে তারা। যেহেতু ওদের প্রেম করে বিয়ে, ফলে অফিস ছুটির পরে দু'জনে এ দিকে ও দিকে বেরোবে বলে মেয়েটি মাঝে মাঝেই অফিসের গেটে চলে আসত। তাই ওদের অফিসের অনেকেই কনেকে চেনে।
তেমনই একজন, ও যে কনেকে খুব ভাল করেই চেনে, সেটা দেখানোর জন্য অতি উৎসাহে বরযাত্রীর বাকি সবাইকে ঠেলেঠুলে একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কনেকে বলল, তুমি বোধহয় এদের সবাইকে চেনো না, না? দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন তোমার ইয়ের অফিস-কলিগ কাম বন্ধু, সাবর্ণদা। আমাদের খুব মাইডিয়ার লোক। আর ইনি হচ্ছেন তার সহধর্মিনী। ইনি ধরবাবু, আর ইনি হচ্ছেন তিনি, যিনি ধরবাবুকে ধরে রেখেছেন। ইনি রঞ্জনা, ইনি আমাদের বড়বাবু...
উনি এক এক করে বলেই যাচ্ছিলেন। কিন্তু সে সব কথা কানেই ঢুকছিল না হিরণ্যার। কারণ, কনের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল তার। আরে, এই মেয়েটাই সেই মেয়েটা না!
আগের দিন সন্ধ্যে থেকে সেই সে তুমুল বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বীভৎস্য বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, মনে হয়েছিল, এই ঝড়-বৃষ্টি বুঝি আর কোনও দিনও থামবে না। সে দিন ছিল হিরণ্যার নাইট ডিউটি।
দুর্গাপুর সিটিটা এমনিতে জমজমাট হলেও লোক সংখ্যা কিন্তু অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেক কম। তবু রোজই দু'-চারটে অ্যাক্সিডেন্টের কেস আসেই। কে আম কাটতে গিয়ে ঘ্যাচাৎ করে আঙুল কেটে ফেলেছে। কে দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে ছুটে আসা গাড়ির নীচে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলেও, এত জোড়ে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়েছে যে, সে আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। কে পুকুরে স্নান করতে নেমে আচমকা হাবুডুবু খেতে খেতে তলিয়ে যাচ্ছিল দেখতে পেয়ে একজন তাকে তুলে তো এনেছে, কিন্তু ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সে এত জল খেয়ে ফেলেছে যে, নানা কৌশলে সেই জল বের করলেও সে এতটাই নেতিয়ে পড়েছে যে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।
এ ধরনের কেস এলেই ও সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে ডাক্তারবাবুকে। ডাক্তারবাবু আসার আগেই কেস বুঝে ছুরি-কাঁচি তুলোটুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে ওকে একদম রেড়ি থাকতে হয়। শুধু ও একা নয়, ওর মতো এই হাসপাতালের আরও তিন-তিন জন সিস্টারকে।
কিন্তু সে দিন রাতে ওই ধরনের একটাও কেস আসেনি। ঝড়-জলের জন্য হয়তো কেউ রাস্তাতেই বেরোয়নি, ফলে কোনও গাড়ি-দুর্ঘটনাও ঘটেনি। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে সামান্য মাথা ফাটলেও যেখানে সবাই হাসপাতালে ছুটে আসে, আজ সে রকম কোনও ঘটনা ঘটে থাকলেও ঝড়-জলের জন্য নির্ঘাত তারা বিরত থেকেছে। বাড়িতেই ডেটল-টেটল লাগিয়ে কোনও রকমে সামলেছে।
পেশেন্ট নেই মানে কোনও কাজ নেই। তাই বসে বসে ফেসবুক করছিল হিরণ্যা। রাত কাবার হয়ে তখন ভোর হয় হয়... ঠিক তখনই হঠাৎ কয়েকটা ছেলে ভিজে ন্যাতা হয়ে যাওয়া সপসপে একটা মেয়েকে কোলপাঁজা করে প্রায় টলতে টলতে কোনও রকমে হাসপাতালে নিয়ে এল। সামনে থাকা একটা ট্রলিতে শুইয়ে দিয়ে একটা ছেলে এসে বলেছিল, দিদি, একটা মেয়ে রাস্তার ধারে পড়ে ছিল। মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। জ্ঞান আছে কি না বুঝতে পারছি না। আমরা তুলে নিয়ে এসেছি, একটু দেখুন তো...
ছেলেগুলোও ভিজে চুপচুপে হলেও বৃষ্টি তখনও ওদের গা থেকে মদের গন্ধ ধুইয়ে দিতে পারেনি। ঠিক মতো সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। টলমল করছে। তবু ওদের কথা শোনামাত্র সঙ্গে সঙ্গে ট্রলিতে শুইয়ে রাখা মেয়েটির কাছে ছুটে গিয়েছিল সে। মেয়েটির কাদায় মাখামাখি বিধ্বস্ত চেহারা, অবিন্যাস্ত পোশাকআশাক, গলায়, গালে হাতে আঁচড়ের দাগ দেখেই বুঝতে পেরেছিল, মেয়েটির সঙ্গে কী হয়েছে।
যা হয়েছে, সেটা যে এই ছেলেগুলোই নেশার ঘোরে করেছে এবং সামান্য হুঁশ ফিরতেই তাদের মাথায় নিশ্চয়ই চাড়া দিয়ে উঠেছিল অপরাধবোধ। তাই হয়তো মানবিক কারণেই মেয়েটিকে বাঁচানোর জন্য ওরা শেষপর্যন্ত এখানে নিয়ে এসেছে! এটা বুঝতে তার আর বাকি রইল না।
কিন্তু এখন বেয়ারাদের কোথায় পাবে সে! একে তো ভিতরে নিয়ে যেতে হবে। তাই ছেলেগুলোকেই বলেছিল, ট্রলিটা একটু ভিতরে নিয়ে আসুন তো...
ওদের তিন জনের মধ্যে যে দু'জন তুলনামূলক ভাবে একটু ঠিকঠাক ছিল, সেই দু'জন কোনও রকমে ট্রলিটা ঠেলতে ঠেলতে ভিতরে নিয়ে এসেছিল। ওদের ঢুকতে দেখে তিন জন সিস্টারই সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিল ট্রলিটার কাছে। ট্রলির ওপর ঝুঁকে মুখের ওপর মুখ নিয়ে একজন সিস্টার বলে উঠেছিল, আছে রে আছে, জ্ঞান আছে।
ছেলেগুলোকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে দু'জন সিস্টার সেই মেয়েটার কাদায় লুটোপুটি ভেজা শাড়ি, ছেঁড়াভেড়া ব্লাউজ, সব ছাড়িয়ে দিয়েছিল। সব। তার পর তার গা-টা মুছিয়ে ভাল করে পরিষ্কার করার পর একজন ভিতর থেকে নিয়ে এসেছিল এক গ্লাস গরম দুধ। ওর পিঠের পিছন দিকে তিন-চারটে বালিশ দিয়ে উঁচু করে সেখানে হেলান দিয়ে বসিয়ে যখন সেই দুধটা একটু একটু করে খাওয়াচ্ছিল, তখন একজন সিস্টার বলেছিল, আমি কি তা হলে এখন থানায় একটা ফোন করে দেব?
হিরণ্যা বলেছিল, একটু দাঁড়া।
মেয়েটা ততক্ষণে আধো আধো করে কিছু একটা বলতে চাইছিল, কিন্তু কথা বলবে কি, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নন স্টপ কেঁদেই যাচ্ছিল। তার কোনও কথাই ঠিক মতো বোঝা যাচ্ছিল না। সে হঠাৎ হঠাৎ শিউরে উঠছিল। মাঝে মাঝেই দু'হাতে আচমকা মুখ ঢেকে নিচ্ছিল কোনও এক ভয়ানক আতঙ্কে।
তবু যেটুকু শোনা গিয়েছিল, তাতে বোঝা গিয়েছিল--- মেয়েটি দুপুরবেলায় তার মাসির বাড়ি প্রান্তিকে গিয়েছিল। বিকেল থাকতে থাকতেই সেখান থেকে বেরিয়েছিল। কিন্তু কিছুটা আসতেই হঠাৎ আকাশ কালো করে সে কী ধুন্ধুমার বৃষ্টি। আধ ঘণ্টার মধ্যেই রাস্তাঘাটে জল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সুনসান হয়ে গিয়েছিল সব। একটা-দুটো বাস চলছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। তবু তার মধ্যেই একটা অটোকে আসতে দেখে বাসস্টপেজের ছাউনি থেকে বৃষ্টির মধ্যেই নেমে হাত দেখিয়েছিল ও।
সামনে অটো-চালক ছাড়াও চালকের বাঁ পাশে একজন বসেছিলেন। লোকটাকে দেখেই ওর মনে হয়েছিল, এখানে যখন লোক বসে আছে, তার মানে পিছনে আর জায়গা নেই। তবু ঠেসেঠুসে যদি একটু বসা যায়! তাই ও বলেছিল, যাবেন?
চালক বলেছিল, উঠে পড়ুন।
কালো মোটা পলিথিনের পরদা সরিয়ে ও যখন পিছনে উঠতে যাচ্ছিল, তখনই দেখেছিল পিছনের সিটে কেউ নেই। সিট যাতে ভিজে না যায়, তাই শুধু এ দিকে নয়, ও দিকেও এই একই রকমের পরদা ফেলা। ভিতরে ঢুকে ও ভেবেছিল, সিটটা যখন ফাঁকাই আছে আর এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ উঠবে না, তাই সিটটার মাঝখানে গিয়ে বসেছিল ও। যদি তার মতো কেউ বিপদে পড়ে ওঠে, তখন না-হয় ও দিকে সরে যাবে।
ও উঠতেই অটো চালিয়ে দিয়েছিল চালক। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ওর হঠাৎ মনে হয়েছিল, আরে এ তো যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। এতক্ষণ তো লাগার কথা না! কতটা এসেছে ও, পাশের পরদা সরিয়ে সেটা দেখতে যেতেই প্রবল বৃষ্টির ছাটে এক মুহূর্তে ওর মুখ ভিজে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল বৃষ্টির ছাট নয়, কেউ যেন একসঙ্গে অনেকগুলো ছুচ ফুটিয়ে দিল ওর মুখে। সঙ্গে সঙ্গে ও মুখ সরিয়ে নিয়ে পরদা টেনে দিয়েছিল। ফলে দেখতে পায়নি ও কতটা পথ এসেছে।
যখন অটোটা থামল, কত ভাড়া দিতে হবে জিজ্ঞেস করার আগেই ও দেখেছিল, সামনে বসে থাকা চালক আর ওই লোকটা ঝপ করে নেমে যে দিক দিয়ে ও উঠেছিল, অটোর সেই দিকে দরজা আটকে দাঁড়িয়েছে।
মেয়ে তো! সঙ্গে সঙ্গে বিপদের গন্ধ পেয়েছিল। আর তখনই তার কাছে ছবির মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, চালকের পাশে যে বসেছিল, সে আসলে কোনও যাত্রী নয়, ওই চালকেরই সাগরেদ। বাকিটা বোঝার আগেই ওই দু'জন তাকে একেবারে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ক'হাত দূরে, বড়রাস্তার ওপরেই নির্মীয়মান একটা বাড়ির মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছিল ও। তখন এমনিতেই লোকজন ছিল না। তার ওপরে ঘন ঘন বাজ পড়ার বিকট শব্দ আর বৃষ্টির এলোপাথাড়ি ঝাপটায় সেই চিৎকার কারও কানে গিয়েই পৌঁছল না।
তার পর... ছুটে পালানোর জন্য আপ্রাণ ধস্তাধস্তি, চড়-চাপড়, অবশেষে কান্নাকাটি। অনুনয় বিনয়। ছেড়ে দেওয়ার জন্য হাতে-পায়ে ধরা। কিন্তু না, ও রেহাই পায়নি। দু'জনে মিলেই...
কাজ মিটে যাওয়ার পরে কোনও চিহ্ন যাতে কেউ না পায়, সে জন্য জমাট বাঁধা কয়েকটা ইটের একটা ইয়া বড় চাঁই কোত্থেকে তুলে নিয়ে এসে ওর মাথা থেঁতলে দিতে যাচ্ছিল সেই সাগরেদ। তাকে কোনও রকমে নিরস্ত করেছিল চালক। বলেছিল, দেখছিস না, কী ভাবে পড়ে আছে! ও মনে হয় মরেই গেছে। না মরলেও খানিক বাদে এমনিই মরে যাবে। মাথা থেতলে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এটা করিস না, একদম কেস খেয়ে যাব।
সাগরেদ বলেছিল, ওকে ছেড়ে দিলে আরও বড় কেস খাবি। ও যদি থানায় যায়?
--- গিয়ে কী করবে?
সাগরেদ বলেছিল, পুলিশকে তুই জানিস না... আমি জানি। ওকে এ ভাবে এখানে ছেড়ে যাওয়া মানে নিজেদের বিপদ ডেকে আনা। পুলিশ যদি কোনও ক্লু পেয়ে যায়...
চালক বলেছিল, কিচ্ছু পাবে না। আমি যা বলছি শোন, বাইরেটা একবার দেখ তো...
বাইরেটা এক ঝলক উঁকি মেরে দেখে এসে সাগরেদ বলেছিল, কেউ নেই।
--- তা হলে ধর।
--- কোথায় নিয়ে যাবি?
--- ওই রাস্তার ও পারে। ঝোপের মধ্যে ফেলে দেব। ও দিকে কেউ যায় না। ওখানে ফেললে কিছুক্ষণের মধ্যে এমনিই মরে যাবে। পচে গন্ধ না বেরোলে কেউ টেরও পাবে না।
সাগরেদ বলেছিল, আর যদি বেঁচে যায়?
--- ভাগ্যে থাকলে বাঁচবে।
--- তখন?
--- কোনও ভয় নেই। পুলিশ কোনও ক্লু পাবে না। সমস্ত ক্লু তো এই বৃষ্টির জলেই ধুয়ে-মুছে একেবারে সাফ হয়ে যাবে।
ওর শরীরে তখন নড়াচড়ার মতোও সাড় নেই। ওরা একজন ওর দুটো পা আর একজন ওর দুটো হাত ধরে চ্যাংদোলা করে গাড়িরাস্তার ও পাড়ের ঝোপের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় হুসহাস ছুটে আসা গাড়ির বড় বড় হেড লাইটের তীব্র আলো ওদের গায়ে পড়ায় ওদের আর সাহস হয়নি, ও ভাবে মেয়েটিকে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার। মেয়েটিকে টেনে নিয়ে আবার যে ওই নির্মীয়মান বাড়িতে নিয়ে যাবে, তারও রিক্স নিতে পারেনি। তাই কেউ দেখে ফেলার আগেই ঝপ করে কোনও রকমে এ পারের রাস্তার ওপরেই মেয়েটিকে ফেলে অটো নিয়ে চম্পট দিয়েছিল।
ও যে উঠে দাঁড়াবে সে সাধ্যও ছিল না। কাউকে যে ডাকবে, গলা দিয়ে কোনও আওয়াজও বেরোচ্ছিল না। তিরের ফলার মতো সারা শরীরে বিঁধতে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা ওকে স্পর্শই করতে পারছিল না। শুধু বুঝতে পারছিল, যন্ত্রণায় ওর শরীর ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই, হঠাৎ ওর চোখের ওপরে পড়ল তীব্র একটা আলো। তাকে ঘিরে একজন, দু'জন, তিন জন, নাকি আরও আরও আরও... ভয়ে-আতঙ্কে শিঁটিয়ে গেল ও। তা হলে কি আবার... এরাও...
কয়েক মুহূর্তমাত্র। একজন ঝুঁকে হাঁটুর উপরে উঠে থাকা ওর আলুথালু শাড়ি ঠিক করে দিয়েছিল। শতচ্ছিন্ন ব্লাউজ ঠিকরে ওর শরীরের গোপন কোনও অংশ যাতে দেখা না যায়, শাড়ির আঁচল দিয়ে যতটা পারা যায়, সে ঠিক করে ঢেকেঢুকে দিয়েছিল। তার পর তারাই ধরাধরি করে আমাকে তাদের গাড়িতে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে।
সব শুনে হিরণ্যা বলেছিল, ঠিক আছে, ডাক্তারবাবুকে কল করা হয়েছে। উনি আসছেন। উনি এলেই আপনার পি ভি একজামিনেশন হবে। আসলে এটা তো মেডিকো লিগ্যাল কেস। ডাক্তারবাবু দেখার পরে পুলিশে ইনফর্মেশন পাঠাতে হবে। আপনি একটু ধাতস্ত হলে ওরা আপনার সঙ্গে একটু কথা বলবে।
আঁতকে উঠেছিল মেয়েটি। বলেছিল, না না, আমি থানা-পুলিশ চাই না। যা হওয়ার হয়েছে, আমি চাই না এটা জানাদানি হোক। আপনারা আমাকে ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি যাব।
হিরণ্যা ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, কিচ্ছু জানাজানি হবে না। কেউ জানবে না। এটা একটা রুলস। ওরা শুধু আপনার একটা জবানবন্দি নেবে।
মেয়েটি বলেছিল, আমি এ সব কথা কাউকে বলতে পারব না।
হিরণ্যা বলেছিল, আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেউ জানতে পারবে না। এ সব কেসে পুলিশ সাদা পোশাকে আসে এবং তাদের সঙ্গে একজন মহিলা পুলিশও থাকে।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মেয়েটি বলেছিল, আমি আর বাঁচতে চাই না।
--- এ মা, এ সব কথা বলছেন কেন? এ সব কথা একদম বলবেন না। এতে আপনার দোষ কোথায়? কোনও পোকা যদি একটা ফুলে এসে বসে, তা হলে কি সেই ফুলটা নষ্ট হয়ে যায়? আর আপনার শরীরের যা ক্ষতি হয়েছে, সেটা আমরা ঠিক রিপেয়ার করে দেব। কেউ টের পাবে না। আর মনের ওপরে যে চাপ পড়েছে, সেটাও কয়েকটা কাউন্সিলিং করে আমরা ঠিক স্বাভাবিক করে দেব।
--- আমার এখনও বিয়ে হয়নি। যদি পেটে কোনও বাচ্চাকাচ্চা এসে যায়!
--- বললাম তো, কোনও ভয় নেই। এক সময় আপনাদের মতো মেয়েদের কথা ভেবেই অবাঞ্ছিত গর্ভ রোধ করার জন্য তৈরি হয়েছিল একটা ট্যাবলেট--- আই পিল। এখন যার পোশাকি নাম--- আন ওয়ান্টেড সেভেনটি টু। এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটার বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে ওটা খেলে আর কোনও ভয় থাকে না। এখন তো ওষুধের দোকানে এগুলো মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হয়।
সে দিন ওকে মাত্র কয়েক ঘণ্টা অবজার্ভেশনে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ওর শরীরে যত না ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছিল ওর মনের।
সেই ক্ষত সারানোর জন্য মেয়েটিকে পর পর বেশ কিছু দিন আসতে হয়েছিল হিরণ্যার কাছে।
মেয়েটিকে ওই ক'দিনে এত কাছ থেকে এত ভাল ভাবে হিরণ্যা দেখেছিল যে, ও যতই বিয়ের সাজ পরে থাকুক না কেন, যতই রংচং মেখে ডানা কাটা পরি হয়ে উঠুক না কেন, ওকে চিনতে কিন্তু কোনও অসুবিধেই হয়নি। আর হিরণ্যাও যে ওকে বিলক্ষণ চিনতে পেরেছে, সেটা ওই মেয়েটিও বেশ বুঝতে পেরেছে। আর তা বোঝামাত্রই তার শরীর দরদর করে ঘামতে শুরু করেছে। কারণ, হিরণ্যাকে ও চেনে। ও যখনই হাসপাতালে যেত, তখনই দেখত কোনও পেশেন্ট না থাকলে ওরা দু'-তিন জন সিস্টার মিলে শুধু পি এন পি সি করছে। তার শাশুড়ি কত খারাপ। তার ননদ তার চেয়েও কত ভয়ানক। আর তার স্বামী? সে সব দেখেও কী ভাবে চোখে ঠুলি পরে থাকে। হাসপাতালের ওই ডাক্তারবাবু তার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। তারই সহকর্মী ঊর্মিলা তার পায়ের ওপর পা দিয়ে কী রকম ভাবে ঝগড়া করে।
প্রায় রোজই এ সব শুনত ও। শুধু পরনিন্দা পরচর্চা। কিন্তু না, তাকে কখনও কারও সম্পর্কে ও কোনও দিন ভাল কথা বলতে শোনেনি। আর যে মেয়ে এই রকম, সে কি ওর সঙ্গে ঘটা ওই রকম একটা কেচ্ছা জেনেও চুপচাপ বসে থাকবে! কাউকে বলবে, না! আচ্ছা, সে যদি সত্যি সত্যিই এখন কাউকে ওই কথাটা বলে দেয়! তা হলে কী হবে! এখন জানাজানি হলে তো বিয়েটাই ভেঙে যাবে। আর বিয়ের পর বললে? ভেঙে যাবে পুরো সংসারটাই।
পাত্রের বাড়ির কাউকে না বলে যদি কখনও কথায় কথায় নিজের স্বামীকেও চুপিচুপি বলে ফেলে, সেটা কি আর শেষ পর্যন্ত চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে! সে কি তার অফিস কলিগ কাম বন্ধু, ওর হবু বরকে একবারও বলবে না! সে তখন কী করবে! এটা একটা নিছক দুর্ঘটনা ভেবে মেনে নেবে? নাকি... নাকি... নাকি... আর সেটা যখন ওর শ্বশুরবাড়ির কারও কানে উঠবে, তখন?
যে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল, সে ততক্ষণে সবার সঙ্গেই নতুন কনের আলাপ করিয়ে দিয়েছে। একটু পিছন দিকে দাঁড়িয়ে ছিল হিরণ্যা। তার সঙ্গে যখন আলাপ করাতে যাচ্ছে, নতুন কনের মুখ তখন একেবারে রক্তশূন্য। কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এক ঢোক জল খেতে পারলে বুঝি বাঁচে।
প্রথম দিকে যত জনের সঙ্গে ওকে আলাপ করিয়ে দিচ্ছিল, ও হাসি হাসি মুখে জোড় হাত করে প্রণাম করছিল। এ পাশ ও পাশ থেকে ফোটোগ্রাফাররা ঝপাঝপ ছবি তুলছিল। দু'-দুটো মুভি ক্যামেরা তাক করে ধরে রাখছিল পুরো দৃশ্যটা। কিন্তু হিরণ্যাকে দেখার পর থেকে নতুন কনের জৌলুস যেন এক ঝটকায় উবে গেছে। কনে তখন মনে মনে ভাবছিল, সুযোগ পেলে কি তা হলে একবার হিরণ্যার কাছে গিয়ে ও বলবে, সে যেন সেই দিনের ওই ঘটনাটা কাউকে না বলে...
ও যখন এ সব ভাবছে, তখন যে আলাপ করিয়ে দিচ্ছিল, সে নতুন কনের সঙ্গে হিরণ্যার পরিচয় করিয়ে দিতেই আর পাঁচ জন বরযাত্রীর মতোই হাসি হাসি মুখ করে হিরণ্যাও নমস্কার করল। তার পর যিনি আলাপ করিয়ে দিচ্ছিলেন, তাঁর দিকে ঝট করে একবার তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, বউ তো খুব ভাল হয়েছে গো! খুব মিষ্টি। বলেই, নতুন কনেকে মাথা কাত করে 'আসছি' বলে যে দিকে বুফে ছিল, বাকিদের সঙ্গে সে-ও সোজা সেই দিকে পা বাড়াল। একবার ফিরেও তাকাল না। যেন ওকে চেনা তো দূরের কথা, আগে কোনও দিন দেখেইনি।
-----------------------------------
SIDDHARTHA SINGHA
27/P, ALIPORE ROAD,
KOLKATA 700027