গল্প ।। ব্যর্থ আশা ।। হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
চাকরির জন্য চেষ্টা করছিল হিতেশ। কোনভাবে আকাশের চাঁদকে হাতের মুঠোয় আনতে পারছে না সে। শেষপর্যন্ত সে মনের ইচ্ছা দমন করে যেকোন একটি ব্যবসা করার কথা ভাবতে ভাবতে স্টেশনে এসে হাজির হল।
স্কুল ছুটি হয়েছে। পড়তি বিকেল। গ্রীষ্মের দিনে সন্ধ্যা হতে এখনও অনেক বাকি। বিকালের নরম আলো ক্রমশ আরো নরম হচ্ছে। গরমের তীব্রতাও কমে আসছে। একদল ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে হেঁটে স্টেশনে এসে উপস্থিত হল। দেখে মনে হয়, তারা একাদশ কিংবা দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রী। শিক্ষার মধ্যে থাকায় তারা প্রাণবন্ত। তাদের তারুণ্য দুঃখ ও দুর্দশা থেকে তাদের অনেক দূরে রেখেছে।
স্টেশনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সবাই হাঁটতে হাঁটতে রেল লাইনের অপর পারের রাস্তা দিয়ে চলে গেল। একজন ছাত্রী থেকে গেল স্টেশনে। যারা চলে গেল তারা কোন এক শিক্ষকের কাছে টিউশনি পড়ে। তারা যাবার সময় বলে গেল, "তুই সাইন্স পড়িস। আমাদের সঙ্গে তুই তো পড়তে যাবি না। যা বাড়ি চলে যা।"
এরপর হিতেশের দিকে তাকাল মেয়েটি। কমলা রঙের স্কুল শাড়িতে তার ফর্সা গায়ের রঙ জ্বলছে বিকেলের আলোয়। চোখ ফেরাতে পারছিল না হিতেশ। তার কাঁধে ছিল একটা স্কুলব্যাগ। স্কুল ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে জল খায় সে।
বোতলের ছিপি আটকাতে আটকাতে সে আবার হিতেশের দিকে তাকায়। তারপর সে মুচকি হেসে বোতলটা ব্যাগের মধ্যে রাখল।
অনেক অর্থকষ্টের মধ্যেও হিতেশ এমন একটি আলোকিত হাসিমুখ দেখে নিজেও হেসে ফেলল। তারপর বারবার একে অপরকে দেখা আর স্মিত হাসি হাসা চলতে লাগল। মেয়েটি এক যায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হিতেশের বারবার মনে হচ্ছিল তার কাছে গিয়ে কথা বলতে। কিন্তু সঙ্কোচ তাকে বাধা দিচ্ছিল। পাছে পরিচিত কেউ তাকে দেখে ফেলে। যদি কেউ কিছু বলে!
ধীরে ধীরে স্টেশনে লোক জমছিল। ট্রেন আসার সময় ক্রমশ এগিয়ে আসছে। হিতেশ এবার নিজের মনকে শক্ত করে ফেলেছে। ট্রেন এসে পড়লে তার সাথে কথা বলা হবে না তার। লোকের ভিড়ে কোন বগিতে উঠে পড়বে সে জানে না। লেডিস কামরায় উঠে পড়লে আর কখনও সাক্ষাৎ হবে কিনা সন্দেহ!
ততক্ষণে ট্রেন আসার ঘোষনা হয়েছে মাইকে। লোকও ভিড় জমিয়েছে। আর সময় নেই। এবার একটি বারের জন্য কথা বলতেই হবে। ভাবল হিতেশ। মেয়েটিও একপা এগিয়ে এলো। এখন দুজনের মুখে হাসি। চুম্বক যেন পরস্পরকে আকর্ষণ করছে।
হিতেশ এগিয়ে যেতেই দুটি ছেলে গিয়ে দাঁড়াল মেয়েটির সামনে। হিতেশ দাঁড়িয়ে পড়ল। সে লক্ষ্য করতে থাকে, তারা কী করছে! মেয়েটিকে কী যেন বোঝাচ্ছে তারা! হিতেশের দিকে তাকিয়েও কথা বলল তারা। কী বলছিল জানতে পারল না হিতেশ। মেয়েটি আরো একবার হিতেশের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো এবং তাদের কথা শুনতে লাগল।
ইতিমধ্যে ট্রেন এসে গেল ক্যানিং স্টেশনে। গেটের একপাশ দিয়ে লোক নামছে আর অপর পাশ দিয়ে লোক উঠছে। মেয়েটি কোন কামরায় উঠলো জানতে ইচ্ছা করছে হিতেশের। নিজের কামরায় একবার ভালো করে দেখে নিল সে। কোথাও নেই সে। সে ভাবল, নিশ্চিত অন্য কামরায় উঠেছে মেয়েটি।
বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দেয়। জানলার কাছে বসেছিল হিতেশ। ট্রেনে উঠলেই, বসার সুযোগ পেলে ঘুমোত সে। আজ তার চোখে ঘুম নেই। তাকে দেখার উৎকণ্ঠায় ঘুম ছুটে গেছে তার। সে ভাবে এমনটা তো তার হয় না কখনও। সে প্রতি স্টেশনে উঁকি মেরে দেখতে থাকে বাইরে। একবার যদি তাকে চোখের দেখা দেখতে পাওয়া যেত সে!
একের পর এক স্টেশন চলে যাচ্ছে। দেখা নেই তার। চাম্পাহাটি স্টেশনে লোকের ভিড় প্রচুর। গলগল করে লোক উঠছে ও নামছে। কাউকে দেখার সুযোগ নেই হিতেশের কাছে। হতাশ হয়ে সে তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। চোখে পড়ল সেই মুখ। প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে সে। হিতেশকে দেখে হাসিমুখে হাত নাড়াল মেয়েটি। তার ছুটে যেতে ইচ্ছা করল মেয়েটির কাছে। চলমান ট্রেন থেকে নামার সাহস হল না তার।
সেদিনের হাতছানি বারবার স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে হিতেশের মনে। কিন্তু স্মৃতি স্মৃতিই হয়ে রয়ে যায়। এক বন্ধুকে সেদিনের ঘটনা জানিয়েছিল হিতেশ। সে বলেছিল, "তোর মন যখন চেয়েছিল তখন তুই সাহস করে কথা বললি না কেন তার সাথে।" বন্ধুর কথা শুনে নিজেকে ভীরু মনে হয়েছিল হিতেশের।
কমবেশি পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। মনে মনে গুন গুন করতে করতে স্টেশনে এসে পৌঁছালো হিতেশ। হঠাৎ স্টেশনে একটি মুখ দেখে আৎকে ওঠে সে। সেই উজ্জ্বল মুখ মেয়েটি মোবাইল হাতে একজনের সঙ্গে কথা বলছিল। তড়িঘড়ি সে মোবাইল বন্ধ করে এগিয়ে এলো। সরাসরি হিতেশকে বলল,"এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? কোন পথে যাতায়াত করো। পাঁচ বছর তোমাকে খুঁজছি। আজ তোমার দেখা পেলাম।"
"এতদিন হয়ে গেল। মাত্র পনেরো কুড়ি মিনিট আমাদের চোখাচোখি হয়েছিল। কথা হয়নি। এটুকুই আলাপ। তাতে তুমি আমার মুখ মনে রেখেছ?" জিজ্ঞেস করে হিতেশ।
"তুমিও আমাকে চিনতে পেরেছ। নয়তো এত ইতিহাস বললে কি করে? তাছাড়া, এখানে শেষ নয়। আমি তোমাকে হাতছানি দিয়ে প্রথম আবেদন করেছিলাম।" বলল মেয়েটি।
হিতেশ জিজ্ঞেস করে, "তোমার নাম কি?"
"আমি রিনি। তুমি নিশ্চয়ই হিতেশ,"বলল সে।
হিতেশ বলল,"আমার নাম জানলে কিভাবে?"
সে বলল,"আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি। তোমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। আগে চা খাবে চলো।"হিতেশ বলল,"আমি চা খাই না।"
"তাহলে মিষ্টি। বা অন্য কিছু।" বলল রিনি। তারপর সে তাকে হাত ধরে একটা মিষ্টির দোকানে নিয়ে যায়। মুখোমুখি বসে দুজনে। সে দুজনকে মিষ্টি দিতে বলে দোকানদারকে।
"আমাকে যত্ন করার কারণ কি?" জানতে চাইল হিতেশ।
"যার জন্য এতদিন অপেক্ষা করে আছি, তাকে পেয়ে যত্ন করব না!" বলল সে।
"অপেক্ষ করে আছো? কিসের অপেক্ষা?" প্রশ্ন করে হিতেশ।
"তোমাকে পাওয়ার অপেক্ষা। তুমি কি করো?" জানতে চায় রিনি।
"আমি প্রাথমিক শিক্ষক।" বলল সে।
"তাহলে আমার আশা পুর্ণ হয়েছে। আমি এখন হাইস্কুলে চাকরি করি। তোমাকে নিয়ে গেলে আমার মা খুশি হবেন।" বলল রিনি।
রিনির কথা শুনতে শুনতে হতবাক হয়ে যাচ্ছিল হিতেশ। সেই ঘন কালো কাজল পরা চোখ নিয়ে রিনি আজও তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে ভাবে, আমি শুধু তার কথা ভেবেছি। তাকে খুঁজিনি, অপেক্ষাও করিনি তার জন্য। কারণ সে ছিল আমার কাছে অনিশ্চয়তা। কিন্তু রিনি কিভাবে অনিশ্চয়তাকে আঁকড়ে বেঁচে আছে?
সে রিনিকে বলে,"সে অনেক পুরনো কথা। তুমি ভুলে যাও।"
রিনি বলে,"পুরানো কথাকে মনে চেপে ধরে আমি আজও বেঁচে আছি। আমি তোমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাব। আমার মা তোমাকে দেখলে তাঁর বিশ্বাস হবে আমি তাকে এতদিন মিথ্যা বলিনি।"
হিতেশ ভাবে, ঘোর বিপত্তি। কেন এমন হচ্ছে। আমি কখনও কাউকে কথা দিই নি। সেদিন কথা হলে হয়তো জীবন অন্যরকম হতো। এখন রিনির কথা ভাবার অবকাশ নেই আমার।
রিনি বলে, "তুমি কি ভাবছ? আমাকে সেদিন শাড়িতে দেখেছিলে। আজ দেখছ চুরিদার পরতে। তুমি চাইলে আমি সবসময় শাড়িই পরব।"
হিতেশ চিন্তা করে সে তাকে এভাবে শর্ত দিতে যাবে কেন। সে তার কে?
রিনি বলে,"তুমি শিক্ষকতা করো শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। এই পেশা আমার খুব প্রিয়। কত শিশুদের তুমি আলো দেখাতে পারছ।"
রিনি এত তাত্ত্বিক জ্ঞান সঞ্চয় করেছে! সমাজ সম্পর্কে ধরণা রাখে সে। তার এই ত্যাগ ও শিশুদের প্রতি ভালোবাসা তাকে আরও বড় হতে সাহায্য করবে বলে মনে করে হিতেশ।
রিনি আবার বলে, "তোমার আপত্তি না থাকলে আজ আমাদের বাড়িতে থেকে যাবে তুমি।"
হিতেশ বলে ওঠে, "অসম্ভব রিনি। আমি তোমার বাড়িতে যেতে পারব না।"
রিনি নরম গলায় বলে,"কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। তোমার কথা আমার বাবা জানত। মাও জানে। আমি বলেছিলাম তাকে খুঁজে পেলে তোমাদের সামনে হাজির করব। কিন্তু কেউ আমার কথা আজও বিশ্বাস করে না।"
"তোমার বাবা জানত। এখন জানে না?" জানতে চাইল হিতেশ।
রিনি বলল,"বাবা চলে গেছেন।চার মাস আগে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।" রিনির চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। "তাই মা সবসময় আমার বিয়ে নিয়ে চিন্তায় থাকেন।"
রিনির বাবার মৃত্যুর খবর জেনে দুঃখ পেল হিতেশ। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,"মৃত্যুকে কেউ এড়াতে পরে না। তোমার বাবাও পারেননি। দুঃখ পেওনা রিনি।"
"আমি বাবার একমাত্র সন্তান। আমাকে বিয়ে দেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন বাবা। আমি এখনও মেয়ে দেখার আসনে বসিনি। লোকে বলে সেই দুঃখে চিন্তায় আমার বাবা মারা গেছেন। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হলে আমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে। সেই সময় একবার যদি তোমার সঙ্গে দেখা হতো!" বলল রিনি।
রিনির কথায় হিতেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার বাবার মৃত্যুতে নিজের একটু অপরাধী মনে হচ্ছে হিতেশের। কিন্তু তাতে তার কী বা করার ছিল! এক পলকের দেখা একটা মেয়ে এভাবে এতদিন অপেক্ষা করে থাকতে পারে! কোন দৃষ্টিকোণ থেকে সে তার জন্য অপেক্ষা করছে। মিথ্যা বলছে না তো রিনি! ভাবল হিতেশ।সে রিনিকে জিজ্ঞেস করে,"কে কে আছো বাড়িতে?"
"শুধু মা আর আমি। তুমিও থাকতে পারবে সেখানে। অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে।" মিষ্টি খেতে খেতে বলে রিনি,"আসলে আমার মা ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ের পরে মাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে। তুমি ভেবো না, আমি মানিয়ে নেব। মাও বলেন ছেলেদের শ্বশুরবাড়িতে থাকা উচিত নয়।"
অবাক হয়ে যায় হিতেশ। সংসারের অনেক দর্শন জানা হয়ে গেছে রিনির। তার বাবা মারা গিয়েছেন। মা বাড়িতে একা থাকেন। সংসারের ভার মাথায় নিয়ে সে এখন অনেক পরিণত। আরও কত সংগ্রাম করতে হবে মেয়েটার!
হিতেশ বলল, "এবার ওঠা যাক। একটা ট্রেন চলে গেছে। পরের ট্রেন না ধরলেই নয়।"
"তা বললে হবে না। আমার মায়ের সঙ্গে দেখা না করে তোমার যাওয়া হবে না।" শর্ত দিল রিনি।
"আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে কী বলব?" প্রশ্ন করে হিতেশ।
রিনি বলে,"তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি সবকিছু বলে রেখেছি। মা তোমাকে জানেন। শুধু চোখে দেখেন নি।"
দুজনে উঠে পড়ে। দোকান থেকে বেরিয়ে এক ভদ্রলোকের মুখোমুখি হলো রিনি। তিনি রিনিকে বললেন,"কেমন আছেন দিদিমণি?"
"ভালো আছি। শিগগীর সুখবর পাবেন। আমন্ত্রণ পত্র পাবেন বাড়িতে। বাড়ির সকলকে নিয়ে আসা চাই।" আবেগঘন হয়ে বলল রিনি।
ভদ্রলোক খুশি হয়ে বললেন, "এর থেকে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে! আমরা অবশ্যই যাব।"
"আমরা চললাম। ট্রেন ধরতে হবে," বলে হিতেশের হাত ধরে এগিয়ে যেতে লাগল।
ভদ্রলোক বললেন,"এবার মেয়েটির মনে হাসি ফুটেছে।"
ভদ্রলোকের কথার উত্তর না দিয়ে রিনি হিতেশকে বলল,"উনি আমাদের স্কুলের সেক্রেটারী। খুব ভালো মনুষ। আমি ওনাকে খুব শ্রাদ্ধ করি।"
হিতেশ এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল। সে নরম গলায় বলল, "হাত ছাড়।"
রিনি হাত না ছেড়ে বলে,"চলো। এখনই ট্রেন এসে যাবে।"
রিনি এমন আচরণ করছে, যেন হিতেশের সঙ্গে তার বহু দিনের সম্পর্ক। সে বুঝতে পারে, ব্যাপারটা অনেকখানি গড়িয়ে যাচ্ছে। এবার থামাতে না পারলে জটিল হয়ে যাবে। হিতেশ কিছু বলার আগে রিনি বলল,"আমরা সামনের বগিতে উঠব।"
হিতেশ এবার মন শক্ত করে বলল,"আমার পিছনে উঠলে সুবিধা হয়।"
রিনি বলল,"তুমি এখন আমাদের বাড়িতে যাচ্ছ।"
"না রিনি। আমি যাব না। তোমার জানা দরকার।" বলল হিতেশ।
"কি জানা দরকার?" জিজ্ঞাসা করল রিনি।
"আমি বিবাহিত। তোমাকে কোনরকম আশ্বাস দিতে পারব না," জানাল হিতেশ।
"কবে বিয়ে করলে?" প্রশ্ন করে রিনি।
"দুই মাস আগে," বলল হিতেশ।
রিনির চোখ ছল ছল করে উঠল। সে আবার জিজ্ঞেস করল,"সে খুব সুন্দরী নিশ্চয়।"
হিতেশ বলল,"একটি মেয়ের সঙ্গে অন্য একটি মেয়ের আমি তুলনা করতে পারি না। সে আমার স্ত্রী। আমার চোখে সে সুন্দরী।"
হতাশ হয়ে প্ল্যাটফর্মের স্থায়ী চেয়ারে বসে পড়ে রিনি। তারপর চোখ মুছে দুহাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে। হিতেশ বলে,"শরীর খারাপ লাগছে রিনি?"
রিনি বলল,"আমি ঠিক আছি। তুমি মজা করছ না তো?"
হিতেশ বলল,"বাস্তব সত্যটা তোমার সামনে তুলে ধরলাম।"
একেবারে বোকার মতো বসে রইলো রিনি। ট্রেন স্টেশনে এসে গেছে। লোক নেমে গেছে। অনেকে টিকিট কেটে দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠছে। যে এতক্ষণ প্রাণ চঞ্চল হয়ে হাঁটছিল, সে এখন উঠতে পারছে না। হিতেশ বলল,"তুমি না উঠলে আমি ট্রেন ধরতে পারছি না।"
রিনি বলল,"তুমি চলে যাও, আমি পরে যাব। এখন আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেছে।"
হিতেশ শান্ত্বনা দিয়ে বলল,"আমি তোমাকে মিথ্যা বলে ঠকাতে পারতাম। তা আমি করি নি। তুমি বাস্তবকে মেনে নাও রিনি।"
কোন বাক্যব্যয় না করে উঠে পড়ে রিনি। তারপর দুজনে ট্রেন চড়ে। কোন রা কাটে না মুখে। হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে। হিতেশ তাকে ধরে ফেলে। সে বলে,"শান্ত হও।"
রিনি চোখ মুছতে মুছতে বলে,"সেদিন তোমার সঙ্গে কেন আমি কথা বলিনি!"
"সেদিনের কথা ভেবে আজ আমরা দুঃখ করব না," বলল হিতেশ।
"সেদিন আমার গ্রামের দুই দাদা এসে পড়ায় আমার ভবিষ্যত খাদে এসে পড়েছে।"বলল রিনি।
ততক্ষণে রিনির স্টেশন এসে গেল। ট্রেন থেকে নেমে পড়ল রিনি। তারপর তাকিয়ে রইল হিতেশের দিকে। মুখে তার একরাশ হতাশা। ট্রেন ছাড়তেই সে হাত নেড়ে সেদিনের মতো বিদায় জানাল রিনি। হিতেশের বুকটাও মুচড়ে উঠল।
প্রায় এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। সবাই কাজে যেতে ব্যস্ত। ক্যানিং স্টেশনে নেমে হিতেশের সঙ্গে দেখা হলো রিনির।সে হিতেশকে বলল, "তুমি ভালো আছো?"
হিতেশ বলল,"ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?"
রিনি সংক্ষেপে উত্তর দিল,"ভালো।"
হিতেশ আবার জিজ্ঞেস করল,"তোমার মা কেমন আছেন?"
রিনি বলল,"মা আর নেই। মা গত হয়েছেন চার মাস আগে।"
হিতেশ বলল,"দুঃখজনক।" তারপর জানতে চাইল," তুমি বিয়ে করো নি?"
হিতেশের চোখের দিকে তাকিয়ে রিনি বলল, "তোমার আসনে অন্য কারো বসাতে পারব না। তাই বিয়ে করিনি।"
আর একটিও মুহূর্ত অপেক্ষা না করে দ্রুতপায়ে চলে গেল সে। তার দিকে আশ্চর্য হয়ে নিস্পলকে তাকিয়ে রইল হিতেশ।
__________________
হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
আমতলা, ক্যানিং, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ভারতবর্ষ