গল্প।। আনন্দ যজ্ঞে।।সান্ত্বনা ব্যানার্জী
"শুনছো! অভ্রো ফোন করেছে"....স্বামী অনিন্দ্যর ডাকে তাড়াতাড়ি হাতের কাজ গুলো সারতে থাকে রত্না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে পৌনে এগারটা ! নিচের আলো নিভিয়ে তাড়াতাড়ি সিড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠে ও ছেলের ফোন ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে। ফোনের বহু কু প্রভাব থাকলেও এই দিক টা যে কত প্রয়োজনীয় সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।রোজরাতে প্রবাসী ছেলে বৌমার গলার স্বর শোনা, মাঝে মাঝেই ভিডিও চ্যাট ,দীর্ঘ অদর্শনের যন্ত্রণায় অনেকটাই প্রলেপ দেয়। "কি করছিলে মা এতক্ষন নিচে? গান শুনছিলে নিশ্চই! "ছেলের কথায় হাসে রত্না,"না রে,কাল একটু স্কুলের কাজে ডি আই অফিস যেতে হবে,তাই কাগজ পত্র গুছিয়ে রাখছিলাম। বল কি খবর, সবাই ভালো আছিস তো?"...."হাঁ মা, ভালো আছি, তবে...."তবে কি! কোনো সমস্যা!"......."না,না, তেমন কিছু নয়, ওই মানসী আর অভিমন্যুর ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। "আকাশ থেকে পড়ে রত্না!
"সে কি রে! এই তো মাস তিনেক আগে তোদের ওখানে গিয়ে সবাই মিলে কত আনন্দ করে এলাম! ওদের পোষ্য কুকুর জলিকে কী সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল! সোয়েটার পরিয়ে,টিপ পরিয়ে, বড়ো বড়ো লোম গুলোকে চুলেরমত হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে, ভারি মিষ্টি লাগছিল, কত আদর করলাম,খেলা করলাম ওর সঙ্গে। দুজনেই একটা প্রাণীকে এত ভালবাসে যত্ন করে দেখে খুব ভালো লেগেছিলো আমার।"ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে অভ্র" এই তোমার দোষ, সবেতেই এত চাপ নিয়ে ফেলো কেনো বলতো? এ সব এখন সাধারণ ব্যাপার। নাও নাও অনেকরাত হয়ে গেছে,এবার শুয়ে পড়ো।"গুড নাইট বলে ফোন কেটে দেয় অভ্র। বড়ো মন খারাপ হয়ে যায় রত্নার।অভ্র কি বললো! সাধারণ ব্যাপার!পাঁচ বছর ধরে গড়ে তোলা একটা সংসার!আত্মীয়, স্বজন,স্নেহ মমতা,সব এক কলমের আঁচড় কেটে ভেঙে ফেলা সাধারণ ব্যাপার!কিছুতেই ঘুম আসেনা । কি এক কষ্টে মুচড়ে ওঠে বুকটা! ওরা কেউ নিজের লোক নয়, ছেলে বৌমার বন্ধু,তবুও,বেশ কয়েক বার ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, বেশ সহজ সরল বলেই তো মনে হয়েছে।এমনকি অভিমন্যুর মা সোমার সাথেও তার একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ওরাও দেশের বাড়ী থেকে মাঝে মাঝে আসে, ছেলে বৌমার কাছে, দু এক মাস থাকে। বেশিরভাগ তো স্বামী স্ত্রী মিলেই থাকে।তবুও ডিভোর্স! অবাক লাগে রত্নার। রত্না তো একান্নবর্তী পরিবারের মেয়ে আবার আরও বড়ো একান্নবর্তী পরিবারের বৌ। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছে মা,কাকিমাদের সারাদিন ছোটাছুটি করে কাজ করতে।বাড়িতে জনা পনেরো সদস্য তো বটেই, তার ওপর এসো জন বসো জন, তো লেগেই থাকতো। একটু ভালো কথা বললেই মা কাকীমা একেবারে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত।সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও একটু রেডিওতে গান আর নাটক শুনেই কি খুশি!নিজের কথা ভেবেও অবাক লাগে। কত অল্প বয়সে এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলো রত্না। লড়াই তো কম করেনি! সকলকে খুশি করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে।শ্বশুর বাড়ির মা বাবার অকুণ্ঠ ভালোবাসা আর সহযোগিতাকে হাতিয়ার করে বহু প্রতিকূলতাকে জয় করেছে,কিন্তু কখনো এই সংসার ছেড়ে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি! অথচ এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা! সব তো নিউক্লিয়ার পরিবারের। বিশেষ কোনো দায় দায়িত্ব পালন করতেই হয়নি ওদের। সাছন্দ্য স্বাধীনতা ওরা পেয়েছে অনেক বেশী। এসব ভাবতে ভাবতেএক সময় ঘুমিয়ে পড়ে রত্না। সকালে ঘুমভাঙতেইতাড়াতাড়ি উঠে পড়ে কাজে লেগে যায়। রান্না করে,চান খাওয়া করে দুজনে সোজা স্টেশন! আজকাল বয়স বাড়াতে বড্ড ভুলো হয়ে যাচ্ছে রত্না। পাছে পথে দরকারি ফাইল পত্র ফেলে যায় তাই সঙ্গে যায় অনিন্দ্য। অফিসে কাজ মিটিয়ে আবার স্টেশনে এসে দেখে ট্রেন সঠিক সময়ে বেরিয়ে গেছে। পরের ট্রেন চল্লিশ মিনিট পর। একটা চায়ের দোকান দেখে সে দিকেই এগিয়ে যায় দুজনে।একটি অল্প বয়সী বউ চা করছে। "চিনি ছাড়া চা হবে? "জিজ্ঞেস করে অনিন্দ্য।....না কাকাবাবু চিনি ছাড়া হবেনা,তবে খুব কম চিনি দিয়ে করেছি, একদিন খান ,কিছু হবে না।"শ্যামলা বউটির মিষ্টি কথায় না করতে পারে না অনিন্দ্য।ট্রেনের তো অনেক দেরি। তাই দুজনেই আরাম করে বসে সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে। স্বামীটি আংশিক প্রতিবন্ধী। বিস্কুটের কৌটো খুলে ওদের দিকে দুটো বিস্কুট বাড়িয়ে দিয়ে বলে "এই বিস্কুট টা খাও কাকা, খুব টেস্টই।"শ্যামলা বউটি কেমন আদুরে গলায় বলে ,"থাক, আর ইংরিজি বলতে হবেনা!"...পাশে এক বৃদ্ধ বসে আছে এক ঝুড়ি ডিম নিয়ে,কেমন নির্বিকার চিত্তে। বিক্রি করার তারাও নেই তেমন।তাকেও এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বলে ছেলেটি,"নাও দাদু, চা খাও। আজ দিদিমা কি রান্না করে খাওয়ালে গো !"কেমন খুশিতে চকচকে হয়ে ওঠে বৃদ্ধের মুখ!...."আজ দারুন রান্না করেছিল রে দিদিমা! সজনে ফুলের ঝাল, চুনো মাছের চচ্চড়ি,আর মূলো,কুমড়ো বড়ি দিয়ে তেঁতুলের টক!".......ও হো,শুনে তো আমার জিভে জল এসে গেল!মজা করে বলে ছেলেটি।...দিদিমা এদিক পানে কখন আসবে গো ? ঘাড় নেড়ে বলে বৃদ্ধ,"তার ঢের দেরি। আপ,ডাউন, দুদিকের টেরেন যাবে,শাকের আঁটি সব বিকবে,তবে না আসবে। এসেই তো তোর কাছে চা চাইবে,রেডি থাকিস।" ওদের এই মজা,হাসি চলতেই থাকে খোদ্দেরদের চা দিতে দিতে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করে রত্না, অনিন্দ্য মুচকি হেসে হেসে বেশ উপভোগ করছে। ওর দিকে চোখ পড়তেই মৃদু স্বরে বলে,"দেখো কি সামান্য আয়োজনে ওরা কত খুশি! টাকা পয়সা দিয়ে আনন্দ কেনা যায় না,আনন্দ পেতে জানতে হয়।"চোখ দুটো কি এক তৃপ্তিতে ভিজে ওঠে রত্নার,আর তখনই মানসী আর অভিমন্যুর ডিভোর্স এর কথাটা মনে পড়ে যায়! ততক্ষনে অনিন্দ্য আরও দু কাপ চা আর বিস্কুটের অর্ডার দিয়ে ফেলেছে ,হয়তো এই আনন্দ যজ্ঞে আর কিছুক্ষণ সামিল হওয়ার আশায়!
----------------