বাংলা ছোটগল্পের অনন্য রূপকার বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল । তিনি ছোটগল্পের আঙ্গিকে এনেছেন চমক , কিন্তু আঙ্গিক সর্বস্বতা ছাড়াও তাঁর ছোটগল্পগুলো বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর । তাঁর গল্গগুলো একাধারে পোষ্ট কার্ডস্টোরি বা Five minutes story হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে । তিনিই বাংলাভাষায় অণুগল্পের প্রবর্তক । ছোটগল্পের শিল্পরীতি নিয়ে তিনি বারবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন ।
ব্যক্তি জীবনে ডাক্তার হওয়ায় বনফুলের অনেক গুলো উপন্যাসের মতো তাঁর অনেকগুলো ছোটগল্পেও ডাক্তারি জীবনের অভিজ্ঞতা বিষয় হয়ে উঠেছে । এজন্য ডঃ সুকুমার সেন 'বনফুলের গল্প সংগ্রহে'র ভূমিকায় লিখেছেন , ''বাংলা ছোটগল্পে বনফুল যে নব নব রস জমিয়ে তুলেছেন তার মধ্যে একটা উদাহরণ দিচ্ছি; যাকে নাম দিতে পারি ডাক্তারি রস।'' 'নাথুনীর মা ' , 'দণ্ডকৌমুদি', 'ত্রিফলা', 'সুরবালা,' 'গণেশ জননী' ইদ্যাদি গল্পে সেই ডাক্তারি রসের অভিব্যক্তি ঘটেছে ।
বনফুলের ছোটগল্পের বিষয় মানুষ -- বিচিত্র ধরণের মানুষ । কাব্যধর্মী ও প্রতীকধর্মী 'নিমগাছ' টির কথাই ধরাযাক, গল্পের শেষে 'বাড়ির গৃহকর্ম নিপুণা লক্ষ্মীবউ' 'আর নিমগাছ' যেন পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে ।
বনফুলের ছোটগল্পে আপাত একটা নিস্পৃহতা থাকলেও সমাপ্তিতে তিনি এক জাতীয় চমক সৃষ্টি করেন । ' সমাধান 'নামক গল্পটিতেও দেখি সেই চমক। গল্পের মূল চরিত্র নীহাররঞ্জনের চিন্তার শেষ নেই কুদর্শনা বুচির বিয়ে দেওয়ার সমস্যা নিয়ে। নিষ্কর্মা নীহাররঞ্জন চণ্ডীমণ্ডপে এনিয়ে আলোচনার সময় ডাক পিয়নের দেওয়া চিঠি পড়ে জানায়, স্ত্রী ক্ষান্তমণি বাপের বাড়ি থেকে চিঠি লিখে জানিয়েছে , ''বুচি কাল মারা গেছে।''
হাস্যরসিক বনফুলের 'অদ্বিতীয়া' গল্পে একদিকে যেমন দাম্পত্য জীবনের ট্র্যাজেডি, অন্যদিকে তেমনি হাস্যরসের ভিয়ানে তা উচ্চকিত হয়েছে। স্ত্রী প্রভাবতীর ধারণা ছিল স্বামীর জীবনে সে অদ্বিতীয়া। শ্যালিকার ষড়যন্ত্রে স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ পাবার মাস তিনেকের মধ্যেই পত্নীব্রত স্বামীটি গোঁফ কামিয়ে তরুণ সেজে বিয়ে করে ফেলে। ফুলশয্যার রাতে সে রহস্য উন্মোচিত হয় , যখন দেখে সাত সাতটি সন্তান পরিবৃতা প্রথমাই নববধূ রূপে পালঙ্কে বসে আছে। পুরুষ পরীক্ষায় শ্যালিকার এই বাজি রাখা রসিকতা যুগপৎ স্বামী স্ত্রীকে বাস্তব সত্যের সম্মুখীন করায় তা যেমন উপভোগ্য হয়েছে , তেমনি হৃদয় বিদারকও বটে। আবার 'ক্যানভাসার' গল্পে দেখা যায় হীরালাল গ্রামে গ্রামে দাঁতের মাজন বিক্রি করলেও তার নিজস্ব দাঁত বাঁধানো ।
বনফুল যে স্যাটায়ারের সূক্ষ্ম কাজেও সমান দক্ষ তার পরিচয় বিধৃত আছে 'শ্রীপতি সামন্ত' ও 'ছোটো লোক' নামক গল্প দুটিতে । 'শ্রীপতি সামন্ত' গল্পে দেখা যায়, পাইপ-শোভিত বদন সাহেবি পোশাক ধারী প্রথম শ্রেণির বাঙালি বাবুটি, ধূলি মলিন পোষাক পরিহিত তৃতীয় শ্রেণির যাত্রী শ্রীপতি সামান্ত ভিড়ের কারণে সেখানে উঠতে না পেরে, প্রথম শ্রেণির সংলগ্ন ভৃত্যের কামারায় উঠতে চাইলে বাঙালি বাবুটি আপত্তি করেন। কিছু পরে পাঞ্জাবি ক্রু এসে টিকিট চাইলে, তিনি ক্রুকে সমস্ত চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে বিনা টিকিটের ভণ্ড সাহেবটিকের লজ্জার হাত থেকে বাঁচান। তখন নকল প্রথম শ্রেণির যাত্রীর মুখে রা নেই।
আর 'ছোটো লোক' গল্পে দেখি অনমনীয় চরিত্র রাঘব সরকার চলার পথে রিকশাওয়ালার কাকুতি মিনতিতে দয়া পরবশ হয়ে রিকশায় না চড়েই, গন্তব্যস্থানে এসে ভাড়া দিতে গেলে রিকশাওয়ালা যখন বলে, "আমি কারো কাছে ভিক্ষা চাই না।" সেদিন তিনি প্রথম অনুভব করলেন যে ছোটো লোকের ও আত্ম মর্যাদা থাকে। এই মর্মবিদারী আঘাতটি আদর্শ বিলাসী তথাকথিত ভদ্রলোক বেশী রাঘব সরকারের পক্ষে চক্ষুরুন্মীনকারীও বটে ।
বাংলা সাহিত্যের অপরাপর লেখকদের মতো বনফুলের 'আলোবাবু' ও 'গণেশ জননী' গল্প দুটি পশু প্রীতির উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। একটি মানুষ কেবল পশুপ্রীতির জন্য জীবনে কোথাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারল না -- লোকে বারবার তাকে ভুল বুঝল অথচ নিজের সন্তানের মতো পশুপ্রীতি তার ঘুচল না -- এমন এক চরিত্রের অধিকারী 'আলোবাবু'। আর সন্তানহীন এক দম্পতি গণেশ নামক এক হাতির বাচ্চা পুষতে গিয়ে কীভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল 'গণেশ জননী' গল্পটি ।
হাসির গল্প এবং ছোটদের রচনাতেও বনফুল কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কিশোর সাহিত্য হল 'করবী', 'তিন কাহিনী', 'অলঙ্কাপুরী' প্রভৃতি। বঙ্গ সাহিত্যে বনফুলের অসামান্য অবদান স্মরণ করে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, " ... অর্জুন যেমন করিয়া কুবেরের ভাণ্ডার জয় করিয়া স্বর্ণচম্পাকে জননীর উপাস্য দেবতার মন্দির পূর্ণ করিয়াছিলেন, তুমি তেমনই বনফুল দিয়া বঙ্গসরস্বতীর মন্দির পূর্ণ করিয়া তুলিতেছ।"
--------------------------
দীপঙ্কর সরকার
কাঁঠাল পুলি
(সিংহের হাটের কাছে)
চাকদহ
নদীয়া
৭৪১২২২